দেশে বেকার সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করেছে। সন্তোষজনক চাকরি পাওয়া নিয়ে উচ্চশিক্ষিত তরুণদের মধ্যে হতাশা বাড়ছে। দেশে সরকারি খাতে কর্মসংস্থানের সুযোগ সীমিত। বেসরকারি খাত কাক্সিক্ষত মানে বাড়ছে না। তাই কর্মসংস্থানের সুযোগও বাড়ছে না। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সাম্প্রতিক এক তথ্যে দেখা যাচ্ছে, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়র অধীন স্নাতকোত্তীর্ণ ৬৬ শতাংশ শিক্ষার্থী বেকার থাকছেন।
মূলত তিনটি কারণে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা বেড়ে চলেছে। প্রথমত, চাকরির বাজারের চাহিদা ও সরবরাহের মধ্যে বড় ধরনের সমন্বয়হীনতা। চাকরির বাজারে যে ধরনের লোকের চাহিদা রয়েছে আমরা সে ধরনের লোক তৈরি করতে পারছি না। আবার প্রতি বছর যেসব শিক্ষিত লোক চাকরির বাজারে যুক্ত হচ্ছে, তাদের উপযোগী চাকরি নেই। গত ১০ বছরে দেশে স্নাতক পাস শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ। কারণ, দেশে সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা বাড়ছে। ১০ বছর আগেও বছরে দুুই থেকে আড়াই লাখ শিক্ষার্থী স্নাতক বা স্নাতকোত্তর পাস করে চাকরির বাজারে যুক্ত হতেন।
এখন সেই সংখ্যা বেড়ে চার-পাঁচ লাখে উন্নীত হয়েছে। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) উপাত্ত মতে, বাংলাদেশে শ্রমশক্তি বছরে গড়ে ২ শতাংশ হারে বাড়ছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ শ্রমশক্তি জরিপ অনুযায়ী, দেশে কর্মক্ষম ২৬ লাখ ৩০ হাজার মানুষ বেকার। এর মধ্যে পুরুষ ১৪ লাখ, নারী ১২ লাখ ৩০ হাজার, যা মোট শ্রমশক্তির সাড়ে ৪ শতাংশ।
এ প্রসঙ্গে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুরের অভিমত, প্রকৃত বেকার আরো বেশি। যেখানে যুক্তরাষ্ট্রে ৫ শতাংশের বেশি বেকার, সেখানে বাংলাদেশে ৪ শতাংশ বলা হচ্ছে। এটি গ্রহণযোগ্য নয়। তার অভিমত, বর্তমান চাকরির বাজারের চাহিদার সাথে শিক্ষাব্যবস্থা সঙ্গতিপূর্ণ না হওয়ায় শিক্ষিত বেকার বেড়েই চলেছে। এ দিকে বিশ্ব ব্যাংক মনে করে, সরকার কমিয়ে দেখালেও প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশে বেকারত্বের হার ১৪ দশমিক ৪ শতাংশ। এর ওপর প্রতি বছর নতুন করে ১৩ লাখ মানুষ শ্রমবাজারে যোগ হচ্ছে। সুতরাং নতুন করে কর্মসংস্থান তৈরির চাপ রয়েছে অর্থনীতির ওপর। সংস্থাটির মতে, বাংলাদেশে কর্মসংস্থানের হার ২ শতাংশ বাড়ানো গেলে প্রবৃদ্ধির হার ৮ শতাংশে উন্নীত হবে।
জাতীয় সংসদেও বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়েছে। সেখানে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর জরিপের তথ্য দিয়ে বলা হয়, দেশে বেকারের সংখ্যা তিন কোটি ৩৯ লাখ ৮৭ হাজার। এর মধ্যে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা ১৯ লাখ ৫১ হাজার। সংসদ সদস্য বীরেন শিকদার প্রশ্ন তোলেন, এর দায় কার? আমাদের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে বেশির ভাগ শিক্ষিত চাকরিপ্রার্থী শহর এলাকায় শোভন কাজ করতে চান। কিন্তু শহরে সে পরিমাণ চাকরির সুযোগ তৈরি হচ্ছে না। দ্বিতীয়ত, দেশে বর্তমানে চাকরির সুযোগ বাড়ছে উৎপাদশীল ও কৃষি খাতে। দুটি ভাগে আবার স্নাতক বা স্নাতকোত্তর পাস তরুণদের কাজের সুযোগ কম। এ দুটি খাতে কারিগরিভাবে দক্ষ লোকের চাহিদা বেশি। শিক্ষিত যেসব যুবক চাকরির বাজারে রয়েছেন, তারা এসব কাজে উৎসাহী নয়। একটি দৈনিকের খবরে বলা হয়, ‘কাজের বাজারের চাহিদার সঙ্গে শিক্ষাব্যবস্থা সঙ্গতিপূর্ণ না হওয়ায় দেশে শিক্ষিত বেকার সংখ্যা বেড়ে চলেছে। প্রতি বছর উচ্চশিক্ষা নিয়ে বাজারে আসা শিক্ষার্থীদের অর্ধেক বেকার থাকছেন অথবা যোগ্যতা অনুযায়ী চাকরি পাচ্ছেন না।’ (প্রথম আলো, ২ মার্চ ২০২১)
করোনার তাণ্ডবে বিশ্বব্যাপী মানুষেরা আতঙ্কিত।
বিশ্ব অর্থনীতি আজ বৈশ্বিক মন্দার দ্বারপ্রান্তে। অনেকে বলছেন, করোনার ফলে বিশ্ব অর্থনীতির যে মন্দাভাব চলছে, তা অতীতের যেকোনো মন্দার চেয়ে কঠিন হবে। বিশ্বব্যাংকের গ্লোবাল ইকোনমিকস প্রসপেক্টাসের ভাষ্যমতে, ৮০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বড় মন্দায় পড়তে যাচ্ছে বিশ্ব। করোনার প্রভাবে নিম্নমুখী বাণিজ্যের ফলে বিশ্বের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ক্রমাগত ক্ষতিতে পড়ছে। সঙ্গত কারণে ক্ষতি পুষিয়ে নেয়া এবং টিকে থাকার জন্য কর্মী ছাঁটাইয়ের সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। ফলে নতুন করে কর্মক্ষম মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়ছে। করোনার কারণে ব্যবসা বাণিজ্যও দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। যেসব শিক্ষিত যুবক ছোটখাটো ব্যবসার মাধ্যমে স্বকর্মসংস্থানে যুক্ত ছিলেন তারাও বেকার হয়েছেন। এসব ছোট ছোট উদ্যোক্তার হাতে সরকারি অর্থও খুব একটা পৌঁছায়নি। বাধ্য হয়ে অনেকে ব্যবসা বন্ধ করে দিয়েছেন। এতেও শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা বেড়ে গেছে। দেশে শিক্ষিত বেকার বেড়ে যাওয়ার আরেক কারণ সরকারি চাকরিতে যেভাবে সুযোগ-সুবিধা বাড়ানো হয়েছে, বেসরকারি খাত সেই তুলনায় পিছিয়ে। মেধাবী শিক্ষিত তরুণেরা বেসরকারি চাকরির বদলে সরকারি চাকরিতে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন। সরকারি চাকরির প্রস্তুতি নেয়ার জন্যও অনেকে অন্য চাকরিতে যোগ দেন না। বিবিএসের জরিপে জানা যায়, দেশে উচ্চশিক্ষিত বেকার বিপুল। সরকারি খাতের চাকরির বেতন বেড়েছে বলে তরুণরা হন্যে হয়ে সরকারি চাকরির পেছনে ছুটছেন।
অথচ সরকারি চাকরি সীমিত, সবাই তা পাবেন না। সরকার অধিক সংখ্যায় চাকরির সুযোগ তৈরি করতে পারছে না। অথচ নাগরিকদের কর্মসংস্থান নিশ্চিত করা রাষ্ট্রেরই দায়িত্ব; কিন্তু আমরা এই সেটি ভুলতে বসেছি। রাষ্ট্র সবাইকে চাকরি দেবে ব্যাপারটা এমন নয়, তবে সবাই যাতে কাজ পান সেটি নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। আমাদের দেশে সবচেয়ে বড় সমস্যা সুশাসনের অভাব। সুশাসন না থাকায় কাক্সিক্ষত হারে বিনিয়োগ বাড়ছে না। অন্য দিকে এ কারণেই বিদেশী বিনিয়োগ আসার অনেক সম্ভাবনা থাকার পরও তা আসছে না।
সুশাসন নিশ্চিত করার মাধ্যমে সরকার যদি বিনিয়োগ বাড়ার পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারে, তাহলে বেকার সমস্যা অনেকটাই দূর হবে। এটাই এখন সবচেয়ে বেশি জরুরি। কারণ বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ কাক্সিক্ষত হারে বাড়ছে না।
সেই সাথে আমাদের মধ্যবিত্তের মানসিকতাও পাল্টানো জরুরি। শুধু চাকরি করা নয়, নিজেদেরই উদ্যোগী হওয়ার মানসিকতা থাকতে হবে। উদ্যোক্তা হওয়া বেশ কঠিন। তবে দেশে এখন ব্যাংক ঋণ থেকে শুরু করে অবকাঠামো ও উপকরণগত সুবিধা অনেকটা সুলভ হয়েছে। তরুণদের সে সুযোগ নেয়া উচিত। বড় শিল্পে সব মানুষের কর্মসংস্থান নিশ্চিত হবে না। গ্রামগঞ্জে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে পারে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প। জার্মানির মতো উন্নত দেশও এখন মাঝারি উদ্যোগের ওপর জোর দিচ্ছে। আমাদেরও সেই পথে এগোনো দরকার।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট