গ্রাম-গঞ্জের নিস্তরঙ্গ জীবনে হইহল্লা নেই। সবাই কাজে ব্যস্ত ফসল লাগানো, তোলা, বাজারে নিয়ে যাওয়া, বিক্রি করা, ব্যবসা করা, ইজিবাইক চালানো বা রিকশা টানা ইত্যাদি কাজে। তারপর ঘরে ফেরা আর নিস্তরঙ্গ রাত পোহানো। আবার সকালের অপেক্ষা। নতুন দিনের আরো কিছু কাজ। খুব জনসমাবেশ গ্রামে হয় না। বিয়ে-শাদি কারো ইসালে সওয়াব, রোজা রমজানের তারাবিহ, ঈদের সময় বা কোরবানি ঈদের সময় মানুষের চাঞ্চল্য বোঝা যায় আর আছে মৃত্যুর খবরে।
আগে যাত্রা বা পালাগান, শীতকালের অনুষঙ্গ ছিল। বর্তমানে তা উঠে গেছে। শিক্ষিত সমাজ বেড়েছে কাজেই ঘরবাড়ির সুস্বাচ্ছন্দ্য, ঘরের টিভি বিনোদন জায়গা নিয়েছে গান বাজনার। তবে হ্যাঁ, এখনও ওয়াজ মাহফিল পুরুষদের আকর্ষণ করে।
বাংলাদেশের এমপি ইলেকশনের একটা ঢেউ ওঠে বটে কিন্তু তার চেয়ে জনপ্রিয় ইলেকশন হচ্ছে চেয়ারম্যানের ইলেকশন অর্থাৎ ইউপি ইলেকশন। এটা তৃণমূলের মানুষদের সংগঠিত করে থাকে। এই নিয়ে মাঠ ঘাট সরব হয়ে ওঠে পক্ষ-বিপক্ষ নিয়ে তুমুল আলোচনা হয়। সুষ্ঠু ইলেকশন হলে মানুষ সোৎসাহে ভোট দিতে যায়। পর্দানশিন নারীদেরও পরিবার থেকে ভোট দেয়ার অনুমতি দেয়া হয়। এদের অনেকের ক্ষেত্রে আবার এমপি ইলেকশনে অনুমতি দেয়া হয় না। ইউপি ইলেকশনে ভোটের আমেজ এই জন্য বেশি যে, জনপ্রতিনিধিদের বেশির ভাগই গ্রামে বসবাস করে। তাদের সাথে আত্মিক, সামাজিক যোগাযোগ ওতপ্রোতভাবেই জড়িত। মামা, চাচা, ফুপা, ভাজিতা দূর আত্মীয়তার সম্পর্ক ভোট কেন্দ্রে টেনে আনে মানুষকে। এই সংস্কৃতিটা দীর্ঘদিন এ দেশে চালু ছিল। ছিল এ জন্য বলছি যে, আগেও, অর্থ প্রতিপত্তি, প্রভাবের প্রতিপত্তি ছিল, বর্তমানে তা বেড়ে প্রবল আকার ধারণ করেছে ফলে আনন্দমুখর ইলেকশনের নিশ্চয়তা ব্যাহত হচ্ছে। অর্থবিত্ত ও প্রভাবের সাথে হিংসাত্মক প্রতিদ্বন্দ্বিতা যেন বেড়েই চলেছে। ফলে আমরা প্রায় প্রতিদিন সংবাদপত্রে দেখছি। ইলেকশনে বিপুল খুনাখুনি, হানাহানি। কোথাও চেয়ারম্যান প্রার্থী খুন, কোথাও আবার সমর্থক খুন। কোথাও আবার নির্বাচনী পরবর্তীতে ইউপি মেম্বার, তাদের প্রতিদ্ব›দ্বী খুন, ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয়া, আহত-নিহতের সংখ্যা বাড়ছে। বেশ ক’বছর আগে শুনেছিলাম, এক স্থানে নবনির্বাচিত চেয়ারম্যানের ওপর গুলিবর্ষণ ও হুমকি-ধমকিতে চেয়ারম্যান নাকি ঘরবাড়ি ত্যাগ করে পলাতক জীবন বেছে নিয়েছিলেন। গ্রামীণ জনজীবনের উন্নয়নে ইউপি চেয়ারম্যান, মেম্বারদের ভূমিকা থাকে অপরিসীম। নিশ্চিন্ত, সুষ্ঠু নির্বাচন ও নির্বাচনকালীন পরবর্তী সহিংসতা রোধ করা তাই, অত্যন্ত কাক্সিক্ষত বিষয়।
আগে ইউপি নির্বাচন ছিল নির্দলীয়। ফলে প্রার্থী চেয়ারম্যান, মেম্বারগণ কারা ভালো- সেই বিষয়টি গুরুত্ব পেতো জনগণের কাছে। বর্তমানে এখানে রাজনীতি ঢুকে পড়ায় সাধারণ মানুষও বিপাকে। কারণ যে দল শক্তিশালী তাদের পার্টির লোকদের ভোট না দিলে পরবর্তীতে জুটবে না মাটি কাটার কাজ। সাহায্য, টিন, ঘরবাড়ি এ সমস্যায় ভীত মানুষ। তোষামোদকারী পক্ষের লোকেরা কানকথায় পৌঁছে দেয়। কারা কোন দলের সাপোর্টারকে ভোট দিয়েছে- ফলে হতে হয় একঘরে। পাওয়া যায় না ত্রাণ- তার উপরে অতি উৎসাহীরা তাদের দোকানপাট, ঘরবাড়িতেও আগুন দেয়- সমর্থক হিসেবে মেরে ফেলতেও দ্বিধা করে না। যত দিন যাচ্ছে, অশুভপ্রবণতা বাড়ছেই, কমছে না। মানুষ হত্যা, দায়িত্বরত অফিসারদের কাজে বাধা দান, হুমকিতে রাখা- এগুলো ইলেকশন থেকে দূর করতেই হবে। প্রশাসন যে নীরব ভূমিকা পালন করে তা বলা যায় না। কিন্তু বেপরোয়া উচ্ছৃঙ্খল সংস্কৃতি যেন পেয়ে বসেছে সমাজের ঘাড়। একজন মানুষ নিহত হলে তার পরিবারের ক্ষতি কিছু দিয়েই পূরণ হয় না। চাল, ডাল, লবণ, তেল কিছু টাকা দিলে নিহত মানুষ ফিরে আসে না। পরিবারে তার অভাব ঘোচে না। কাজেই শান্তিশৃঙ্খলা বজায় রাখার ক্ষেত্রে প্রার্থীদের ভূমিকা সবচেয়ে বড়। তাদের ধৈর্য, সহিষ্ণুতা, কর্মী নিয়ন্ত্রণে দক্ষতা দিয়ে নির্বাচনকে অর্থবহ ও সুন্দর করে তুলতে হবে। নির্বাচনের পর বিজয়ী প্রার্থী যেন দলীয় প্রার্থী হিসেবে জনগণের প্রতি বৈষম্যমূলক অবস্থান না নেন সেটাই হবে উপযুক্ত জনপ্রতিনিধির বা প্রতিনিধিদের বিচক্ষণতা।