আগামী নির্বাচন কমিশন গঠনের লক্ষ্যে রাষ্ট্রপতি সব রাজনৈতিক দলের সাথে সার্চ কমিটি গঠনের বিষয়ে সংলাপ করেছেন। এই সংলাপ যে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শে হচ্ছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। সাবেক রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান সদ্য অবসরে যাওয়া প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হাসানকে প্রধান করে যে সার্চ কমিটি গঠন করেছিলেন সেই কমিটির আবিষ্কারক ছিল কাজী রকিব কমিশন। ওই কমিশনের পরিচালনায় ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে ১৫৪ জন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন। বলা হয় যে, বাকি ১৪৬ জনের পক্ষেও ভোট পড়ে মাত্র ৫ শতাংশ। কিন্তু কাজী রকিব কমিশনের নিয়োগকৃত প্রিজাইডিং ও পোলিং অফিসারগণ ভোট গণনার কারসাজিতে সেটা ৪০ শতাংশে উন্নীত করায় জনগণ অবাক হয়েছিল। তাই এই নির্বাচন ১৪ দলকে উজ্জীবিত করলেও বিরোধী দল ও জনগণ হতাশ হয়েছিল। নির্বাচনের একমাস আগে ড. শাহদীন মালিকের নেতৃত্বে বিশিষ্ট নাগরিকবৃন্দের একটি প্রতিনিধিদল রাষ্ট্রপতির সাথে সাক্ষাৎ করে দশম সংসদ নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ করতে রাষ্ট্রপতিকে ভূমিকা রাখার অনুরোধ জানিয়েছিলেন। এ ব্যাপারে সংবিধান মোতাবেক রাষ্ট্রপতি তার ক্ষমতার সীমাবদ্ধতার বিষয়টি তাদেরকে জানিয়েছিলেন বলে জানা গিয়েছিল।
অথচ নির্বাচনকালীন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আওয়ামী লীগ, জাপা, জামায়াত, ওয়ার্কার্স পাটির্র ১৪৭ জন এমপি ১৯৯৪ সালে সংসদ থেকে পদত্যাগ করে হাইকোর্টে রিটের মাধ্যমে স্পিকারকে বাধ্য করার পর মার্চ ১৯৯৬ পর্যন্ত ১৭৩ দিন হরতাল পালন শেষে সচিব মহিউদ্দিন খান আলমগীরের নেতৃত্বে সরকারি কর্মচারীরা বিদ্রোহ ঘটিয়েছিলেন। সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী পাশের মাধ্যমে নির্বাচনকালীন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের রূপরেখার যে সাংবিধানিক স্বীকৃতি দেয়া হয়েছিল তাতে অবাধ সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন নিশ্চিতে রাষ্ট্রপতির ভূমিকা রাখার ক্ষমতা থাকলেও ৩০/০৬/২০১১ তারিখে স্পিকার থাকাকালীন বর্তমান রাষ্ট্রপতির সভাপতিত্বে পাসকৃত সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীতে রাষ্ট্রপতির এই ক্ষমতা কার্টেল করে প্রধানমন্ত্রীর এখতিয়ারে ন্যস্ত করা হয়েছে। ১৪ দলের প্রধান নেতা হিসেবে প্রধানমন্ত্রীই হচ্ছেন বিরোধী দলের প্রার্থীদের মূল প্রতিদ্বন্দ্বী।
প্রথম সার্চ কমিটির আবিষ্কারে সন্তুষ্ট হয়ে ২০১৬ সালে রাষ্ট্রপতি একই বিচারপতির নেতৃত্বে দ্বিতীয় সার্চ কমিটি গঠন করেছিলেন, যাদের অবদান হচ্ছে কে এম নুরুল হুদার কমিশন। কাজী রকিব কমিশনের বদান্যতায় যারা বিনা ভোটে ২০১৪ সালে নির্বাচিত হয়েছিলেন তাদের ভোটেই মহামান্য রাষ্ট্রপতি দ্বিতীয়বার নির্বাচিত হয়েছেন। ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি মো: আব্দুল ওয়াহাব মিঞাকে ডিঙিয়ে সার্চ কমিটির দুইবারের সভাপতি বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনকে ২০১৮ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি প্রধান বিচারপতি নিয়োগ দেয়া হয়। অবশ্য ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি ২০১১ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বহাল থাকার পক্ষে রায় দেয়ায় সেটিও একটি কারণ হতে পারে। দ্বিতীয় সার্চ কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী গঠিত কে এম নুরুল হুদা কমিশনের প্রথম অবদান হচ্ছে বরিশাল, খুলনা, রাজশাহী, গাজীপুর, ঢাকা ও চট্টগ্রাম স্টাইলে সিটি করপোরেশন নির্বাচন। দ্বিতীয় উপহার হলো ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচন, যেখানে তার অধীনস্থ প্রশাসন, পুলিশ ও পোলিং অফিসারদের লজিস্টিক সাপোর্ট পেয়ে পলিটিক্যাল অ্যাকটিভিস্টরা জিরো আওয়ারে ভোট কেটে ৯৭.৩৩ শতাংশ আসনে ১৪ দলের প্রার্থীর জয়ের রেকর্ড সৃষ্টি করে। সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার বিচারপতি আব্দুর রউফ ঢাকার মিরপুর আসনের ১৯৯৩ সালের উপনির্বাচনের সব ব্যালট জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে পুনঃগণনা করে সকল সন্দেহের অবসান ঘটিয়েছিলেন এবং ১৯৯৪ সালের মাগুরার উপনির্বাচনে কারচুপি ঠেকাতে ব্যর্থ হয়ে প্রতিবাদে পদত্যাগ করেছিলেনএ। অথচ ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনে ভোট ডাকাতি ও কারচুপির ব্যাপারে টিআইবির রিপোর্টে স্যাম্পল হিসেবে ৫০টি আসনের যে চিত্র উঠে এসেছিল কে এম নুরুল হুদা কমিশন ওই কয়েকটি আসনের ভোট পুনঃগণনার সৎ সাহস দেখাতে ব্যর্থ হয়েছেন।
স্থানীয় সরকার নির্বাচনেও এই ভোট ডাকাতি দিন দুপুরে চললেও কে এম নুরুল হুদা কমিশন এ ব্যাপারে মুখে কুলুপ এঁটে বসে আছে। কাজী রকিব কমিশন রাষ্ট্রপতির সাথে ২০১৭ সালে বিদায়ী সাক্ষাৎ করতে গেলে নিষ্ঠা ও সততার সাথে দায়িত্ব পালনের জন্য রাষ্ট্রপতি যেমন তাদের ভূয়সী প্রশংসা করেছিলেন তেমনই ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে কে এম নুরুল হুদা রাষ্ট্রপতির সাথে বিদায়ী সাক্ষাৎ করতে গেলে একই রূপ প্রশংসিত হবেন বলে আশা করা যায়। কে এম নুরুল হুদার দুর্নীতি ও বিভিন্ন অনিয়মের অভিযোগে তার বিরুদ্ধে তদন্ত কমিশন গঠনের জন্য ২০২০ সালের ১৪ ডিসেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসে দেশের ৩০ জন বিশিষ্ট নাগরিক মহামান্য রাষ্ট্রপতির কাছে লিখিত আর্জি পেশ করলেও দীর্ঘ এক বছরেও রাষ্ট্রপতির দফতর থেকে এ ব্যাপারে আবেদনকারীদের কিছুই জানানো হয়নি। ১৯৯১, ১৯৯৬, ২০০১ ও ২০০৮ সালে ১০ সদ্যসের নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার যারা সবাই অরাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব তারা তিন মাসের মধ্য জাতির কাছে অবাধ সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ গ্রহণযোগ্য নির্বাচন উপহার দিতে পারলে ৫০ বছরের রাজনৈতিক অভিজ্ঞতাসম্পন্ন ৫০ সদস্যের দলীয় মন্ত্রিসভা অনুরূপ নির্বাচন উপহার দিতে ব্যর্থ হয়ে জেনারেল এরশাদের সহায়তায় এরশাদীয় কায়দায় ১৯৮৮ সালের মতো নির্বাচন ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারিতে এবং ১৯৮৬ সালের মতো নির্বাচন ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর উপহার দেয়ায় এই দুঃখ রাখার জায়গা নেই।
সংলাপ ডেকেছেন রাষ্ট্রপতি। উদ্দেশ্য সব রাজনৈতিক দলের ঐকমত্যের ভিত্তিতে সার্চ কমিটি গঠন করে তাদের মাধ্যমে নির্বাচন কমিশনারদের খুঁজে বের করা। তাই যদি হয় তাহলে একই দিন, একই সময় সব দলের সাথে গোলটেবিলে সংলাপ না করে একেক দলের সাথে একেক দিন সংলাপ করা হচ্ছে কেন?
২০০৪ সালে বিএনপি সরকার তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিলের সুযোগ পেয়েও করেনি। আওয়ামী আইনজীবীর ১৯৯৭ সালে করা রিটের শুনানি ২০০৪ সালে হয়েছিল। সংবিধান সংশোধনের মতো প্রয়োজনীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতা চার দলীয় জোট সরকারের থাকলেও শুনানিতে অ্যাটর্নি জেনারেল তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বহাল থাকার পক্ষে যুক্তি প্রদর্শন করায় এবং রিটকারীর সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি হিসেবে রিট করার অধিকার না থাকায় হাইকোর্ট রিটটি খারিজ করে দিলে আওয়ামী লীগের জ্বর ঘাম দিয়ে ছেড়ে গিয়েছিল। কারণ সুপ্রিম কোর্ট ২০১১ সালে যে রায় দিয়েছেন হাইকোর্টে ওই রায় ২০০৪ সালে হলে ২০০৭ সালের প্রস্তাবিত নির্বাচনকালীন বিএনপি সরকার সাংবিধানিকভাবেই আওয়ামী লীগের মতো ক্ষমতায় থাকতে পারত। রিটকারীর পক্ষে রায় হওয়া আপিলের সুযোগ থাকত না।
প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হকসহ যে চারজন বিচারপতি তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা অবৈধ ঘোষণা করে আপিলে রায় দিয়েছিলেন তাদের আপিলের শুনানিতে অংশগ্রহণ রেওয়াজসিদ্ধ ছিল না। খায়রুল হক তার কাস্টিং ভোটের রায়ে নির্বাচনকালীন আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় থেকে নির্বাচনের প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার অধিকার দিয়েছিলেন। অথচ তারা নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকারের দাবিতে সংসদ হতে পদত্যাগ করেছিলেন। রায়ের পুরস্কারস্বরূপ অবসর গ্রহণের দুই বছর পর ৭০ বছর বয়সে তাকে ১০ বছরের জন্য আইন কমিশনের চেয়ারম্যান নিযুক্ত করেছেন বর্তমান রাষ্ট্রপতি। পক্ষে রায়দানকারী বাকি তিন বিচারপতিকেও পর্যায়ক্রমে প্রধান বিচারপতি করা হয়েছিল যাদের সর্বশেষ জন ছিলেন বিচারপতি এস কে সিনহা। তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা প্রবর্তনের কারণে লাভবান বা ক্ষতিগ্রস্ত হলে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি উভয়ে হয়েছিল। কারণ এই ব্যবস্থায় তারা যেমন বিরোধী দলে থেকে ভোটের মাধ্যমে ক্ষমতায় যেতে পেরেছিল তেমনি ভোটের মাধ্যমে ক্ষমতা হারিয়েছিল। আপিলের পক্ষভুক্ত হওয়া ব্যক্তি এই ব্যবস্থায় কোনো ক্ষতিগ্রস্ত বা তার অধিকার ক্ষুণ্ণ হয়েছিল না। তাই তিনি আপিলে পক্ষভুক্ত হতে পারেন না। আলজাজিরার বিরুদ্ধে যে রিট হয়েছিল তা খারিজ হয়েছিল সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি হিসেবে তিনি রিট করতে পারেন না।
রাষ্ট্রপতি একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা ও দীর্ঘ অর্ধশতাধিক বছরের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন রাজনীতিবিদ। জনগণের আশা, গোল টেবিল বৈঠকে ক্ষমতাসীন দল যদি আগামী নির্বাচন ১৯৯৬ সালের ১২ জুনের বা ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের আদলে করার সম্মতি দেন এবং ওই সিদ্ধান্ত মহামান্য রাষ্ট্রপতির ঘোষণায় প্রচারিত হয় তাহলে উন্নয়নের জোয়ারের মতো দেশব্যাপী আনন্দের বন্যা বয়ে যাবে। সুপ্রিম কোর্টের রায়ের কারণে জনগণ যেহেতু ২০১৪ সাল থেকে ভোটাধিকার হারা হয়েছে তাই সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খাইরুল হকের কাস্টিং ভোটের রায় রিভিও করে সুপ্রিম কোর্টই পারে জনগণকে অবাধে ভোট দানের সুযোগ করে দিতে।