১৯৯৭ সালের ডিসেম্বরে স্বাক্ষরিত পার্বত্য শান্তিচুক্তির ২২ বছর পরও পাহাড়ে বনজঙ্গলে চলছে বন্দুকযুদ্ধ, অস্ত্রের মহড়া ও একে ৪৭সহ অত্যাধুনিক অস্ত্রের প্রদর্শনী। প্রায় দুই যুগ পরও শান্তির শ্বেত কপোতের দেখা মেলেনি, হিংসার আগুনে পুড়ছে তিন পার্বত্য জেলার বাঙালিদের মানবাধিকার। পার্বত্যবাসী সাধারণ উপজাতি ও বাঙালিরা হচ্ছে উপেক্ষিত। চুক্তির একপক্ষ তথা সন্তু লারমা পক্ষই ভোগ করছে শান্তিচুক্তির শতভাগ হালুয়া-রুটি, সরকার পক্ষ দেশী-বিদেশী চাপের মুখে শতভাগ ক্ষমতা ছেড়ে দিয়েও যেন স্নায়বিক আতঙ্কে ভুগছে; আবার না জানি সন্তু লারমা কোন দাবিটি করে বসে? একপক্ষ যতই পাচ্ছে ততই পাওয়ার ক্ষুধা বাড়ছে।
সরকার পক্ষ দিশেহারা আত্মসমর্পণকারীদের মান ভাঙাতে। বিশ্বের কোথাও কোনো আত্মসমর্পণকারী রাষ্ট্রদ্রোহীদের যেসব সুবিধা দেয়া হয় না, তার চেয়ে হাজারগুণ বেশি স্বাধীনতা দেয়া হচ্ছে সন্তুবাবুদের। অথচ তার পরও থামছে না রণহুঙ্কার, হুমকি-ধামকি, খুন, চাঁদাবাজি, বন্দুকযুদ্ধ, মুক্তিপণ, রাষ্ট্রদ্রোহী জুমল্যান্ড অপপ্রচার। এই তো আমাদের শান্তিচুক্তি, এই তো আমার বাংলাদেশ, এটাই তো বর্তমান পাহাড়ের সর্বশেষ চিত্র।
পার্বত্য শান্তিচুক্তির মাধ্যমে সন্তু লারমা নিজের এসএমজিসহ মোট ৮৭২টি অস্ত্র জমা দিয়েছিলেন (পুরনো, জংধরা, বেয়নেটসহ)। ভালো এবং ভারী অস্ত্রগুলো জমা না দিয়ে গোপন স্থানে তা সংরক্ষিত করা হয়েছে ভবিষ্যতের জন্য। জেএসএস এবং ইউপিডিএফ উভয় গ্রুপই ক্যাডার বাহিনী গঠন করে পাহাড়ের দুর্গম এলাকাগুলো চাঁদাবাজির সুবিধার্থে ভাগ করে নিয়েছে। পাহাড়ের ১৬ লাখ মানুষ তাদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ। মাঝে মধ্যে চাঁদার টাকা বাটোয়ারা নিয়েও চলে খুনোখুনি- বন্দুকযুদ্ধ। চুক্তির শর্তানুযায়ী অনেকগুলো নিরাপত্তা ক্যাম্প প্রত্যাহারের কারণে সেগুলো চলে গেছে পাহাড়ি সন্ত্রাসীদের দখলে। অল্প কিছু নিরাপত্তা ক্যাম্প সচল আছে যেগুলো মাঝে মধ্যে বেসামরিক পুলিশ, আনসার, বিজিবির আমন্ত্রণে পেট্রোল ডিউটিতে গিয়ে জনগণের জানমাল-সম্পদ রক্ষা করছে।
সেখানেও যেন সন্তু লারমার অস্বস্তি। বলা হচ্ছে শান্তিচুক্তির লঙ্ঘন। এই অল্পকিছু সেনাবাহিনীর কারণে বর্তমানে পাহাড়ে বন্দুকযুদ্ধ সীমিত, চাঁদাবাজি, খুন, ধর্ষণ, ডাকাতি ইত্যাদি ব্যাহত হচ্ছে। তাতেই যেন বাবুদের গোস্বা- তাই তো যুদ্ধ ঘোষণা ছাড়াই অতর্কিতে রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবানে সেনা টহলগাড়িতে অ্যাম্বুশ করা হচ্ছে, অকালে শহীদ হচ্ছে আমাদের বীর সৈনিকরা। কিন্তু, এই শান্তিচুক্তির জন্যই কি আমরা ৩০ লাখ বাঙালি ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে জীবন দিয়েছিলাম?
পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙালিরা মানবাধিকার বঞ্চিত, ঘরে তাদের ক্ষুধার জ্বালা, বাইরে প্রাণের ভয়। জুম্ম জাতির মুক্তিযুদ্ধের জন্য বাঙালিরা চাঁদাবাজি, গুম, হত্যা, অপহরণ, অগ্নিসংযোগ এবং মিথ্যা মামলার শিকার হচ্ছে। সরকার দুর্গম পাহাড়ি অঞ্চলে আজো নিরাপত্তা ব্যবস্থা ও স্বাধীন-সার্বভৌম নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি। কেননা, সেসব করতে গেলেই উপজাতীয় সন্ত্রাসীদের ব্ল্যাক মেইলের ফাঁদে পড়তে হয়। পাহাড়ি নারীদের ব্যবহার করাতে গুরুত্বপূর্ণ অনেক অভিযান, অপারেশন করা যায় না। ধর্ষণের সাজানো ঘটনায়ও বিব্রত হতে হয় নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য, পুলিশ, বিজিবি ও আনসার ভিডিপির সদস্যদের।
রাঙ্গামাটির সাজেক, কুতুবছড়ি, নানিয়ারচর, দীঘিনালা, পানছড়ি, থানছি, রুমা, নাইক্ষ্যংছড়ি, ফাসিয়াখালী, কাউখালী, বাঘাইছড়ি, খাগড়াছড়ি সদরের স্বনির্ভর, লারমা স্কোয়ার, বিভিন্ন বৌদ্ধ মন্দির, বনভান্তের আশ্রম, পাকুয়াখালী, মানিকছড়ি, মহালছড়ি, রামগড় ইত্যাদিতে বেশ কিছু দুর্গম এলাকায় সরকারের ন্যূনতম নজরদারি ও নিয়ন্ত্রণ আজো প্রতিষ্ঠা হয়নি। ওই সব স্থানে প্রবেশাধিকার খুবই কঠিন ও উপজাতীয় নেতাদের নিয়ন্ত্রিত। সেখানে বাঙালিরা প্রবেশ করতে পারে না। এমনকি উপজাতীয় সন্ত্রাসীদের স্বজনছাড়া নিরীহ উপজাতি জনগণও প্রবেশ করতে পারে না। চাঁদাবাজি ও সন্ত্রাসের অভয়ারণ্য হিসেবে পরিচিত ওই সব এলাকার বিষয়ে জেএসএস, ইউপিডিএফ নেতারা শান্তিচুক্তির পর থেকে আজো নীরব ভূমিকায় কেন? জাতি কি সেই তথ্য পাওয়ার অধিকার রাখে না?
দেশ ও জাতির বৃহত্তর স্বার্থে, বাংলাদেশের অখণ্ডতা, স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও সংবিধান রক্ষার অঙ্গীকার নিয়েই ২ ডিসেম্বর ১৯৯৭ সালে স্বাক্ষরিত হয়েছিল শান্তিচুক্তি। অথচ- ১. পার্বত্য বাঙালিরা কোনো চাকরি কোটা পায় না। কিন্তু ১৯৮৫ সাল থেকেই অদ্যাবধি জাতীয় ভিত্তিক স্তরে পাঁচ শতাংশ হারে উপজাতি কোটা বরাদ্দ আছে। পাঁচ হাজার জনের বেশি উপজাতি নর-নারী এই সুবিধা পেয়েছেন, যার বেশির ভাগই সন্তু লারমার আত্মীয়/চাকমা ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর। ২. উচ্চশিক্ষার জন্য দেশের বড় বড় নামীদামি কলেজ ও ভার্সিটিতে প্রতি বছরই ২১৭টি করে আসন সংরক্ষিত থাকে উপজাতীয় ছাত্রছাত্রীদের জন্য। পার্বত্যবাসী বাঙালিরা খুবই অল্পসংখ্যক সিট পেয়েও নীরব আছেন। উপেন্দ্র লাল চাকমারা এত কিছু পেয়েও সরব নিরন্ন অসহায় বাঙালিরা গুচ্ছগ্রামের ঘানি টানতে টানতে ক্লান্ত-অবসন্ন।
৩. সরকারি ব্যাংক থেকে উপজাতিরা পাঁচ শতাংশ স্বল্পসুদে ঋণ পেলেও বাঙালিরা পায় না। উপজাতি নেতারা বিভিন্ন অজুহাতে ঋণ নিয়েও তা পরিশোধ করে না, এমনকি সুদাসলে তা মওকুফ করিয়ে নেয় বিভিন্ন কৌশলে। ৪. পার্বত্যবাসী বাঙালিরা সরকারকে আয়কর দিলেও উপজাতিরা কোনো আয়কর দেয় না। ৩০ শতাংশ পাহাড়ি ভাতা নিচ্ছে স্থানীয়ভাবে বসবাসকারী উপজাতি জনবল। ৫. পার্বত্য চট্টগ্রামে বিদ্যমান সব সরকারি-আধাসরকারি-স্বায়ত্তশাসিত অফিস-আদালত প্রতিষ্ঠানে ৮০ শতাংশ চাকরি পাচ্ছেন উপজাতিরা। বাঙালিরা মেধা এবং প্রতিযোগিতার ভিত্তিতে অল্পকিছু মাত্র চাকরি পেয়ে থাকে।
৬. পুলিশ বিভাগে এ পর্যন্ত ৭০৫ জনের বেশি আত্মসমর্পণকারী শান্তিবাহিনীর সদস্যকে এসআই, কনস্টেবল পদে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। পার্বত্য বাঙালিদের জন্য কোনো কোটা নেই, এমনকি পুলিশ বিভাগের বড় অফিসার পদেও উপজাতীয়দের ছড়াছড়ি (এনবিকে ত্রিপুরা, পুলিশের ডিআইজি, পার্বত্য মন্ত্রণালয়ের সচিব এবং বর্তমানে পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান)। ৭. শান্তিচুক্তির মাধ্যমে সব উপজাতিকে ভোটার করা যাবে। ভারত কিংবা বাংলাদেশী উপজাতি বলে যাচাই করা যাবে না। কিন্তু শুধু স্থায়ী ঠিকানা সংবলিত বাঙালিকে ভোটার করা যাবে। তাদের সন্তানদের ভোটার করা যাবে না। যা রীতিমতো সংবিধানের লঙ্ঘন।
৮. শান্তি চুক্তির শর্তানুযায়ী তিন পার্বত্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান হবেন উপজাতীয়। জেলা পরিষদের ৩৪টি আসনের মধ্যে উপজাতীয়দের জন্য রাঙ্গামাটিতে ২৩টি, বান্দরবানে ২২টি এবং খাগড়াছড়িতে ২৪টি আসন বরাদ্দ করা আছে। পার্বত্যবাসী বাঙালিদের জন্য রাঙ্গামাটিতে ১১টি, বান্দরবানে ১২টি এবং খাগড়াছড়িতে ১০টি মাত্র আসন বরাদ্দ। এত বড় বৈষম্যের পরও সন্তুবাবুদের হাজারো অভিযোগ।
৯. পার্বত্য আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান পদে সন্তু লারমা (১২ বছরেরও বেশি বিনা ভোটে ক্ষমতা ভোগ করছেন) এবং ২২ জন সদস্যের মধ্যে ১৫ জন উপজাতীয় এবং সাতজন বাঙালি। অথচ পার্বত্য চট্টগ্রামে জনসংখ্যার অর্ধেক বাঙালি জনগোষ্ঠী। ১০. সরকারি প্রকল্প ব্যয়/টেন্ডার দুই লাখ টাকা পর্যন্ত উপজাতীয় ঠিকাদারদের জন্য অগ্রাধিকার, যা বাঙালিরা পায় না। ১১. পাহাড়ে ইউএনডিপিসহ দেশী-বিদেশী সবগুলো এনজিও উপজাতীয়দের জন্য অবারিত অথচ বাঙালিদের কোনো এনজিও অর্থায়ন করে না। টুকিটাকি অর্থ পেলেও সন্ত লারমার চোখ রাঙানির কারণে বাঙালিদের পুনর্বাসনের প্রকল্প কাটছাঁট করে দেয়া হয়। নিজেদের আদিবাসী বলে জাহির করে দেশী-বিদেশীদের করুণা ভিক্ষা করা এবং পাহাড়ে বসবাসকারী অনাহারে-অর্ধাহারে জর্জরিত বাঙালি জনগোষ্ঠীকে অনুপ্রবেশকারী, রিফুজি, সেটেলার, মোগদা বাঙাল বলে গালাগাল করাই হলো জনসংহতি সমিতি, ইউপিডিএফ, পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ, হিল ওম্যান ফেডারেশন, গুলুস, বোরকা পার্টি, লাগেজ পার্টি নামধারী উপজাতীয় সন্ত্রাসীদের প্রধান কাজ। এমন বাংলাদেশ তো আমরা চাইনি।
লেখক : যুগ্ম আহ্বায়ক, সম-অধিকার ছাত্র আন্দোলন, পার্বত্য চট্টগ্রাম। পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসিন্দা