ভারতের সুপ্রিম কোর্টের সাবেক প্রধান বিচারপতি রঞ্জন গগৈ স্বীকার করেছেন, তিনি অযোধ্যা মামলার রায় শোনানোর পরপরই নিজের পছন্দের মদ পান করেছিলেন। তিনি আত্মজীবনীতে এই স্বীকারোক্তি করেছেন, যা সম্প্রতি প্রকাশ পেয়েছে। ওই গ্রন্থে তিনি অযোধ্যা রায় সম্পর্কে আরো কিছু কথা বলেছেন। তবে সবচেয়ে বেশি বিতর্ক তৈরি হয়েছে তার এই কথাকে ঘিরেই। কিছু লোকের ধারণা, বিচারপতি গগৈ যে ধরনের রায় শুনিয়েছিলেন, তার পর তার চৈতন্যে থাকা তার স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর হতে পারত। এ জন্য তিনি অচেতন থাকাকে বেশি সঙ্গত মনে করেছেন।
বাহ্যত অন্যদের ধর্মীয় আবেগ ও চেতনাকে বিদীর্ণকারী রায়ে মানুষের চৈতন্য ও অনুভ‚তি ঠিক থাকে না। বিস্ময়কর বিষয় হচ্ছে, বিচারপতি গগৈ তার এই মারাত্মক বিতর্কিত রায়ের ব্যাপারে এই দাম্ভিকতাও প্রকাশ করেন যে, ‘এর দ্বারা সারা বিশ্বের ধর্মীয় সম্প্রদায়গুলোর মাঝে ধর্মীয় বিবাদগুলো শান্তিপূর্ণ ও ন্যায়সঙ্গত পন্থায় নিষ্পত্তির ইচ্ছা সৃষ্টি হলো।’ তিনি তার এই রায়কে ‘মানবেতিহাসে বিচারিক ত্যাগের একটি দৃষ্টান্ত’ আখ্যায়িত করেছেন। আমাদের জানা নেই, অযোধ্যা বিবাদ সংক্রান্ত এই রায়ের আলোকে বিশ্বে ধর্মীয় সঙ্ঘাতকে ন্যায়সঙ্গত পন্থায় সমাধান করার ইচ্ছা কবে কোথায় সৃষ্টি হয়েছে। হ্যাঁ, এতটুকু তো অবশ্যই হয়েছে যে, তার এই রায় থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে সাম্প্রদায়িক ও নৈরাজ্যবাদী শক্তিগুলোর সাহস আকাশ ছুঁতে চলেছে এবং মসজিদগুলোকে মন্দিরে রূপান্তরিত করার আন্দোলন বেগবান হয়েছে যা ভারতে শান্তি ও নিরাপত্তার জন্য হুমকির বড় কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর টাটকা উদাহরণ, মথুরা শাহী ঈদগাহের বিরুদ্ধে সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীগুলোর সাম্প্রতিক ষড়যন্ত্র। বিচারপতি গগৈ আত্মজীবনীতে অযোধ্যা বিবাদ সংক্রান্ত মামলায় তার দেয়া রায় নিয়েই সবচেয়ে বেশি আলোচনা করেছেন। তিনি লিখেছেন, অযোধ্যা বিবাদের সমাধানের পেছনে ‘আত্মিক শক্তি’ কাজ করেছে। রায় শোনানোর পর তিনি তার বেঞ্চের সব বিচারপতিকে নিয়ে নয়াদিলির তাজ মানসিং হোটেলে যান। ওখানে তারা খাওয়াদাওয়ার পর নিজেদের পছন্দের সবচেয়ে দামি মদ গলাধঃকরণ করেন। আমাদের জানা নেই, সেটি কোন আত্মিক শক্তি ছিল, যা তাদের রায়ের পর শরাবখানায় নিয়ে যায়। মদ খাওয়া কারো ব্যক্তিগত কাজ। আর বিচারপতি গগৈ যে ধর্মের মানুষ, সেখানে মদ নিষিদ্ধ নয়। অবশ্য ইসলামে মদকে সব ‘মন্দের মূল’ অভিহিত করা হয়েছে। এ জন্য তার এই কর্ম নিয়ে কোনো অভিযোগ নেই আমাদের। তবে এ বিষয়ে অবশ্যই অভিযোগ আছে যে, তিনি পাঁচ শত বছরের প্রাচীন মসজিদের স্থানে পরিপূর্ণ সজ্ঞানে স্বাভাবিক অবস্থায় মন্দির নির্মাণের রায় শোনানো সত্ত্বেও নিজের চৈতন্য হারানোকে কেন জরুরি মনে করলেন? বিশ্ব জানে, অযোধ্য মামলায় তার রায় নিঃসন্দেহে পক্ষপাতিত্বমূলক রায়। কেননা তিনি তার রায়ে বাবরি মসজিদ জুলুমের শিকার হয়েছে, এ কথা স্বীকার করা সত্তে¡ও রায় মন্দিরের পক্ষেই দিয়েছেন। এ কারণেই ওই রায়ের পর দেশে মুসলমানদের ধর্মীয় পরিচয় মিটিয়ে দেয়ার স্বপ্ন লালনকারী শক্তিগুলো আবারো তৎপর হয়ে উঠেছে।
আপনারা দেখেছেন, গত ৬ ডিসেম্বর যে সময় ভারতজুড়ে বাবরি মসজিদ শহীদ দিবস পালন করা হচ্ছিল, ওই সময় মথুরার শাহী ঈদগাহে উগ্রপন্থী গোষ্ঠী নোংরা খেলায় মেতে ওঠার চেষ্টা করছিল। তারা এখানেও ঠিক সেইভাবে মূর্তি স্থাপনের চেষ্টা করে, যেমনভাবে বাবরি মসজিদে করা হয়েছিল। এই চেষ্টার একটাই উদ্দেশ্য ছিল, মথুরার শাহী ঈদগাহকেও ওইভাবে বিতর্কিত করা হবে, যেভাবে অযোধ্যার বাবরি মসজিদকে বিতর্কিত করা হয়েছিল। অবশ্য প্রশাসন ও পুলিশ কঠোর নিরাপত্তার ব্যবস্থা করে ওই চেষ্টা আপাতত বানচাল করে দিয়েছে। কিন্তু এ প্রশ্ন দেখা দেয় যে, ওই গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা কেন গ্রহণ করা হলো না, যারা মথুরার শান্তি ও নিরাপত্তার বিঘ্নতার চেষ্টা করছিল এবং একটি সম্প্রদায়ের ইবাদতের স্থানকে নাপাক করতে চাচ্ছিল? শাহী ঈদগাহে কৃষ্ণ ভগবানের মূর্তি স্থাপন করার কর্মসূচি যেহেতু বাবরি মসজিদের শাহাদতের দিন রাখা হয়েছিল, এ জন্য পুলিশ ও প্রশাসন এতে বিশেষ নজর রাখছিল। চিন্তার বিষয় হচ্ছে, রাজ্যের উপমুখ্যমন্ত্রী কেশবনাথ মৌর্য এ কথা বলে মথুরার শাহী ঈদগাহের ইস্যুতে ঘি ঢালার কাজ করেছেন যে, ‘অযোধ্যয় মন্দির তৈরি হচ্ছে। এবার মথুরার পালা।’
এটা এমন এক ব্যক্তির বক্তব্য, যিনি সাংবিধানিক শপথ নিয়ে উপমুখ্যমন্ত্রীর চেয়ারে বসেছেন। এ কথা সবাই জানেন, দেশে এমন এক আইন বিদ্যমান আছে, যার আওতায় ১৯৪৭ সালে যে ইবাদতের স্থান বা উপাসনালয় যে অবস্থাতে ছিল, তা ওই অবস্থাতেই থাকবে। অযোধ্যার মতো আরো বিবাদ সৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কা প্রতিহত করার জন্য নরসিমা রাওয়ের শাসনামলে ১৯৯১ সালে এই আইন প্রণয়ন করা হয়েছিল। আপনাদের মনে থাকার কথা, যে সময় সুপ্রিম কোর্ট বাবরি মসজিদের ভূমি রামমন্দির ট্রাস্টকে অর্পণ করেছিলেন, ওই সময় আরএসএস এবং অন্যান্য উগ্রপন্থী সংগঠন এ কথা বলেছিল, ‘এখন ভারতে অযোধ্যার মতো কোনো দ্বিতীয় বিবাদ সৃষ্টি হবে না। এ ধারা এখানে শেষ।’ কিন্তু ফ্যাসিবাদীর সবচেয়ে বড় পরিচয় এটাই যে, তারা মুখ দিয়ে যা কিছু বলে, তাদের কার্যকলাপ ঠিক তার উল্টো।
উত্তরপ্রদেশের উপমুখ্যমন্ত্রী কেশবনাথ মৌর্যের পক্ষ থেকে মথুরার শাহী ঈদগাহের ইস্যু উত্থাপন আকস্মিক বিষয় নয়। এটা বিজেপির কর্মকৌশলের অংশ। এর মাধ্যমে তারা উত্তরপ্রদেশ অ্যাসেম্বলির নির্বাচনে হিন্দু ভোটারদের টানতে চাচ্ছে। এ কারণেই পরে রাজ্য সভাতেও বিজেপি দলীয় সদস্য হরনাথ সিং বলেন, এ সমস্যা সমাধানের জন্য ইবাদতের স্থান বা উপাসনালয় সংরক্ষণ সম্পর্কিত ১৯৯১ সালের আইনটি প্রত্যাহার করতে হবে। রাজ্যসভায় এই প্রশ্ন উত্থাপনের অনুমতি প্রসঙ্গে বেশ গণ্ডগোলও হয়। এ কথা কারো কাছে গোপন নেই যে, মূলত ভারত থেকে মুসলিম পরিচয় মিটিয়ে দেয়ার জন্য ঐতিহাসিক মসজিদগুলোকে মন্দিরে রূপান্তর করার আন্দোলন শুরু করা হয়েছে। এ আন্দোলন শুধু মসজিদগুলোর নামনিশানা মিটিয়ে দেয়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং ভারতে মুসলিম সংস্কৃতির যত চিহ্নই রয়েছে, সবই বর্তমানে হুমকির মধ্যে আছে। উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথের শাসনামলের সবচেয়ে বড় অর্জন তো এটাই যে, তিনি তার রাজ্যে মুসলমানদের একেবারে কোণঠাসা করে ফেলেছেন। তিনি মুসলমানদের নামে পরিচিত কিছু শহরের নাম পাল্টে ফেলেছেন। আরো কিছু শহরের নাম পাল্টানোর প্রক্রিয়ায় রয়েছে। এগুলোর মধ্যে আছে আজমগড়, আলীগড় ও সুলতানপুরের মতো শহরও। বিজেপি হাজারবার এ দাবি করেছে যে, তারা ‘সব কা সাথ, সব কা বিকাশ আরও সব কা বিশওয়াশ’ (সবার সাথে সবাইকে সাথে নিয়ে, সবার উন্নয়ন এবং সবার আস্থা) এজেন্ডার পথে চলছে। অথচ বাস্তবতা হলো, তারা ভারতের গঙ্গা যমুনার সংস্কৃতিকে একত্র করে এখানে হিন্দুরাষ্ট্র বানানোর পথে দ্রুততার সাথে এগিয়ে যাচ্ছে। এ কারণেই মুসলিম পরিচিতিগুলোর ওপর একের পর এক হামলা করা হচ্ছে এবং বিভিন্ন অজুহাতে তার অস্তিত্ব মিটিয়ে দেয়ার ষড়যন্ত্র রচনা করা হচ্ছে। উগ্রপন্থীদের সবচেয়ে বড় নিশানা হচ্ছে ঐতিহাসিক স্থাপনাগুলো, যেগুলো দেশের বিভিন্ন স্থানে মুসলিম বাদশাহরা নির্মাণ করেছিলেন। সম্প্রতি দিলির একটি আদালত কুতুব মিনারের আঙিনায় অবস্থিত কুওয়াতুল ইসলাম মসজিদের ভেতর মূর্তি রাখা এবং সেখানে পূজাপাঠের অনুমতি প্রদান সম্পর্কে আবেদন খারিজ করে দিয়েছেন। ওই আবেদনে বলা হয়েছিল, কুওয়াতুল ইসলাম মসজিদকে জৈন ও হিন্দু মন্দিরের উপকরণ দিয়ে বানানো হয়েছে। সুতরাং এখানে পূজার অনুমতি দেয়া হোক।
মথুরার শাহী ঈদগাহ ও বানারসের জ্ঞানবাপী মসজিদগুলোর প্রতি আগে থেকেই উগ্রপন্থীদের দৃষ্টি পড়েছিল। আপনাদের মনে থাকার কথা, রামজন্মভূমি মুক্তি আন্দোলনের সময় এ স্লোন বেশ জোরে শোরে দেয়া হতো- ‘অযোধ্যা তো এক ঝাঁকি হ্যায়, কাশী মথুরা বাকি হ্যায়।’ এটা এবং এ ধরনের অপর স্লোগানগুলোর একটাই উদ্দেশ্য ছিল, যে কোনোভাবে মুসলিম সম্প্রদায়কে নত হতে বাধ্য করা হবে এবং তারা বাবরি মসজিদ থেকে নিজেদের হাত গোটানোর ঘোষণা দেবে। ওই সময় কিছু মুসলিম বুদ্ধিজীবীরও এ বক্তব্য ছিল যে, বাবরি মসজিদ থেকে হাত গোটানোর দ্বারা অপর ইবাদতের স্থানগুলোকে রক্ষা করা যেতে পারে। তবে দূরদর্শী ব্যক্তিদের ওই সময়ও এই অভিমত ছিল যে, বাবরি মসজিদ শুধু একটি ইবাদতের স্থান নয়, বরং মুসলমানদের ধর্মীয় বৈশিষ্ট্য রক্ষার একটি নিদর্শন। যদি মুসলমান এখান থেকে হাত গুটিয়ে নেয়, তাহলে এ ধারার আরো দাবি সামনে আসবে এবং তাদের বেঁচে থাকা কঠিন করে দেয়া হবে। শুকরিয়া, মুসলমানরা সর্বাত্মক ক্ষতি সত্তে¡ও বাবরি মসজিদ থেকে হাত গোটানোর ফর্মুলা মেনে নেয়নি। সরকারকে সেটি অর্জন করতে আদালতের আশ্রয় নিতে হয়েছে। আদালতের মাধ্যমে বাবরি মসজিদের ভ‚মি অর্জনের পর এখন ইবাদতের অপর স্থানগুলোকেও নিশানা বানানো হচ্ছে। বিচারপতি গগৈয়ের রায়ের এটাই সবচেয়ে বড় ত্রুটি যে, তিনি উগ্রপন্থী ও মুসলিমবিদ্বেষী শক্তিগুলোর হাতে একটি অস্ত্র তুলে দিয়েছেন।
মুম্বাই থেকে প্রকাশিত দৈনিক মুম্বাই উর্দু
নিউজ ১২ ডিসেম্বর,
২০২১ থেকে ভাষান্তর ইমতিয়াজ বিন মাহতাব
ahmadimtiajdr@gmail.com
লেখক : ভারতের প্রখ্যাত সাংবাদিক ও কলামিস্ট