বিশ্ববাসীর মতো আমরা বাংলাদেশের মানুষও ২০২১ সালকে বিদায় জানিয়ে নতুন বছর ২০২২ সালকে বরণ করে নিতে উন্মুখ হয়ে অপেক্ষায় আছি। বছর বিদায়ের এই মুহূর্তে পেছনে ফিরে তাকিয়ে আমরা কি বিষাদভারাক্রান্তবোধ করছি? না, ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি না, বিদায়ী বছরে আমরা এমন কিছু পেয়েছি যা আগামী বছরে পাওয়ার সম্ভাবনা নেই। আসলে পাওয়া না-পাওয়ার হিসাব মেলাতে না মেলাতেই একটি বছর চলে যায়, আর একটি নতুন বছর এসে হাজির হয়। বছর বিদায়ের দিনকয়েক আগে আমরা ঝালকাঠির সুগন্ধা নদীতে একটি লঞ্চে আগুন লাগার ঘটনায় অনেক মানুষের করুণ মৃত্যুর খবর জেনে ভারাক্রান্ত হয়েছি। প্র্রতিদিন নানা দুর্ঘটনায় আমাদের দেশে কত মানুষের অকাল মৃত্যু হয়। কত মানুষ পঙ্গুত্ববরণ করতে বাধ্য হয়। কত মানুষের জীবনে, কত পরিবারে নেমে আসে অবর্ণনীয় দুঃখ। কান্না-হাহাকার হয়ে দাঁড়ায় চিরসঙ্গী। ২০২১ সালেও সড়ক, নৌ ও রেলপথে অনেক দুর্ঘটনা ঘটেছে, জীবন ও সম্পদের অনেক ক্ষতি হয়েছে। এসব দুর্ঘটনার বেশিরভাগই এড়ানো সম্ভব সামান্য সতর্ক হলে কিংবা দায়িত্বশীল হলে।
আগের বছরের মতো বিদায়ী বছরেও সবচেয়ে আলোচিত বিষয় ছিল করোনা ভাইরাস। এই ভাইরাস বিশ্বজুড়ে এক দুঃসহ অবস্থা তৈরি করেছে। করোনা মানবজাতিকে এক কঠিন বাস্তবতার সামনে এনে দাঁড় করিয়েছে। করোনার মরণাঘাত থেকে রক্ষা পেতে ক্ষমতাধর থেকে কম ক্ষমতার অধিকারী সবাইকে হিমশিম খেতে হয়েছে। করোনা মহামারীর মধ্যেই নতুন বছর এসেছে। নতুন বছরে নতুন কিছুর প্রত্যাশায় বিশ্ববাসী উন্মুখ হয়ে আছেন। বাংলাদেশও বিশ্ব সম্প্র্রদায়ের বাইরে নয়। আমরাও ইংরেজি নতুন বছরে রাজনীতি-অর্থনীতি-সমাজজীবনে নতুন এবং ভালো কিছুরই আশা করছি।
রোহিঙ্গা শরণার্থীদের তাদের নিজ দেশে ফিরিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে কোনো অগ্রগতি হয়নি। কক্সবাজার রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরে আগুন লাগা, রোহিঙ্গা নেতা মহিবুল্লাহ হত্যাসহ এমন কিছু ঘটনা ঘটেছে যা অস্থিরতা তৈরি করছে।
করোনার কারণে দেশের রাজনীতিতে তেমন কোনো উত্তেজনা বছরজুড়েই ছিল না। তবে স্বাধীনতা ও বিজয়ের ৫০ বছর পালন করা হয়েছে নানা আয়োজনের মধ্য দিয়ে। স্বাধীনতার রজতজয়ন্তীর অনুষ্ঠানে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির উপস্থিতিকে কেন্দ্র করে হেফাজতে ইসলাম দেশের বিভিন্ন স্থানে ব্যাপক সহিংসতা করে এক নতুন পরিস্থিতি তৈরি করেছিল। তবে সরকার পরিস্থিতি সামাল দিতে পেরেছে। বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার অসুস্থতা ২০২১ সালের একটি বড় খবর। তিনি বছরের শেষ দুই মাস ধরেই প্রায় ‘জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে’ আছেন। আন্দোলন করে খালেদা জিয়াকে মুক্ত করার হুঙ্কার দিলেও বিএনপি বাস্তবে তেমন বড় কোনো আন্দোলন করতে পারেনি। খালেদা জিয়া কারামুক্ত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন মূলত সরকারের অনুকম্পায়। অভ্যন্তরীণ সংকট এবং নেতৃত্ব নিয়ে বিভেদ-কোন্দলে জর্জরিত বিএনপি সংগঠিতভাবে সরকারবিরোধী অবস্থান নিতে ব্যর্থ হয়েছে। এখন রাজনীতিতে ‘অপশক্তি‘ হিসেবে পরিচিত বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধবিরোধী ধর্মভিত্তিক সংগঠনগুলোর ওপর ভর করে ‘কিছু একটা‘ করার অপচেষ্টা বিএনপি নেতৃত্বের একাংশের মধ্যে তীব্র হয়ে ওঠার খবর শোনা যাচ্ছে। অক্টোবর মাসে দুর্গাপূজাকে কেন্দ্র করে দেশের কয়েকটি এলাকায় সাম্প্র্রদায়িক গোষ্ঠী কিছু সহিংসতা ঘটিয়ে সম্প্র্রীতির পরিবেশ নষ্ট করার অপচেষ্টা চালিয়েছে। নতুন বছরে ধর্মীয় উগ্রবাদীরা কোন পথে হাঁটবে তা পরিষ্কার নয়।
অন্যদিকে দল পরিচালনায় শেখ হাসিনার সাফল্য দেশের মানুষের কাছে স্পষ্ট। তাই সরকারবিরোধী আন্দোলনের ডাকে মানুষের সাড়া এবং অংশগ্রহণ না দেখে আওয়ামী লীগবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কিত। দেশের মানুষের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের মধ্যে ধর্ম নিয়ে আবেগ প্রবল। এই আবেগকে রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করতে দেখা গেছে অতীতেও। এবারও ধর্মের দোহাই দিয়ে ভাস্কর্যবিরোধিতায় নেমে সেভাবে সুবিধা করতে না পেরে নতুন কোনো ফন্দি খোঁজা হবে বা হচ্ছে কিনা, দেখার বিষয় সেটা। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সরকার শক্ত অবস্থানে থাকায় ষড়যন্ত্রকারীরা সুবিধা করতে পারছে না। তাই তাকে দুর্বল করার অপচেষ্টাও অব্যাহত থাকবে। দেশকে শেখ হাসিনার চেয়ে ভালোভাবে এগিয়ে নেওয়ার মতো কোনো নেতা কোনো দলে আছে বলে মানুষ মনে করে না। দীর্ঘদিন ধরে রাজনীতি করেও প্রায় সব নেতাই নিজেদের ‘নিষ্ফলা’ হিসেবে প্রমাণ করেছেন। নেতৃত্বের এই সংকট সহজে কাটবে বলে মনে হয় না। তাই নতুন বছরেও রাজনীতিতে বড় কোনো ঝড় ওঠার আশঙ্কা রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা করছেন না।
বছরের শেষদিকে স্থানীয় সরকার নির্বাচনকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে নতুন মেরুকরণের লক্ষণ দেখা গেছে। বিএনপি দলগতভাবে নির্বাচনে অংশ না নিলেও ভিন্ন পরিচয়ে নির্বাচনের মাঠে আছে। সবচেয়ে বড় বিষয়, আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ দাঁড়িয়ে গেছে প্রায় সারাদেশে। নৌকা প্রতীক নিয়ে যারা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন, তাদের হারিয়ে দিয়ে বিদ্রোহী আওয়ামী লীগ অনেক জায়গায় তাদের শক্তি দেখাচ্ছে। বলা হচ্ছে, প্রার্থী মনোনয়নে নানা ভুলভ্রান্তি হচ্ছে, মূলত টাকা-পয়সা লেনদেনের ফলে। আওয়ামী লীগের জন্য সতর্ক হওয়ার সময় এসেছে বলে অনেকেই মনে করছেন। নতুন বছরে আওয়ামী লীগ ঘর গোছাতে মনোযোগ না দিলে পরপর নির্বাচনে তার বিরূপ্র প্রভাব পড়ার আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ নতুন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে পারে বলে কেউ কেউ আশঙ্কা করছেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র র্যাবের কয়েকজন কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করায় নানামুখী আলোচনার সুযোগ হয়েছে। তবে সরকার পরিস্থিতি নিজেদের অনুকূলে রাখতে তৎপর আছে বলে শোনা যাচ্ছে।
২০২২ সালকে বরণ করার আগে নতুন বছরে আমরা একটি নতুন বিশ্বব্যবস্থার দিকে অগ্রসর হচ্ছি উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, করোনা মহামারী বিশ্ববাসীকে এক কঠিন বার্তা দিয়েছে। যতই উন্নত হোক না কেন, একা কোনো দেশ শ্রেষ্ঠত্বের দাবি নিয়ে দাঁড়াতে পারবে না। পারস্পরিক সহযোগিতা এবং অংশীদারিত্বের মাধ্যমেই যে কোনো বৈশ্বিক সংকট মোকাবিলা করা সম্ভব। সবাইকে এ থেকে শিক্ষাগ্রহণ করার পাশাপাশি তারুণ্যের শক্তি ও প্রযুক্তিজ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবে নেতৃত্ব দেওয়ার সক্ষমতা অর্জন করতে হবে। সরকারের অবস্থান এক বছর পরও হয়তো একই আছে।
করোনা ভাইরাসের তা-বে পৃথিবীর সব দেশের অর্থনীতিই কমবেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বাংলাদেশও এই ধাক্কা থেকে মুক্ত থাকতে পারেনি। তবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা করোনা মোকাবিলায় কিছু সাহসী সিদ্ধান্ত নিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে সক্ষম হয়েছেন। বাংলাদেশ করোনা ভাইরাস মোকাবিলায় দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে প্রথম এবং বিশ্বে ২০তম দেশ হিসেবে সফল হয়েছে। শুধু তাই নয়, এই করোনা ভাইরাসের মধ্যেও অর্থনীতির চাকা থেমে থাকেনি। অনেকে বিরোধিতা ও সমালোচনা করলেও কঠোর লকডাউনের পথে না হেঁটে পোশাকশিল্প সচল রাখার পক্ষে থেকে ভালো করেছে সরকার। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা করোনা ভাইরাসের ভয়ে সবকিছু অচল করে না দিয়ে যে ঠিক করেছিলেন, এখন তা অন্যরা বুঝতে পারছেন। কথা বলা যতটা সহজ, কাজ করা ততটা সহজ নয়। শেখ হাসিনা কাজে বিশ্বাসী।
করোনা মোকাবিলায় বাংলাদেশের ভূমিকা নিয়ে অনেকে নানা মন্তব্য করেছেন। এমনকি করোনা ভাইরাস ছড়ালে দেশে দুর্ভিক্ষ তৈরি হবে। এ দেশ আর মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারবে না। কিন্তু বাস্তবে ঠিক উল্টো ঘটনা ঘটছে। বিশ্বের উন্নত দেশগুলো যখন করোনা ভাইরাস মোকাবিলায় হিমশিম খাচ্ছে, তখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দক্ষ নেতৃত্বে বাংলাদেশ মুখ থুবড়ে পড়েনি।
করোনা সংকটের মধ্যে রেমিট্যান্স যোদ্ধারা কষ্ট করে অর্থ পাঠিয়ে দেশের অর্থনীতিকে গতিশীল রেখেছেন। বাংলাদেশের ইতিহাসে এযাবৎকালের মধ্যে সর্বোচ্চ বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ হয়েছে। বাংলাদেশ এখন যে ধরনের অর্থনৈতিক বিকাশের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে তা অব্যাহত থাকলে ২০৩৫ সাল নাগাদ দেশটি হবে বিশ্বের ২৫তম বৃহৎ অর্থনীতি। ব্রিটেনের অর্থনৈতিক গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর ইকোনমিক্স অ্যান্ড বিজনেস রিসার্চ তাদের সর্বশেষ এক রিপোর্টে এই পূর্বাভাস দিয়েছে।
করোনাকালে বিপুলসংখ্যক মানুষের আয়-উপার্জন কমেছে। কিন্তু জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছে। কিছু কিছু নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম কারণ কিংবা অকারণেও বেড়েছে। সাধারণ মানুষের জীবনের কষ্ট লাঘবে সরকার ততটা তৎপর বলে মনে হয়নি। দুর্নীতি কমেনি।
যে কোনো চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে এগিয়ে যাওয়ার সক্ষমতা বাংলাদেশ অর্জন করেছে। সুস্থধারার ইতিবাচক রাজনীতির চর্চা বাড়লে, প্রতিহিংসার পথ পরিহার করে রাজনৈতিক দলগুলো দেশের সমৃদ্ধি এবং সাধারণ মানুষের কল্যাণচিন্তাকে অগ্রাধিকার দিলে ২০২২ সাল বাংলাদেশের জন্য আরও বেশি আশাসঞ্চারী হয়ে উঠতে পারে। ২০২১ সালে যা সব অনার্জিত আছে নতুন বছরে সেসব পাওয়ার প্রত্যাশা অবশ্যই থাকবে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের সোনার বাংলার স্বপ্ন যেন আর দীর্ঘকাল অপূর্ণ না থাকে সেই অঙ্গীকারই আমাদের করা দরকার।
বিভুরঞ্জন সরকার : জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক