করোনা সংকট কাটিয়ে উঠে স্বস্তিদায়ক জায়গায় পৌঁছেছে দেশের অর্থনীতিতে বড় ভূমিকা রাখা রপ্তানি খাত। বছরজুড়েই সন্তোষজনকভাবে এগিয়েছে রপ্তানি আয়। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্যমতে, চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসেই ১ হাজার ৯৭৯ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছে। যা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ২৪ দশমিক ২৯ শতাংশ বেশি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ায় বিদেশে পোশাক সহ অন্যান্য রপ্তানি পণ্যের চাহিদা বৃদ্ধির ফলে রপ্তানি আয় বেড়েছে। অন্যদিকে, বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের আরেক গুরুত্বপূূর্ণ খাত প্রবাসী আয়ে বিপর্যয় যেন কাটছেই না। করোনার প্রথম ধাক্কায় বিপর্যস্ত অর্থনীতিতে শক্তি জুগিয়েছিল রেমিট্যান্স। সে সময় রেকর্ড প্রবাসী আয় হলেও চলতি বছর ধারাবাহিকভাবে কমেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ হালনাগাদ তথ্যে দেখা যায়, গত দেড় বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন রেমিট্যান্স এসেছে নভেম্বর মাসে। এ মাসে এসেছে ১৫৫ কোটি ৩৭ লাখ ডলার। যা গত বছরের নভেম্বরের তুলনায় ২৫ শতাংশ কম।
ক্রমবর্ধমান রপ্তানি আয়ে চাঙ্গা হচ্ছে অর্থনীতি: দেশের অর্থনীতিতে ইতিবাচক ভূমিকা রাখছে ক্রমবর্ধমান রপ্তানি আয়। এতে করোনাকালে সংকটে পড়া অর্থনীতি ক্রমেই আরও চাঙ্গা হচ্ছে। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) সর্বশেষ হালনাগাদ প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯-২০ অর্থবছরে পণ্য রপ্তানির পরিমাণ ছিল ৩ হাজার ৩৬৭ কোটি ডলার। পরের অর্থবছরে ১৫ শতাংশেরও বেশি প্রবৃদ্ধি অর্জনের মধ্য দিয়ে রপ্তানি আয়ের পরিমাণ দাঁড়ায় ৩ হাজার ৮৭৬ কোটি ডলার। আর চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসেই ১ হাজার ৯৭৯ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছে। যা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ২৪ দশমিক ২৯ শতাংশ বেশি। এমন প্রেক্ষাপটে রপ্তানির পরিমাণ গত অর্থবছরের চেয়ে আরও ১২ দশমিক ২৫ শতাংশ বৃদ্ধির আশা করছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। সেই হিসাবে আয়ের পরিমাণ ৪ হাজার ৩৫০ কোটি ডলারের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।
ইপিবি’র প্রতিবেদনে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে পণ্য রপ্তানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১ হাজার ৭৪৭ কোটি ডলার। তবে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ১৩ দশমিক ২৭ শতাংশ রপ্তানি বেশি হয়েছে। এই পাঁচ মাসে তৈরি পোশাক ছাড়াও কৃষি প্রক্রিয়াজাত, চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য, হিমায়িত খাদ্য, হোম টেক্সটাইল, প্রকৌশল পণ্য ও হস্তশিল্প রপ্তানিও বেড়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর, অর্থনীতিবিদ ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ মনে করেন, করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ায় বিদেশে পোশাক সহ অন্যান্য রপ্তানি পণ্যের চাহিদা বেড়েছে। তিনি মানবজমিনকে বলেন, বিশেষ করে এখন শীতকালীন পোশাকের চাহিদা বেড়েছে। তাছাড়া করোনাকালে কমমূল্যের পোশাকের চাহিদাও বেড়েছে। করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ায় সব ধরনের পণ্য রপ্তানি বেড়েছে। ফলে আমাদের রপ্তানি আয় বেড়েছে।
তিনি মনে করেন, রপ্তানি বৃদ্ধি দেশের অর্থনীতির জন্য নিঃসন্দেহে ইতিবাচক দিক। তবে, রপ্তানি বহুমুখীকরণ করতে হবে। শুধু আরএমজি’র ওপর নির্ভর করলে চলবে না বলেও মত দেন তিনি।
রপ্তানি আয়ের যে প্রবণতা তাতে চলতি অর্থবছর লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা দেখছেন সংশ্লিষ্টরা। তবে করোনাভাইরাসের নতুন ধরন ওমিক্রনের কারণে শঙ্কায় রয়েছেন তারা। তবে ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, বর্তমানে করোনা পরিস্থিতি যেমন আছে, এভাবে থাকলে তেমন প্রভাব পড়বে না। তবে যদি সংক্রমণ বৃদ্ধি পায় তখন আবার প্রভাব পড়তে পারে।
প্রবাসী আয় কমেছে কেন?
করোনা সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতির ভেতরেও রেমিট্যান্সের উল্লম্ফন ছিল। অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে ২ হাজার ৪৭৮ কোটি ডলার রেমিট্যান্স এসেছিল ২০২০-২১ অর্থবছরে। যা তার আগের অর্থবছরের চেয়ে ৩৬ দশমিক ১০ শতাংশ বেশি ছিল। তবে, চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের শুরু থেকেই ধারাবাহিকভাবে রেমিট্যান্স প্রবাহ কমেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রকাশিত সর্বশেষ প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, চলতি অর্থবছরে নভেম্বরে ব্যাংকিং চ্যানেলে প্রবাসী আয় এসেছে ১৫৫ কোটি ৩৭ লাখ ডলার। যা গত বছরের নভেম্বরের চেয়ে ২৫ শতাংশ বা ৫২ কোটি ৫০ লাখ টাকা কম। গত বছরের নভেম্বরে রেমিট্যান্স এসেছিল ২০৭ কোটি ৮৭ লাখ ডলার। নভেম্বর মাসের রেমিট্যান্সের এই পরিমাণ গত ১৮ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন। এর আগে ২০২০ সালের মে মাসে দেশে সর্বনিম্ন ১৫০ কোটি ডলার রেমিট্যান্স আসে।
অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন, করোনাকালে প্রবাসীদের আয় কমে যাওয়াসহ বেশকিছু কারণে রেমিট্যান্স প্রবাহ কমেছে। তারা বলেছেন, করোনা পরিস্থিতি উন্নতি হওয়ায় ফের হুন্ডি প্রবণতা বেড়েছে। এতে ব্যাংকিং চ্যানেলে প্রবাসী আয় কমে গেছে। এ ছাড়া করোনাকালে কাজ হারিয়ে দেশে ফেরত আসা প্রবাসীরা পুনরায় ফিরতে না পারা, করোনা ভ্যাকসিন ও কোভিড টেস্ট জটিলতা এবং ভিসা ও ফ্লাইট খরচ বেড়ে যাওয়ার ফলে নতুন করে মাইগ্রেট না হওয়া; এসব কারণে রেমিট্যান্সের প্রবাহ কমে গেছে।
এ বিষয়ে অর্থনীতিবিদ ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, রেমিট্যান্স কমার কারণ হলো- করোনার সময়ে অনেক প্রবাসী ফেরত চলে আসছে। তারপর নতুন করে আর লোক যাচ্ছে না। আর যারা আছে তাদেরও অন্যান্য দেশের তুলনায় অ্যাক্টিভিটি তেমন বাড়েনি। তাদের ইনকামও তেমন হচ্ছে না। তাই তারা হয়তো দেশে টাকা পাঠাচ্ছে না। এখন রেমিট্যান্স আয় বাড়াতে হলে আমাদের দক্ষ লোকবল পাঠাতে হবে। এদিক থেকে কিন্তু আমরা খুব স্লো।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ও বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সানেমের গবেষণা পরিচালক ড. সায়মা হক বিদিশা মানবজমিনকে বলেন, করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার পর হুন্ডির মাধ্যমে টাকা আসা শুরু হয়েছে। অর্থাৎ বৈধ পথে আসাটা কমে গেছে। তাই রেমিট্যান্স প্রবাহ কমে গেছে। এ ছাড়া যারা করোনাকালে দেশে ফিরে এসেছেন, তাদের অনেকেই নানা জটিলতার কারণে পুনরায় কাজে ফিরতে পারেননি। আবার এমনও ছিল যারা করোনার আগে বিদেশে যাবেন। তারাও আটকে পড়েছিল। তাদের অনেকেই এখনো যেতে পারেননি। এসব কারণে প্রবাসী আয় কমে গেছে।