ফের বেজে উঠেছে যুদ্ধের দামামা। যে কোনো মুহূর্তে ইউক্রেনের ওপর হামলা চালাতে পারে রাশিয়া। বিক্ষিপ্ত সংঘর্ষে ইতোমধ্যেই দুই ইউক্রেনিয়ান সেনার মৃত্যু হয়েছে। তবে রক্তক্ষরণের পরও শান্ত হচ্ছে না পরিস্থিতি। ইউক্রেন সীমান্তে রাশিয়া মোতায়েন করেছে ভয়ঙ্করতম ক্ষেপণাস্ত্র ‘ইস্কান্দার’। সীমান্তে প্রায় লাখখানেক সৈন্য সমাবেশও ঘটিয়েছে। পক্ষান্তরে আমেরিকার নেতৃত্বাধীন ন্যাটো জোটও তাদের সামরিক তৎপরতা বাড়িয়েছে। ইউক্রেনে কোনো অভিযান চালালে রাশিয়ার বিরুদ্ধে কঠোর নিষেধাজ্ঞাসহ নানা ব্যবস্থার হুমকি দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র এবং তার মিত্ররা। ইউক্রেনের পাশে দাঁড়িয়েছে আমেরিকা, ব্রিটেন ও কানাডা। রুশ বাহিনীকে রুখতে ইতোমধ্যেই ইউক্রেনের হাতে অ্যান্টি-ট্যাঙ্ক মিসাইল তুলে দিয়েছে ব্রিটেন। শুধু তাই নয়, ইউক্রেনের সৈন্যদের মদদ দিতে বিশেষ কমান্ডো বাহিনী পাঠিয়েছে কানাডা।
ইউক্রেন সংকট নিয়ে বিভিন্ন পর্যায়ে আলোপ-আলোচনার উদ্যোগও চলছে। এ ব্যাপারে গেল সপ্তাহে জেনেভায় রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এন্টনি বিøনকেনের এক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। ৩১ জানুয়ারি জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে একটি উন্মুক্ত বৈঠক ডেকেছে যুক্তরাষ্ট্র। এ বিষয়ে আলোচনা করতে নবনির্বাচিত জার্মান চ্যান্সেলর ওলাফ শলৎস আগামী ৭ ফেব্রæয়ারি ওয়াশিংটন সফর করছেন। ইউক্রেনকে ঘিরে বিশ্বরাজনীতিতে উত্তেজনা এখন চরমে। এই দুই প্রতিবেশী দেশের দ্ব›দ্ব যদি ক‚টনৈতিক উদ্যোগে সমাধান না হয়, তা হলে তা তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের আকার নিতে পারে, কোনো কোনো বিশেষজ্ঞ তেমনই আশঙ্কা করছেন।
কয়েক মাস ধরেই পূর্ব ইউরোপে ন্যাটো জোটের প্রভাব বিস্তার নিয়ে আপত্তি জানিয়ে আসছে রাশিয়া। স¤প্রতি আমেরিকার নেতৃত্বাধীন সামরিক জোটটিতে ইউক্রেনের ‘পর্যবেক্ষক সদস্য’ হিসেবে যোগদানের পর থেকেই ইউক্রেন সীমান্তে অন্তত ১ লাখ সেনা মোতায়েন করে মস্কো। কিন্তু হঠাৎ কেন এই যুদ্ধ পরিস্থিতি? আসলে আকস্মিক মনে হলেও এই দ্ব›েদ্বর বীজ রোপণ হয়েছিল ২০১৪ সালে। ইউক্রেনের ডোনবাস অঞ্চলে ২০১৪ সাল থেকেই চলছে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন। আর এই আন্দোলনকে সম্পূর্ণ সমর্থন জানিয়েছিল রাশিয়া। এমনকি বছরসাতেক আগে ইউক্রেনের থেকে ক্রিমিয়া প্রদেশ বিচ্ছিন্ন করে, তার দখল নিয়েছিল মস্কো। ইউক্রেনের অভিযোগ এবারও ঘটতে চলেছে একই ঘটনা। যদিও রাশিয়ার বক্তব্য, সীমান্তে শান্তি ফেরাতেই এই বন্দোবস্ত।
তবে বিশ্বের অধিকাংশ ক‚টনীতিবিদই অন্য এক তত্ত¡ খাড়া করছে রাশিয়ার এই সক্রিয়তা প্রসঙ্গে। রাশিয়া অধিকৃত ক্রিমিয়ায় পানি দুষ্প্রাপ্য সম্পদ। সা¤প্রতিক বছরগুলোতে পানির অভাব সেখানে আরও চরমে পৌঁছেছে। আর সেই কারণেই রাশিয়া বাগে আনতে চাইছে ডোনবাস প্রদেশকে। ডোনবাস অধিগ্রহণ সম্ভব হলে ইউক্রেনের মধ্য দিয়ে ক্রিমিয়া পর্যন্ত করিডর বানাতে পারবে রাশিয়া। তাতে অনেকটাই আয়ত্তে আনা যাবে পানি সমস্যাকে। আজভ সাগর এবং আর্মিয়ানস্ক অঞ্চলে ক্ষমতা দখল করেও পানির সমস্যা সমাধান করতে পারত রাশিয়া। তবে সেখানে ইউক্রেনের সেনার শক্ত ঘাঁটি থাকায় ঝুঁকি নিচ্ছেন না পুতিন। বরং জনবসতিপূর্ণ ডোনবাসকেই বেছে নিয়েছেন অধিগ্রহণের জন্য। কারণ সেখানে সাধারণ মানুষের বসতির জন্যই সেভাবে প্রত্যাঘাত করতে পারবে না ইউক্রেন। পাশাপাশি রাশিয়ার মদদপুষ্ট মিলিশিয়া দলেরও সহযোগিতা পাবেন ভøাদিমির পুতিন।
উল্লেখ্য, ইউক্রেন ও রাশিয়া এক সময় সোভিয়েত ইউনিয়নের অংশ ছিল। সাবেক সোভিয়েত প্রজাতন্ত্রভুক্ত পূর্ব ইউরোপের বেশ কয়েকটি দেশের মতো ইউক্রেনেও দুটি রাজনৈতিক ধারা বেশ স্পষ্ট। এর একটি অংশ চায়, পশ্চিম ইউরোপের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হতে, ইউরোপীয় ইউনিয়নে যোগ দিতে এবং নিজেদের প্রতিরক্ষার জন্য ন্যাটো সামরিক জোটের সদস্য হতে। অপর অংশ রুশ প্রভাব বলয়ে থাকার পক্ষপাতী, কারণ ইউক্রেনের জনসংখ্যার বিরাট অংশ রুশ ভাষাভাষী, তারা জাতিগতভাবেও রুশ। রাশিয়ার সঙ্গে তাদের রয়েছে ঘনিষ্ঠ সাংস্কৃতিক এবং সামাজিক যোগাযোগ। এই সুযোগকে কাজে লাগিয়েই রাশিয়া ক্রিমিয়াকে আত্তীকরণ করে। তা ছাড়া প্রায় দুশো বছর ধরে ক্রিমিয়া রাশিয়ারই অংশ ছিল। ক্রিমিয়ার সেভাস্তাপোলে রাশিয়ার যে নৌঘাঁটি, সেটি কৌশলগত কারণে রাশিয়ার কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বাল্টিক সাগরে রাশিয়ার ঢোকার পথ হচ্ছে এই বন্দর। সেটি হাতছাড়া হতে তারা কোনোভাবেই দিতে চায়নি।
রাশিয়া নিজেকে এখনো দেখে একটি পরাশক্তি হিসেবে এবং বিশ্বে তার সেই সামরিক-রাজনৈতিক শক্তি অটুট রাখার ক্ষেত্রে ইউক্রেনের ভ‚রাজনৈতিক গুরুত্ব তাই অনেক। প্রথমত, ভৌগোলিক অবস্থানের কারণেই ইউক্রেনের ওপর মূল নজর রয়েছে রাশিয়ার। দ্বিতীয়ত, ইউক্রেন যাতে কোনোদিনই ন্যাটোর সঙ্গে জোট বাঁধতে না পারে, সেটাই লক্ষ্য রাশিয়ার। তাতে সামরিক দিক থেকে লাভবান হবে রাশিয়াই। কেননা ইউক্রেনে ন্যাটো ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিস্থাপন না হলে, অনেকটাই নিশ্চিত হবে দক্ষিণ-পূর্ব রাশিয়ার নিরাপত্তা। রাশিয়া ভবিষ্যতে যাতে কোনো ধরনের সামরিক চ্যালেঞ্জেন সম্মুখীন না হয়, সেজন্য ইউক্রেন নিয়ে তার এত মাথাব্যথা। প্রেসিডেন্ট পুতিন মনে করেন, পশ্চিমা শক্তি আসলে ন্যাটো জোটকে ব্যবহার করে চারদিক থেকে রাশিয়াকে ঘিরে ফেলছে। ১৯৯৯ সালে চেক প্রজাতন্ত্র, হাঙ্গেরি এবং পোল্যান্ড যোগ দেয় ন্যাটোতে। ২০০৪ সালে তাদের পথ অনুসরণ করল বুলগেরিয়া, এস্তোনিয়া, লাটভিয়া, লিথুয়ানিয়া, রোমানিয়া এবং ¯েøাভাকিয়া। ২০০৯ সালে যোগ দেয় আলবেনিয়া। এই দেশগুলো এক সময় হয় ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের অংশ অথবা ওয়ারশ সামরিক জোটের সদস্য। জর্জিয়া, মলদোভা বা ইউক্রেনও পারলে ন্যাটো বা ইউরোপীয় ইউনিয়নে যোগ দেয়, কিন্তু এখনো পর্যন্ত রাশিয়ার কারণেই তাদের যোগ দেওয়া হয়নি। কারণ এই তিনটি দেশেই রুশপন্থি মিলিশিয়াদের শক্ত অবস্থান আছে। এই দেশগুলোর যে কোনো একটি যদি ন্যাটোতে যোগ দেয়, তা রাশিয়ার সঙ্গে যুদ্ধের স্ফুলিঙ্গ হিসেবে কাজ করতে পারে।
ইউক্রেনের ন্যাটোতে যোগ দেওয়া মানে যুক্তরাষ্ট্র বা ন্যাটোর সামরিক বাহিনী একেবারে রাশিয়ার পেটের ভেতরে এসে অবস্থান নেওয়া। নিজের দোরগোড়ায় প্রধান প্রতিদ্ব›দ্বী যুক্তরাষ্ট্র এবং তাদের মিত্র পশ্চিমা দেশগুলোর সামরিক উপস্থিতিকে রাশিয়া সঙ্গত কারণেই এক বিরাট নিরাপত্তা হুমকি হিসেবে বিবেচনা করে। আর তাই রাশিয়া পশ্চিমা দেশগুলোর কাছ থেকে এ রকম একটা নিশ্চয়তা চায়, যেন ইউক্রেন কখনই ন্যাটোর সদস্য হতে না পারে। কিন্তু পশ্চিমা দেশগুলো এ রকম নিশ্চয়তা দিতে রাজি নয়। আমেরিকা ও ন্যাটো মহাসচিব বলে দিয়েছেন যে, প্রত্যেকটি দেশের তার মতো করে নিজের প্রতিরক্ষার পথ বেছে নেওয়ার অধিকার আছে।
ইউক্রেন পরিস্থিতিতে রাশিয়া আছে সুবিধাজনক অবস্থানে। পরমাণু অস্ত্রের কথা বাদ দিলেও রাশিয়ার হাতে রয়েছে সবচেয়ে শক্তিশালী অস্ত্র তার জ্বালানি। ইউরোপের মোট তেল এবং গ্যাস সরবরাহের ২৫ শতাংশ আসে রাশিয়া থেকে। লাটভিয়া, ¯েøাভাকিয়া, ফিনল্যান্ড এবং এস্তোনিয়ার মতো দেশগুলো রাশিয়ার জ্বালানির ওপর একশ ভাগ নির্ভরশীল। জার্মানির প্রায় অর্ধেক গ্যাস সরবরাহ আসে রাশিয়া থেকে। জার্মানির রাজনীতিকরা কেন রাশিয়ার সমালোচনায় অতটা সরব নয়, এ তথ্য থেকেই তা বোঝা যায়।
আর ইউরোপে গ্যাস সরবরাহের ক্ষেত্রে ইউক্রেন হচ্ছে রাশিয়ার প্রবেশদ্বার। রাশিয়া থেকে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে প্রধান গ্যাস পাইপলাইনগুলো গেছে ইউক্রেনের ভেতর দিয়ে। কাজেই ইউক্রেন যদি রাশিয়ার প্রভাব বলয়ের বাইরে চলে যায়, তা হলে গ্যাস সরবরাহের ক্ষেত্রে রাশিয়া তার একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ হাতছাড়া হতে পারে বলে আশঙ্কা করে। তবে ইউক্রেনকে পাশ কাটিয়ে রাশিয়া বাল্টিক সাগরের নিচ দিয়ে জার্মানি পর্যন্ত নর্ড স্ট্রিম-২ নামে নতুন একটি গ্যাস পাইপলাইন বসিয়েছে। কিন্তু রাশিয়া যদি ইউক্রেনে অভিযান চালায়, তাহলে এই নর্ড স্ট্রিম-২ গ্যাস পাইপলাইন প্রকল্প আর সামনে আগাবে না বলে এরই মধ্যে হুশিয়ারি দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।
ইউরোপ যেভাবে রাশিয়ার গ্যাসের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে, তাতে করে রাশিয়ার ইউরোপের দেশগুলোর ওপর রাজনৈতিক চাপ প্রয়োগের সুযোগ রয়েছে। তারা রাশিয়ার বিরুদ্ধে গেলে এসব গ্যাস পাইপলাইন দিয়ে সরবরাহ বন্ধ করে দিতে পারে, সামনের দিনগুলোতে এই জ্বালানিকে একটা রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে পারে। আর এখানেই রাশিয়া সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্র দেশগুলো রাশিয়ার বিরুদ্ধে ব্যাপক তর্জন-গর্জন করলেও বাস্তবে খুব একটা সুবিধা করতে পারবে বলে মনে হয় না। ইউক্রেনে রয়েছে রাশিয়ার ভ‚রাজনৈতিক সুবিধা। জ্বালানিনির্ভরতার কারণে ইউরোপের অনেক দেশ ‘ওয়াশিংটন প্রথম’ নীতি থেকে সরে এসেছে। ইউক্রেনের জন্য তারা সাধ্যের মধ্যে থাকা ও নির্ভরযোগ্য জ্বালানির এ ভরসাকে ঝুঁকিতে ফেলবে বলে মনে হয় না।
এ পরিস্থিতিতে আমেরিকা কি একাই লড়বে রাশিয়ার বিরুদ্ধে? নাকি ক্রমবর্ধমান রাশিয়ান আগ্রাসন মেনে নেবে? নাকি কৌশলে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের উসকানি দিয়ে চলবে? তবে কোনো কোনো বিশ্লেষকের মতে, যত গর্জে তত বর্ষে না। ইউক্রেনেও বিষয়টি সে রকমই। এখন দেখা যাক ইউক্রেন নিয়ে শেষ পর্যন্ত কোথাকার পানি কোথায় গড়ায়।
চিররঞ্জন সরকার : কলাম লেখক