কালের নিয়মে পুরনোকে পেছনে ফেলে আরেকটি নতুন বছরের সামনে পৃথিবী। বিদায়ী বছরে যে গুণী ব্যক্তিত্বরা চিরতরে চলে গেছেন দেশের বিভিন্ন অঙ্গনকে শূন্য করে, তাদের অভাব কোনোভাবেই যে পূরণ হওয়ার নয়। প্রিয়জন হারানোর বেদনাকে সঙ্গী করেই সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক কর্মীরা চোখ রাখছেন ভবিষ্যতে। বাংলাদেশ অনেক বরেণ্য দিকপালকে হারালেও তাদের স্মৃতি ও কর্ম কোনোদিন মুছে যাওয়ার নয়। বেঁচে থাকবেন তাদের আপন কাজের মধ্যে; নীরবে অনুপ্রেরণা জোগাবেন দেশকে বিভিন্ন ক্ষেত্রে আরও এগিয়ে নিতে। লিখেছেন চপল মাহমুদ
সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম
আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীর সদস্য ও সাবেক জনপ্রশাসনমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম গত ৩ জানুয়ারি ৬৭ বছর বয়সে মারা যান। বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহচর ও জাতীয় চার নেতার অন্যতম সৈয়দ নজরুল ইসলামের ছেলে আশরাফুল ইসলাম আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন।
আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল
আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল ছিলেন একাধারে গীতিকার, সুরকার এবং সংগীত পরিচালক। সংগীতে অসামান্য অবদানের জন্য তিনি ২০১০ সালে একুশে পদক, শ্রেষ্ঠ সংগীত পরিচালক হিসেবে দুবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার এবং রাষ্ট্রপতির পুরস্কারসহ অন্যান্য অসংখ্য পুরস্কারে ভূষিত হন। গত ২২ জানুয়ারি মাত্র ৬৩ বছর বয়সে তিনি মারা যান।
আলোর ফেরিওয়ালা পলান সরকার
নিজের টাকায় বই কিনে পাঠকের বাড়ি বাড়ি পৌঁছে দিয়ে বই পড়ার আন্দোলন গড়ে তোলার জন্য পলান সরকার ২০১১ সালে একুশে পদক পান। গত ১ মার্চ ৯৮ বছর বয়সে নিজ বাড়িতে তিনি মারা যান।
কবি আল মাহমুদ
আধুনিক বাংলা সাহিত্যের কিংবদন্তিতুল্য কবিদের তালিকায় অনায়াসেই আসতে পারে আল মাহমুদের নাম। তিনি ছিলেন একাধারে কবি, ঔপন্যাসিক, প্রাবন্ধিক, গল্পকার, শিশুসাহিত্যিক এবং সাংবাদিক। গত ১৫ ফেব্রুয়ারি ৮২ বছর বয়সে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেন তিনি।
সাংবাদিক মাহফুজউল্লাহ
লেখক, সাংবাদিক, টেলিভিশন ব্যক্তিত্ব ও পরিবেশবিদ মাহফুজউল্লাহ। ১৯৫০ সালের ১০ মার্চ নোয়াখালীতে জন্ম। ২৭ এপ্রিল ৬৯ বছর বয়সে ব্যাংককের বামরুনগ্রাদ হাসপাতালে মারা যান।
শাহনাজ রহমতুল্লাহ
‘এক নদী রক্ত পেরিয়ে’, ‘একবার যেতে দে না আমার ছোট্ট সোনার গাঁয়’সহ অসংখ্য জনপ্রিয় গানের শিল্পী শাহনাজ রহমতুল্লাহ। বাংলা সংগীতে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে তিনি ১৯৯২ সালে একুশে পদক এবং ১৯৯০ সালে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন। ২০১৯ সালের ২৩ মার্চ ৬৭ বছর বয়সে নিজের বারিধারার বাসায় তিনি মারা যান।
শেখ আব্দুল আজিজ
বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহচর ও আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাকালীন সদস্য ছিলেন শেখ আব্দুল আজিজ। গত ৯ এপ্রিল ৯০ বছর বয়সে গুলশানের নিজ বাসায় তিনি ইন্তেকাল করেন।
সুবীর নন্দী
আধুনিক বাংলা গান ও চলচ্চিত্রের গানে যে কজন শিল্পী বাংলাদেশে তুঙ্গস্পর্শী জনপ্রিয়তা পেয়েছেন তাদের মধ্যে অন্যতম সুবীর নন্দী। চলচ্চিত্রের গানে কণ্ঠ দিয়ে পাঁচবার লাভ করেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার, ২০১৯ সালে ভূষিত হন একুশে পদকে। গত ৭ মে ৬৫ বছর বয়সে সিঙ্গাপুরের একটি হাসপাতালে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
ভাষাসৈনিক লায়লা নূর
কারা নির্যাতিত ভাষাসৈনিক ও কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের প্রথম নারী শিক্ষক ছিলেন অধ্যাপক লায়লা নূর। গত ৩১ মে ৮৫ বছর বয়সে কুমিল্লার একটি হাসপাতালে তিনি মারা যান।
মমতাজউদদীন আহমদ
স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশের নাট্য আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃত ছিলেন প্রখ্যাত নাট্যকার, অভিনেতা, ভাষাসৈনিক ও অধ্যাপক মমতাজউদদীন আহমদ। নাটকে বিশেষ অবদানের জন্য তিনি ১৯৭৬ সালে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার ও ১৯৯৭ সালে একুশে পদক লাভ করেন। ২০১৯ সালের ২ জুন ৮৫ বছর বয়সে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
মোজাফফর আহমদ
বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির সভাপতি ও মুক্তিযুদ্ধকালীন সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ছিলেন অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ। গত ২৩ আগস্ট ৯৭ বছর বয়সে তিনি মারা যান।
পণ্ডিত সত্যপ্রিয় মহাথের
একুশে পদকপ্রাপ্ত রামু কেন্দ্রীয় সীমা মহাবিহারের অধ্যক্ষ ও বৌদ্ধ ধর্মীয় গুরু ছিলেন সত্যপ্রিয় মহাথের। গত ৪ অক্টোবর রাজধানীর বিএসএমএমইউ হাসপাতালে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
সাদেক হোসেন খোকা
প্রখ্যাত মুক্তিযোদ্ধা ও বরেণ্য রাজনীতিবিদ সাদেক হোসেন খোকা গত ৪ নভেম্বর নিউইয়র্কে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। তিনি ছিলেন অবিভক্ত ঢাকা সিটির সাবেক মেয়র। ১৯৯১, ৯৬ ও ২০০১ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি তিনবার বিএনপি থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।
মঈন উদ্দীন খান বাদল
মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক ও জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের নেতা ছিলেন মঈনুদ্দিন খান বাদল। গত ৭ নভেম্বর ভারতের একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান।
ভাষাসৈনিক রওশন আরা বাচ্চু
বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে একুশে ফেব্রুয়ারিতে ১৪৪ ধারা ভঙ্গকারী প্রথম ছাত্রী দলের অন্যতম সদস্য ছিলেন সংগ্রামী রওশন আরা বাচ্চু। সে সময় তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীদের সংগঠিত করা ছাড়াও অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও হলের ছাত্রীদেরও সুসংগঠিত করেন। গত ৩ ডিসেম্বর ৮৭ বছর বয়সে তিনি প্রয়াত হন।
চিত্রগ্রাহক মাহফুজুর রহমান
নয় বার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারপ্রাপ্ত বরেণ্য চিত্রগ্রাহক মাহফুজুর রহমান খান ১৯৪৯ সালে ঢাকার লালবাগে জন্মগ্রহণ করেন। গত ৬ ডিসেম্বর ৭০ বছর বয়সে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি।
অধ্যাপক অজয় রায়
পদার্থবিজ্ঞানী, শিক্ষাবিদ, বিজ্ঞান লেখক এবং মানবাধিকার কর্মী অধ্যাপক অজয় রায় গত ৯ ডিসেম্বর রাজধানীর বারডেম হাসপাতালে ৮৪ বছর বয়সে মারা যান। ২০১২ সালে পদার্থবিজ্ঞানে অবদানের জন্য তাকে একুশে পদক প্রদান করা হয়।
স্যার ফজলে হাসান আবেদ
কর্মগুণেই বিশ্বজুড়ে পরিচিত ছিলেন ব্র্যাকের প্রতিষ্ঠাতা স্যার ফজলে হাসান আবেদ। গত ২০ ডিসেম্বর রাত সাড়ে ৮টায় রাজধানীর এ্যাপোলো হাসপাতালে ৮৩ বছর বয়সে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি।
এ ছাড়া বিদায়ী বছরে বাংলাদেশ আরও অনেক গুণী মানুষকে হারিয়েছে। রাজনীতি অঙ্গন যাদের হারিয়েছে তাদের মধ্যে অন্যতমরা হলেন, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠন ও সাবেক এমপি মঞ্জুর আহমেদ বাচ্চু মিয়া (১৮ এপ্রিল), সাবেক এমপি ও মুক্তিযোদ্ধা খন্দকার আব্দুল বাতেন (২১ জানুয়ারি), বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার আমিনুল হক (২১ এপ্রিল), বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য কবীর মুরাদ (১৫ ডিসেম্বর), ছাত্রদলের প্রতিষ্ঠাতা আহ্বায়ক কাজী আসাদুজ্জামান আসাদ (৩ এপ্রিল) প্রমুখ। শিল্প ও সাহিত্য অঙ্গন যাদের হারিয়েছে, তারা হলেন একুশে পদকপ্রাপ্ত লেখক হেলেনা খান (১৫ মার্চ), কবি হায়াৎ সাইফ (৩১ মে), কবি রবিউল হুসাইন (২৬ নভেম্বর), শিল্পী কালিদাশ কর্মকার (১৮ অক্টোবর) প্রমুখ। সংস্কৃতি অঙ্গনও এ বছর হারিয়েছে আরও অনেক গুণী মানুষকে। তারা হলেন অভিনেতা টেলিসামাদ (৬ এপ্রিল), খলিলুর রহমান বাবর (২৯ আগস্ট) মায়া ঘোষ (১৯ মে), সালেহ আহমেদ (২৪ এপ্রিল), সংগীত পরিচালক পারভেজ রব (৫ সেপ্টেম্বর), চলচ্চিত্র পরিচালক নাজমুল হুদা মিন্টু (৩ জুন), সংগীতশিল্পী খালিদ হোসেন (২২ মে), কৌতুক অভিনেতা আনিসুর রহমান (২৯ এপ্রিল), চলচ্চিত্র নির্মাতা হাসিবুল ইসলাম মিজান (১৯ এপ্রিল), চিত্রপরিচালক শাহেদ চৌধুরী (১৭ মার্চ), নির্মাতা সাইফুল আজম কাশেম (১১ মার্চ), চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্ব মুহম্মদ খসরু (১৯ ফেব্রুয়ারি), চলচ্চিত্র নির্মাতা আওলাদ হোসেন চাকলাদার (৬ ফেব্রুয়ারি), চলচ্চিত্র পরিচালক নাজমুল হুদা মিন্টু (২ জুন), অভিনেতা কালা আজিজ (২৩ নভেম্বর), চলচ্চিত্র অভিনেত্রী কনিকা মজুমদার (১৬ ফেব্রুয়ারি), অভিনেতা ও নাট্য পরিচালক হুমায়ুন সাধু (২৫ অক্টোবর), অভিনেত্রী সূচনা ডলি (৫ ডিসেম্বর), গায়ক ও সঙ্গীত পরিচালক পৃথ্বিরাজ (১৫ ডিসেম্বর), সুরকার-সংগীত পরিচালক বাসুদেব (২৯ ডিসেম্বর)। গত ১৭ ডিসেম্বর মারা যান প্রধানমন্ত্রীর সামরিক সচিব জয়নুল আবেদীন।