আল্লাহতায়ালা বলেন, (হে নবি!) এ অন্য নবি-রাসূলদের বৃত্তান্ত, যা আমি তোমাকে শোনাচ্ছি, এসব এমন জিনিস যার মাধ্যমে আমি তোমার হৃদয়কে মজবুত করি। এ সবের মধ্যে তুমি পেয়েছ সত্যের জ্ঞান এবং ইমানদাররা পেয়েছে উপদেশ ও জাগরণবাণী (সূরা হুদ, আয়াত ১২০)।
কুরআনে আল্লাহতায়ালা বিভিন্ন কাহিনি বর্ণনা করেছেন, যেন আমরা সেসব থেকে জীবন পরিচালনার নির্দেশনা পাই, আমরা যেন হেদায়েতের পথে চলি এবং পূর্ববর্তী নবি-রাসূল ও সৎকর্মশীল মহামানবদের দেখানো পথে চলে কামিয়াবি হাসিল করতে পারি।
আফসোস, আমরা সেসবকে স্রেফ মজার কাহিনি ভাবি, তার উদ্দেশ্য না খুঁজে কেবল বিনোদন নিই, ফলে আমরা প্রকৃত উপকার পাই না। সেসব কাহিনিতে আমাদের জন্য যে অফুরান শিক্ষার জোগান রয়েছে, আমরা যদি তা খুঁজে বের করে আমাদের জীবনে কার্যত বাস্তবায়ন করতাম, তাহলে পৃথিবীর সবচেয়ে মহান জাতিতে উন্নীত হতে পারতাম। এ বিষয়টি মুসলমানদের প্রথম প্রজন্ম বুঝতে পেরেছিল, তাই তারা বিশ্বব্যাপী কুরআনের আলো ছড়িয়ে দিতে সক্ষম হয়েছিল।
হজরত ইউসুফ (আ.)-এর কাহিনিকে কেবল একটি চিত্তাকর্ষক প্রেমের কাহিনি ভাবা হয়, অথচ আল্লাহপাক কুরআনে একে ‘সর্বোত্তম কাহিনি’ বলেছেন।
এ কাহিনিতে ইউসুফ (আ.)-এর সঙ্গে আল্লাহর রাসূল (সা.)-এর কষ্ট ও ত্যাগকে রূপক হিসাবে উপস্থাপন করা হয়েছে এবং ভবিষ্যদ্বাণী দেওয়া হয়েছে। যেমন- আল্লাহর রাসূল (সা.)-কে তার ভাইয়েরা জন্মভূমি থেকে বের করে দেবে, তারপর অন্যত্রে গিয়ে তিনি সফল হবেন। এরপর আল্লাহর রাসূল (সা.)-এর ভাইয়েরা (কুরাইশ) সেখানে গিয়ে তার কাছে মাফ চাইবে, তিনি মাফ করে দেবেন। এ রকম অনেক কিছু।
এসব ছাড়াও এ কাহিনিতে এ রকম চরিত্রবান হওয়ার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে, যার বদৌলতে একজন গোলাম শাসকশ্রেণির পর্যায়ে উন্নীত হতে পারে। হজরত ইউসুফ (আ.) একজন ক্রীতদাস হয়ে মিসরে প্রবেশ করেছিলেন, আজিজে মিসর তাকে কিনে নেন।
এটি ছিল তার প্রাথমিক পর্যায়, এখান থেকে মন্ত্রণালয়ের পদাধিকারী হতে যেই চারিত্রিক শক্তিমত্তার প্রয়োজন, তা তার ছিল। কুরআনের ভাষ্যমতে তার চরিত্রে কী কী ছিল?
তার চরিত্রে ছিল-১. আবেগের ওপর নিয়ন্ত্রণ। ২. আমানতদারিতা। ৩. যে কোনো পরিস্থিতিতে মূলনীতির ওপর সঠিক কর্মপন্থায় কাজ চালিয়ে যাওয়ার সৎসাহস, তার জন্য যতরকমের কষ্ট-মুসিবত সইতে হয় তা সওয়া। ৪. নিজের কাজ চালিয়ে যাওয়া। ৫. দুশ্চিন্তায় ঘাবড়ে গিয়ে কাজ বন্ধ করে না দেওয়া।
হজরত ইউসুফ (আ.)-এর কাহিনি থেকে আমরা এ শিক্ষাগুলোই পাই। জোলায়খার সঙ্গে তার যে ঘটনা ঘটেছে, সেখানে তিনি আবেগকে নিয়ন্ত্রণে রেখেছিলেন এবং মনিবের আমানতদারিতা রক্ষা করে সমগ্র মানবজাতির জন্য দৃষ্টান্ত পেশ করেছিলেন। জোলায়খা বলেছিলেন-তাকে যে কাজ করতে বলছি তা যদি না করে, তাহলে অবশ্যই তাকে কারাবন্দি করা হবে এবং অবশ্যই তাকে বেইজ্জত করা হবে। (সূরা ইউসুফ, আয়াত ৩২)।
কিন্তু ইউসুফ (আ.) তার উত্তরে কী বললেন? তিনি বললেন, ‘হে আমার রব! এরা আমাকে দিয়ে যে কাজ করাতে চাচ্ছে তার চেয়ে কারাগারই আমার কাছে প্রিয়! (সূরা ইউসুফ, আয়াত ৩৩)।
সঠিক মূলনীতিতে কাজের বিপরীতে তিনি বিনা অপরাধে কারাবাসের মুসিবতবরণ করাকে তিনি পছন্দ করলেন। তারপর তাকে যখন জেলখানায় বন্দি করা হলো, তিনি সেখানেই দাওয়াতি কার্যক্রম শুরু করে দিলেন।
সহবন্দিদের উদ্দেশে তিনি বললেন-আল্লাহর সঙ্গে কাউকে শরিক করা আমাদের কাজ নয়।… সাথীগণ! তোমরা নিজেরাই ভেবে দেখো, ভিন্ন ভিন্ন বহুসংখ্যক রব ভালো, না এক আল্লাহ, যিনি সবার ওপর বিজয়ী।… শাসন কর্তৃত্ব একমাত্র আল্লাহর। তার হুকুম তোমরা তাকে ছাড়া আর কারোর ইবাদত করবে না। এটিই সরল সঠিক জীবন পদ্ধতি। নিজের উদ্দেশ্য ত্যাগ না করতে এবং যে কোনো পরিস্থিতিতে কাজ চালিয়ে যাওয়ার জন্য স্বাধীনতা জরুরি নয়, বরং সর্বাবস্থায় সামনে এগিয়ে যেতে হয়। এ কারণেই তিনি গোলামির জীবন থেকে মুক্ত হয়ে রাষ্ট্রীয় পদাধিকারী হন। এই কাহিনি এ মহান শিক্ষাই দেয়।
অনুবাদ : মওলবি আশরাফ