সোমবার, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ০৫:১৩ পূর্বাহ্ন

মার্কিনি জরিপ এবং তার ফল

ড. মাহবুব হাসান
  • আপডেট টাইম : শনিবার, ৮ জানুয়ারী, ২০২২
  • ১২৯ বার

রাজনৈতিক সহিংসতা কখনো কখনো ন্যায়সঙ্গত হতে পারে বলে মনে করে মার্কিনি জনগণের একটি অংশ। আবার দুই-তৃতীয়াংশ মানুষ মনে করে যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্র হুমকির সম্মুখীন। যুক্তরাষ্ট্রে ক্রমবর্ধমান রাজনৈতিক সহিংসতার পেছনে ক্যাপিটল হিলে (কংগ্রেস ভবন) হামলার ঘটনা অগ্রণী ভ‚মিকা পালন করছে। ২০২১-এর ৬ জানুয়ারি, ক্যাপিটল হিলে হামলা চালায় ট্রাম্প সমর্থক উগ্রপন্থী রিপাবলিকানরা। তারা মনে করে, জো বাইডেন আমেরিকার অবৈধ প্রেসিডেন্ট। ট্রাম্প হেরে গেছেন, এই সত্য তিনি এবং তার হোয়াইট সুপ্রিম চেতনায় উজ্জীবিত বর্ণবাদীরা মনে করেন না। ট্রাম্প সে কথা বারবারই বলেছেন। নির্বাচনে জালিয়াতির ভুয়া অভিযোগ তুলে পরাজয় মেনে নিতে অস্বীকার করেন এবং নির্বাচনী ফলাফলের সত্যায়ন ঠেকাতে নানা অপকৌশল অবলম্বন করেন তিনি। তার এই সব অরাজনৈতিক ও বর্ণবাদী উসকানির ফলেই যে ক্যাপিটল হিলে উগ্র সমর্থকরা আক্রমণ চালায়, তা কি অস্বীকার করার জো আছে?

তিনি এখনো সেই ধরণাই পোষণ করেন যে, তিনি হেরে যাননি। তিনি ২০ জানুয়ারিতে জো বাইডেনের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর না করেই ফ্লোরিডায় তার বাড়িতে চলে যান। ক্ষমতা হস্তান্তর করেছেন ট্রাম্পের ভাইস প্রেসিডেন্ট পেন্স। তাদের মনের ভেতরে যে রোষ জ্বলছে, বর্ণবাদ তারই অন্য নাম। হোয়াইট মানুষের (একটি অংশের) মনে এই রকম প্রিমিটিভ বর্ণবাদের আগুন জ্বলতে থাকলে মানবসভ্যতার মৌলিক যে চেতনা, তার অনেকটাই অমানবিকতা ও অযৌক্তিকতার নহরে প্রবাহিত হবে, যার সূচনা আমরা দেখতে পাচ্ছি। ক্যাপিটল হিলে আক্রমণ চালানোর দায় ট্রাম্প অস্বীকার করলেও বাস্তবতা এটাই প্রমাণ করে যে, তিনিই ওই মনোদর্শনের পেছনে অপশক্তি জুগিয়েছিলেন। তার রাজনৈতিক অসহিষ্ণু আচরণ ও কথা বর্ণবাদীদের মনে অনল জ্বালিয়ে দিয়েছিল। মনে করা যেতে পারে, আমেরিকান রাজনীতিতে যে সহনশীলতা ও গণতন্ত্রের মিলিত সৌন্দর্য সৃষ্টি হয়েছিল, সেখানে ঘা হয়েছে। সেটা পেপটিক আলসারের মতোই ঘা এবং সেই ঘা ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকলে তা আমেরিকান গণতন্ত্রের জন্য শুভ হবে না। বোধকরি এ কারণেই মার্কিনিদের মধ্যে পরিচালিত জরিপে উঠে এসেছে সহিংসতার ভয়, রাজনৈতিক গণতন্ত্রের পরাজয়ের বোধ।

ওয়াশিংটন পোস্ট ও মেরিল্যান্ড ইউনিভার্সিটি একটি এবং সিবিএস আরেকটি জরিপে বলছে, ৬ জানুয়ারিতে ক্যাপিটল হিলে যৌথ অধিবেশন পণ্ড করতেই উগ্র রিপাবলিকানরা সেখানে হামলা চালায়। পেছনে ট্রাম্পের মদদ ছিল। জো বাইডেন গণতন্ত্রের ক্ষত সারিয়ে তোলার পাশাপাশি রাজনৈতিক বিভেদ দূর করারও প্রতিশ্রæতি দেন। কিন্তু এক বছর পরও দেখা যাচ্ছে মার্কিনিদের মনে উদ্বেগ রয়ে গেছে এবং আগামী নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্পের মতো এমন ভুঁইফোঁড় রিপাবলিকানকেই প্রতিদ্ব›িদ্বতায় নিয়ে আসতে চাইছে। সেটা হতেই পারে। তবে, এটা মনে রাখতে হবে যে, বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর অন্তরে যদি বর্ণবাদ উসকে দিতে পারেন ট্রাম্প, যা ইতোমধ্যেই গ্রামীণ ও কম শিক্ষিত লোকদের মধ্যে চালিয়ে দিয়ে নিজের বিজয় অর্জন করেছিলেন ২০১৬ সালে, তিনি হয়তো ফিরে আসতে চাইবেন ক্ষমতার সিংহাসনে, কিন্তু তাতে ক্ষতি হবে গণতন্ত্রের এবং আমেরিকান রাজনীতির প্যাটার্নিক সৌন্দর্যের। মার্কিনি গণতন্ত্রের সৌন্দর্য যেমনটাই হোক আমাদের মতো বাইরের দেশের মানুষের কাছে, মার্কিনিদের মানসিক ও সাংস্কৃতিক চেতনায় তা প্রতিষ্ঠিত রূপ লাভ করেছে। ভোটার জনগণ যে সরাসরি রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে ভোট দিচ্ছে, তা ভায়া হয়ে যাচ্ছে ইলেক্টোরাল কলেজ নামক নির্বাচনী বিধানে। সেই ইলেক্টোরাল কলেজ যদিও তাদের প্রার্থীকেই ভোটটি দেয়, ব্যতিক্রমও আছে, দু’বার, তাদের কয়েকজন বিরোধী প্রেসিডেন্ট প্রার্থীকে ভোট দিয়ে বিজয়ী করেছিল। স্টেট থেকে নির্বাচনী ফলাফল আসতে হয় সত্যায়িত হয়ে। সেখানেই হাত চালিয়ে বাইডেনের বিজয় ঠেকাতে চেয়েছিলেন রিপাবলিকান ক্ষমতাসীনদের মাধ্যমে। তবে, ট্রাম্প তাতে ব্যর্থ হয়েছিলেন সেই সব রিপাবলিকানের সততার কারণে। তারা দলীয়ভাবে অনুগত হলেও আইনের প্রতি তাদের রয়েছে অনন্যসাধারণ প্রেরণা ও ন্যায়বোধ। বিচার বিভাগেও বিচারপতি নিয়োগ পায় দলের প্রতি অনুগত আইনের লোকেরাই, কিন্তু বিচারের ক্ষেত্রে তারা দলের অন্ধ আনুগত্য পরিহার করেন। এগুলোই, অনেকাংশে আমেরিকান গণতন্ত্রকে এমন একটি ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত করেছে যে, তাকে সহজে কাবু করা কঠিন। সে কারণেই জো বাইডেন অপশক্তির বিরুদ্ধে বিজয়ী হয়েছেন।

ওয়াশিংটন পোস্ট ও মেরিল্যান্ড ইউনিভার্সিটির জরিপে উঠে এসেছে, আগের চেয়ে অনেক কম মানুষ এখন গণতন্ত্র নিয়ে গর্ব করে। ২০০২ সালে গণতন্ত্র নিয়ে গর্বিত মানুষ ছিল ৯০ শতাংশ, এখন ৫৪ শতাংশে তা নেমে এসেছে। ৬০ শতাংশ মানুষ মনে করে, ক্যাপিটল হিলে হামলার ঘটনায় ট্রাম্পের দায় ব্যাপকভাবে রয়েছে। আর ওয়াশিংটন পোস্টের জরিপে ট্রাম্প সমর্থকদের ৮৩ শতাংশই মনে করে, ওই ঘটনায় তার দায় সামান্য বা নেই। সিবিএসের জরিপে দেখা যাচ্ছে, ২৬ শতাংশ চায় ২০২৪ সালের নির্বাচনে ট্রাম্প প্রতিদ্ব›িদ্বতায় আসুক।

ওই ২৬ শতাংশ আমেরিকান তাই লালন করেন ডোনাল্ড ট্রাম্পের রাজনৈতিক চরিত্র এবং তার রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি। অর্থাৎ ওই ২৬ শতাংশ মানুষ উগ্রবাদের সমর্থক। তাদের অনেকেই চায় সরকারের পক্ষে জোর চালানো ন্যায়সঙ্গত, তা অবৈধ কি বৈধ তা বিবেচনায় নেয় না তারা।

সিবিএসের জরিপ অনুযায়ী, ২৮ শতাংশ মনে করে নির্বাচনী ফলাফল অটুট রাখতে শক্তি প্রয়োগ করা যেতে পারে। এখানে ব্যাখ্যা প্রয়োজন এ জন্য যে, নির্বাচনী ফল বলতে কী বুঝিয়েছেন? পেনস্টেট বা পেনসিলভানিয়ায় ভোট হাতে গুনতে হয়েছে ট্রাম্পের জেদের ফলে। তাতে ১৫ দিন সময় লেগেছে। আরো কয়েকটি স্টেটেও ভোট পুনরায় গণনা হয়েছে। এসব ক্ষেত্রে সরকারি বলপ্রয়োগের কথা বলা হয়েছে। বিষয়টি পরিষ্কার হলো না। তখন পর্যন্ত ক্ষমতায় ছিলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। তিনি চেষ্টা করেছিলেন আটটি স্টেটের ভোটের ফলাফল যাতে তার পক্ষে দেয়, তা নিয়ে রিপাবলিকান স্টেট নেতাদের ওপর জোর চালিয়েছিলেন। কিন্তু তারা রিপাবলিকান হলেও আইনের প্রতি, বিধিবিধানের প্রতি অটল ছিলেন। তারা ট্রাম্পের অবৈধ প্রত্যাশা ফিরিয়ে দিয়েছিলেন।

জরিপের যারা, সরকারের উচিত ছিল নির্বাচনী ফল অটুট রাখতে বলপ্রয়োগের কথা, তারা ট্রাম্পের দাবিকেই সমর্থন করছে। এর ভেতর দিয়ে ওই সব জরিপে অংশগ্রহণকারীদের মন-মানসিকতা পরিষ্কার হয়ে আসে। তারা ন্যায়কে জোর দিয়ে ঠেকাতে চায়। সরকারের বিরুদ্ধে সহিংস পদক্ষেপ কখনো কখনো ন্যায়সঙ্গত হতে পারে বলে মনে করে ৩৪ শতাংশ। এ তথ্য উঠে এসেছে জরিপে। সহিংসতার পক্ষে এমন মত বহুকাল পর আমেরিকানরা দেখছে। অর্থাৎ আমেরিকান ভোটারদের মধ্যে রাজনৈতিক সচেতনার চেয়ে রাজনৈতিক দলবাজি ও ক্ষমতার রাজনীতির অন্ধ গলিতে ঢুকে পড়ার চেহারাই দেখা যাচ্ছে। যারা আমেরিকান গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ খারাপ ভাবছেন, তারা কেবল গণতন্ত্রের প্রতিই অনুরক্ত নন, তারা মার্কিনি সমাজ কাঠামোর ব্যাপারেও দুর্ভাবনাতাড়িত। কারণ, মার্কিনি সমাজে অর্থনৈতিক বৈষম্য সৃষ্টিকারক হিসেবে সবাই জানে রিপাবলিকানদের নাম। তাদের বলা হয় বিলিয়নিয়ারদের দল বা রাজনৈতিক ক্লাব। তারা জনগণকে নানাভাবে উদ্দীপিত করে নিজেদের স্বার্থ হাসিল করে। আর ডেমোক্র্যাটদের রাজনৈতিক প্যাটার্ন হচ্ছে গরিব ও ধনীদের মধ্যকার অর্থনৈতিক ব্যবধান কমিয়ে আনা এবং সমাজে বঞ্চনার যে ধারা বহমান, তা কমিয়ে আনা। মোটা দাগে এটাই হচ্ছে রিপাবলিকান ও ডেমোক্র্যাটদের মধ্যে রাজনৈতিক দর্শন ও চেতনার পার্থক্য। মূলত রাজনীতির ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক বৈষম্য সমাজকে নানাভাবে ক্ষত ও দুর্বল করে। সামাজিক বন্ধন অটুট রাখতে হলে যে মানবিকতা অর্জন করতে হয়, তা তারা অনেক আগেই অর্জন করেছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে যদিও প্রশাসন রিজিড, তবুও তাদের সেই অবস্থান সুকঠিন নয়। বিশেষভাবে বলা যেতে পারে, অভিবাসী প্রত্যাশীদের বিষয়টি। আর অবৈধভাবে যারা আমেরিকায় বাস করছেন, কাজ করছেন, পরিবার পরিজন নিয়ে কাজ করছেন, কিন্তু তারা আয়কর দিচ্ছেন না। বলা যেতে পারে তারা অবৈধ বলেই পারছেন না। তাদের বৈধ করে নিলে, তাদের সংখ্যা বলা হয় এক কোটি ৩০ লাখের মতো। এরা অড-জবের সাথে জড়িত এবং আমেরিকান সোসাইটির নিম্ন আয়ের জনজীবনের জন্য সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করছে। শ্রমভিত্তিক সেসব কাজে তাদের ঠকানো হচ্ছে, এই সত্য সরকার ও তার প্রশাসন জানে, কিন্তু ওই অমানবিকতা দূর করতে রাজনীতিকরা একমত হতে পারেন না। এখানেই মূলত নিহিত আমেরিকান রাজনীতির দুর্বলতা। মানবিক পৃথিবী গড়ে তুলে ইতিহাস রচনার অনেক নজির তারা দিতে পারবেন, তবে এমন অনেক সন্দেহমূলক কাজের অভিযোগে অনেক বিদেশী মানুষের বিরুদ্ধে সহিংসতারও বহু উদাহরণ তারা সৃষ্টি করেছেন, যা তাদের রাজনীতি ও প্রশাসনের ক্রুরতাকেই প্রকাশ করেছে। আর এখানেই আমেরিকান গণতন্ত্রের জন্য সবচেয়ে বড় ভয়। কারণ, গণতন্ত্র ও তার মানবিকতায় যে মানবতা ও সৌন্দর্য আছে, তা এখানে এসে তার মাথা নোয়ায়। ট্রাম্পের মতো বর্ণবাদী ও হোয়াইট সুপ্রিমেসিস্টদের যদি রাষ্ট্রক্ষমতায় আবারো বসানো হয়, তাহলে তারা মানবতাকে রাজনৈতিক হিংসাযজ্ঞের উপকরণে পরিণত করবে। এর চেয়ে ভয়াবহ আর কী হতে পারে?

গণতন্ত্র নিয়ে এমন জরিপ আমাদের দেশে হওয়া খুবই জরুরি। কারণ আমাদের গণতন্ত্র ও রাজনীতির মধ্যে সাংঘর্ষিক অবস্থান রয়েছে। আমরা গণতন্ত্রের কথা বলছি, কিন্তু গণতান্ত্রিক নর্মস মানছি না। এই মনোবৃত্তির বিষয়ে গবেষণা হতে পারে। কেন এমনটা ঘটছে? তা খুঁজে দেখা জরুরি বলে মনে করি আমরা।

নিউজটি শেয়ার করুন..

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো খবর..
© All rights reserved © 2019 bangladeshdailyonline.com
Theme Dwonload From ThemesBazar.Com