অবশেষে দ্বিধা সন্দেহের অবসান ঘটিয়ে সামরিক বাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর (অব:) সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান হত্যাকাণ্ডের রায় দিয়েছেন আদালত। পুলিশের দায়িত্বরত কর্মকর্তা এভাবে সামরিক বাহিনীর একজন কর্মকর্তাকে হত্যা করবেন এমনটি কল্পনা করার মতো নয়। আমাদের দেশের আর্মি ও পুলিশ দুটো সহযোগী বাহিনী। দেশের সার্বভৌমত্ব ও অভ্যন্তরীণ আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় তারা হাত ধরাধরি করে চলে। উভয় বাহিনীর মধ্যে বোঝাপড়া ও সম্মানজনক সম্পর্ক রয়েছে। তাই এই হত্যাকাণ্ডে সারা দেশে বিপুল ক্ষোভের সঞ্চার হয়। সবাই জানতে চাইছিল, কেন পুলিশের কিছু সদস্য সামরিক বাহিনীর একজন চৌকস সদস্যকে হত্যা করল। বিচারকও জানার জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছেন, কেন এ হত্যাকাণ্ড ঘটানো হলো। তথ্য-প্রমাণ ও সাক্ষীসহ দীর্ঘ পর্যবেক্ষণে উঠে এসেছে এটা ছিল একটি পরিকল্পিত হত্যা, যার পেছনে রয়েছে অত্র অঞ্চলে ওসি প্রদীপের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা অপরাধ সিন্ডিকেট।
আদালতের পক্ষ থেকে রায়ের কিছু অংশ পড়ে শোনানো হয়। বিচারক বলেন, মূলত খোঁজার চেষ্টা করেছি এপিবিএন চেকপোস্টে কেন হত্যাকাণ্ড ঘটল। চেকপোস্ট থেকে সিনহাকে স্যালুট দিয়ে তার গাড়ি ছেড়ে দেয়া হয়। এর পরই পাশে গাছের নিচে দাঁড়ানো পুলিশ কর্মকর্তা লিয়াকত মুহূর্তের মধ্যে গুলি করেন। আদালতের ভাষ্য অনুযায়ী, ওসি প্রদীপের সাথে ষড়যন্ত্র করে লিয়াকত উপর্যুপরি গুলি ও মৃত্যু নিশ্চিত করতে সিনহাকে হাসপাতালে নিতে বিলম্ব করেন। অন্য দিকে প্রদীপ সিনহাকে হত্যা করতে অন্য আসামিদের সাথে মিলে ষড়যন্ত্র করেন। তিনি নিজেই সিনহার মৃত্যু নিশ্চিত করতে বুকে লাথি মেরে পাঁজরের দু’টি হাড় ভেঙে দেন, তার গলা চেপে ধরেন। দু’জনে মিলে ঘটনাকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করতে নানা ফন্দি করেছেন।
সিনহাকে হত্যা করার জন্য পুলিশের এই দুই কর্মকর্তা কেন এত বেপরোয়া হলেন তার উত্তরও স্পষ্ট। সিনহা গিয়েছিলেন নিজের পছন্দের কাজ ডকুমেন্টারি তৈরি করতে কক্সবাজারে। এ কাজ করতে গিয়ে জানতে পারেন পুরো অঞ্চলে কিভাবে অপরাধের জাল বিস্তার করেছে প্রদীপের নেতৃত্বে সিন্ডিকেট। মাদক দমনের কথা বলে বহু মানুষকে হত্যা করেছেন তিনি। যাকে তাকে আটক করে অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায় করতেন নিয়মিত। অনেকে তার যৌন লালসার শিকার হয়েছেন। সিনহার নেতৃত্বে থাকা ডকুমেন্টারি টিমের কাছে এসব তথ্য-প্রমাণ এসেছিল। যখনই অপরাধী সিন্ডিকেট ব্যাপারটি টের পেল, প্রদীপের নেতৃত্বে একটি গ্রুপ তাকে হত্যা করে ওইসব ডকুমেন্ট মুছে দেয়ার ষড়যন্ত্র করে। তারা এ ক্ষেত্রে সফলও হয়েছে। তবে নিজেরা সিনহাকে হত্যার দায়টি এড়াতে পারেনি।
আদালত প্রদীপ ও লিয়াকতকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন। আরো ছয়জনকে যাবজ্জীবন দিয়েছেন। রায়ের পর এক প্রতিক্রিয়ায় সিনহার বোন জানিয়েছেন, এতে তিনি পুরোপুরি সন্তুষ্ট নন। তবে অপরাধীদের দণ্ড কার্যকর হলে সন্তুষ্ট হবেন। দেশবাসী সিনহার বোনের মতোই এ বিচারের রায় নিয়ে প্রত্যাশা করে। বিষয়টি এরপর উচ্চ আদালতের ওপর নির্ভর করছে। অনেক সময়ে মামলার দীর্ঘসূত্রতা বিচার প্রার্থীদের জন্য হতাশা সৃষ্টি করে।
এই মামলায় সিনহা হত্যার বিচার হলো। এজন্য জাতির পক্ষ থেকে একটি চাপ ছিল। কিন্তু এ হত্যাকাণ্ডের অন্য দিকটি হলো, পুলিশের অপরাধ কর্মকাণ্ডে জড়িত হয়ে যাওয়া। যেখানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী মানুষের জানমাল রক্ষা করবে সেখানে তারা নিজেরাই হয়ে উঠছে এর ভক্ষক। ওই সময় কক্সবাজারের পুলিশ সুপার থেকে কনস্টেবল পর্যন্ত প্রায় দেড় হাজার সদস্যকে বদলি করা হয়। মনে রাখতে হবে, অপরাধীকে বদলি কোনোভাবে তার শাস্তি নয়। এর মাধ্যমে কখনো অপরাধের মূলোৎপাটন হবে না। একজন অপরাধী যেখানে যান, তিনি সেখানেই দুষ্কর্ম করবেন। তাই অপরাধীদের করতে হবে উপযুক্ত বিচার; তিনি যত বড় কিংবা ছোট হন না কেন। ওই সময় কক্সবাজার জেলা পুলিশ সুপারের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছিল। অন্য দিকে বদলি হওয়া পুলিশের মধ্যে বহু সৎ পুলিশ থাকা স্বাভাবিক। বদলি যদি শাস্তি হিসেবে নেয়া হয় তাহলে সেসব সৎ পুলিশকে কেন এ শাস্তি দেয়া হলো? আমরা মনে করি, পুলিশ কেন অপরাধী হয়ে ওঠে তার পুরোদস্তুর একটি তদন্ত হওয়া দরকার। কক্সবাজারের টেকনাফে কিভাবে প্রদীপের অধীনে একটি বড় অপরাধ সম্রাজ্য কায়েম হয়েছিল সেটা নিয়ে দীর্ঘ তদন্ত হতে হবে। দেশের অন্য কোথাও পুলিশের আর কোনো অপরাধ সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে কিনা সেটাও খতিয়ে দেখতে হবে। তা হলেই কেবল পুলিশের অপরাধ বন্ধে প্রকৃত ব্যবস্থা নেয়া যাবে।