লঞ্চডুবি, অগুনতি লাশ, শোক প্রকাশ, ক্ষতিপূরণ, তদন্ত কমিটি- এগুলোর একটিও নতুন ঘটনা নয়। নতুনত্ব হচ্ছে, লঞ্চ এখন শুধু ডোবে না, আগুনে পুড়ে ছাইও হয়ে যায়। মানুষের মস্তিষ্কে যুক্তি ও আবেগের নতুন খোরাক। যুক্তি, আবেগ ও বাস্তবতার এ লড়াই নিশ্চয়ই চলবে কিছুদিন। হবে কথামালা, ফলোআপ সংবাদ, সম্পাদকীয়, উপসম্পাদকীয়, টক শো নামের বয়ানশিল্প। আরও কত কী! এর পর নতুন ইস্যু। টিস্যুর মতো হারিয়ে যাবে বাংলাদেশের ইতিহাসের এ নতুন অঘটনটিও। মানুষও দিব্যি ভুলে যাবে। মনে করিয়ে দিলে একটু-আধটু স্মরণে আসবে। নইলে এমন কিছু ঘটেইনি বলে ক্ষেপে উঠবে। যুক্তি আর আবেগের সংঘাতের বাস্তবতা এখানেই।
দেশে আগে কখনো পানির মধ্যে লঞ্চ বা জাহাজে এমন অগ্নিকা- হয়েছে বলে তথ্য মেলে না। কখনো কখনো ডকইয়ার্ডে মেরামতের সময়, যাত্রীবাহী লঞ্চের ইঞ্জিন রুমে বা কেবিনে ‘ছোটখাটো আগুনের’ কিছু ঘটনা রয়েছে। তবে প্রাণহানি হয়নি। শিরোনাম হওয়ার মতো নিউজ ভ্যালু দাঁড়ায়নি। জলের ওপরে আগুন জ্বলে এত প্রাণহানি কেবল লঞ্চ মালিক, যাত্রী বা নৌমন্ত্রণালয় নয়, সবার জন্যই হতবিহ্বলে ভাবনার বিষয় হওয়াই স্বাভাবিক।
কেন এ আগুনের সূত্রপাত, কীভাবে ছড়িয়ে পড়ল- এ নিয়ে কথার খই ফুটছে। মোটা দাগে ঘটনা হচ্ছে, যেসব কারণে বিভিন্ন সময় লঞ্চ ডোবে, মানুষ মরে এ ক্ষেত্রেও কারণ প্রায় কাছাকাছি। ভাসাভাসা বাতকাবাত আলাপে শীতকেও দায়ী করা হচ্ছে। বলা হচ্ছে, শীত না হলে এত মানুষ মারা পড়ত না। কারণ শীতের লেপ, কম্বল ও পোশাক থাকায় আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছে। লেপ, কম্বল, ছালার চটের পাশাপাশি আগুনের সূত্রপাত হিসেবে লঞ্চে থাকা একটি মোটরসাইকেলকেও দায়ী করা হচ্ছে। বলার চেষ্টা করা হচ্ছে, মোটরসাইকেলে পেট্রল অকটেন থাকে, যা দ্রুত আগুন ছড়িয়ে দেয়।
যাত্রীদের বরাতে এরই মধ্যে প্রমাণিত, ঢাকার সদরঘাট থেকে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৬টায় বরগুনার উদ্দেশে যাত্রার শুরু থেকেই লঞ্চটির গতি ছিল বেপরোয়া। ইঞ্জিনে ত্রুটি থাকায় চারজন টেকনিশিয়ান ত্রুটি মেরামতে কাজ করছিলেন। এজন্য পুরো গতিতে দুটি ইঞ্জিন চালিয়ে ট্রায়াল দেওয়া হচ্ছিল। আর এতেই মূলত ইঞ্জিনের অতিরিক্ত তাপে আগুন ধরে যায়। আগুন লেগে যাওয়ার পর নেভানোর কোনো চেষ্টা না করে লঞ্চটির শ্রমিক-কর্মচারী ও মালিক লঞ্চ থেকে সটকে পড়েন। ভয়াবহ এ দুর্ঘটনা থেকে প্রাণে বেঁচে ফেরা যাত্রীদের অভিযোগ, লঞ্চটি ধারণক্ষমতার বেশি যাত্রী নিয়ে রওনা হয়েছিল। লঞ্চে ছিল না অগ্নিনির্বাপণের কোনো ব্যবস্থা। অগ্নিনির্বাপক গ্যাস সিলিন্ডার থাকলেও সেগুলো ছিল বিকল। লঞ্চটির ইঞ্জিনের ত্রুটি থাকায় চারজন ইঞ্জিন মেরামতকারী টেকনিশিয়ান লঞ্চটির ইঞ্জিনকক্ষে ছিলেন। তারাই মূলত পুরো গতিতে লঞ্চটি চালাচ্ছিলেন। ইঞ্জিনে গ্যাস হওয়ায় বেশ কয়েকদিন আগে থেকেই ইঞ্জিন প্রচ- গরম হচ্ছিল। ইঞ্জিনের ত্রুটি খুঁজে পেতে পুরো গতিতে দুটি ইঞ্জিনই চালাচ্ছিলেন তারা। বেপরোয়া গতির কারণে লঞ্চটি কাঁপছিল।
অথচ বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ-বিআইডব্লিউটিএ তাৎক্ষণিকভাবে এসব গোলমাল এড়ানোর চেষ্টা করছে। উপরন্তু জানানো হয়েছে, ৩১০ যাত্রী নিয়ে ঢাকা থেকে বরগুনা যাচ্ছিল লঞ্চটি। যাত্রীরা বলছেন, প্রায় এক হাজারের মতো মানুষ ছিল লঞ্চে। অথচ দেশে লঞ্চে ধারণক্ষমতার দ্বিগুণ যাত্রী বহন করা গুরুতর অপরাধের মধ্যে পড়ে না। দুর্ঘটনা ঘটলে কয়েকদিন কথার কচলানি চলে। অনিয়মের বিরুদ্ধে হুমকি, কাউকে না ছাড়ার ধমকি, বরদাশত না করার হুশিয়ারি চলে সমানে। সেই সঙ্গে বেশ সময় নিয়ে এক বা একাধিক তদন্ত রিপোর্ট, চমৎকার যত সুপারিশমালা। এবারও কি তাই হবে?
ডিজেলের দাম বৃদ্ধির অজুহাতে কিছুদিন আগে ইচ্ছেমতো লঞ্চ ভাড়া বাড়ানো হয়েছে। কিন্তু যাত্রীদের কোনো সুবিধা বাড়ানো হয়নি। দুর্বৃত্তায়নের জয়জয়কারের এটি আরেক দৃষ্টান্ত। লঞ্চটি থেকে প্রাণে বাঁচা যাত্রীদের হৃদয়বিদারক বহু বর্ণনা এরই মধ্যে গণমাধ্যমে এসেছে। এখানে আমরা এমভি অভিযান-১০ লঞ্চে অগ্নিকা- থেকে বেঁচে যাওয়া পাথরঘাটা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা-ইউএনও হোসাইন মুহাম্মদ আল মুজাহিদের কিছু বর্ণনা উল্লেখ করতে পারি। স্ত্রীসহ তিনি ছিলেন লঞ্চের দ্বিতীয় তলায় ভিআইপি কেবিনে। মুজাহিদ জানান, ‘রাত তিনটার দিকে হঠাৎ লঞ্চের দ্বিতীয়তলায় ভিআইপি কেবিনসহ আশপাশ এলাকায় ধোঁয়ায় তাদের নাক বন্ধ হয়ে আসে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই মানুষের চিৎকারে এক বীভৎস অবস্থা তৈরি হয়। এ সময় স্ত্রীকে নিয়ে কত দ্রুত ও কীভাবে যে তিনি লঞ্চের সামনের দিকে ধেয়ে গেছেন তার মনে নেই। ততক্ষণে ঝালকাঠির দিয়াকুল গ্রামে নদীর তীরে লঞ্চটি ভেড়ানো মাত্র তিনি স্ত্রীকে নিয়ে দ্রুত নেমে যান। এ সময় কয়েকশ মানুষ লঞ্চ থেকে নামতে পারলেও বেশিরভাগ মানুষ লঞ্চে আটকা পড়ে যায়। তিনি নিজ চোখে দেখেছেন, প্রাণ বাঁচাতে কত মানুষ নদীতে ঝাঁপ দিয়েছেন। প্রচ- শীতের রাতে তারা নদী সাঁতরে তীরে উঠতে পেরেছেন কিনা, জানেন না তিনি।
শিশু, নারীসহ যাত্রীদের চিৎকারে বীভৎসতার আরেক চিত্র দেখা গেছে হাসপাতালে। নৌপথে দক্ষিণাঞ্চলের ঢাকা-বরগুনা রুটের যাত্রী পরিবহনে বছরদুয়েক আগে চালু হয় বিলাসবহুল লঞ্চটি। বরিশালসহ বরগুনার বেতাগী, কাঁকচিড়া ঘাটে যাত্রী বহন করত নৌযানটি। মাত্র ১৫ দিন আগে মেরামত কাজ হয় এটির। এর পর চারটি ট্রিপ সম্পন্ন করে। এর বেশিরভাগ যাত্রী বরগুনা জেলা ও এর আশপাশের এলাকার। তাই আগুনের ঘটনায় হতাহতের বেশিরভাগই বরগুনা জেলার। তথ্য-তালাশে জানা গেছে, এটি এর আগেও একবার চরে উঠিয়ে দিয়েছিল। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের বরিশাল বিভাগীয় উপপরিচালক কামাল উদ্দিন ভূঁইয়ার তাৎক্ষণিক বক্তব্যেও লঞ্চ কর্তৃপক্ষের কিছু গাফিলতির তথ্য মেলে। তিনি জানিয়েছেন, তারা রাত সাড়ে তিনটার দিকে লঞ্চে আগুন নেভাতে গিয়ে কর্তৃপক্ষের কাউকেই পাননি। পরে স্পিডবোট দিয়ে খোঁজাখুঁজিও করেন। লঞ্চের কেবিনে কেবিনে লাশ পড়ে থাকতে দেখেছেন তারা। লঞ্চে তারা অগ্নিনির্বাপণব্যবস্থার কিছুই পাননি। ঘটনার পরদিন ক্ষতিগ্রস্ত লঞ্চটি দেখতে গিয়ে নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বলেছেন, আগুনে পুরো একটি লঞ্চ পুড়ে যাওয়ার পেছনে কোনো রহস্য থাকতে পারে। থাকলে সেই রহস্য উদ্ধারের দায়িত্ব সরকারের ওপরই বর্তায়। লঞ্চটির ২০২২ সাল পর্যন্ত ফিটনেস মেয়াদ ছিল- এ তথ্য এসেছে মন্ত্রীর মুখ দিয়ে। তা হলে কী দাঁড়াল অর্থ? ফিটনেস থাকা লঞ্চেরই এ অবস্থা? বিনা ফিটনেসে যেগুলো চলছে সেগুলোর কী দশা?
বাস্তবতা কী নির্মম! পানির অভাব ছিল না, তার পরও আগুন নেভানো গেল না। এত মানুষকে পুড়িয়ে মারার অপরাধে কারও কি বিচার হবে? নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় থেকে একজন যুগ্মসচিবকে প্রধান করে সাত সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। সাত দিনের মধ্যে কমিটি তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিলে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন তিনি। তবে যুক্তিতে মুক্তির অজুহাতে কিছু বাড়তি কথা বলেছেন। অভিযান-১০ নামের লঞ্চটিতে পর্যাপ্ত জীবন রক্ষার সরঞ্জাম ও অগ্নিনির্বাপণব্যবস্থা ছিল কিনা-তা এড়িয়ে যাওয়ার বেশ চেষ্টা চলছে। লঞ্চটিতে যাত্রী কি ধারণক্ষমতা অনুসারে ছিল? লঞ্চটির ছাদে কোনো ছোট বোট ছিল? এসব যৌক্তিক প্রশ্নের কিনারা না করে কথার চাতুরী কাম্য নয়। সমস্যা স্বীকার করলেই না সমাধানের চেষ্টা। সমস্যা আড়াল বা অস্বীকার করলে এমন ঘটনা আরও ঘটার শঙ্কাকে বেগবান করে।
মোস্তফা কামাল : সাংবাদিক, কলাম লেখক ও বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন