আল্লাহ পাক ভালোবাসা, ভালো লাগা, রাগ-হিংসা ও ঘৃণার অনুভূতি দিয়েই মানুষকে সৃষ্টি করেছেন। এই অনুভূতিগুলো জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত নিরন্তর প্রবহমান। ভালোবাসা ও ভালো লাগা কোনো একটা নির্দিষ্ট সময় কিংবা নির্দিষ্ট দিনের মধ্যে সীমাবদ্ধ করে রাখা প্রকৃতিবিরুদ্ধ। আমাদের উঠতি বয়সের তরুণ-তরুণীরা এ দিবসের ইতিহাস না জেনে, না বুঝে এর পেছনে ছুটছেন। অথচ এটি স্বাভাবিক সমাজব্যবস্থার বিপরীত; একটি সুস্থ সমাজব্যবস্থা বিকাশের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।
ভালোবাসা দিবসের প্রচলিত গল্পটি হচ্ছে রোমান সম্রাট ক্লডিয়াস ও ভ্যালেন্টাইন নামক একজন পুরোহিতকে নিয়ে। সম্রাট দ্বিতীয় ক্লডিয়াস তার সাম্রাজ্যে সৈনিকদের মধ্যে বিয়ে নিষিদ্ধ করে আইন জারি করেছিলেন। তার ধারণা ছিল, অবিবাহিত পুরুষ সৈনিক হিসেবে উত্তম। তারা রাজ্য রক্ষা ও যুদ্ধক্ষেত্রে মনোযোগী হয়। জীবনের পিছুটান না থাকায় তারা সহজে জীবন উৎসর্গ করতে পারে।’ কিন্তু সেন্ট ভ্যালেন্টাইন সম্রাটের অন্যায় সিদ্ধান্ত মেনে নিতে পারেননি। নিয়ম ভেঙে গোপনে তিনি সৈনিকদের বিয়ে দেয়া শুরু করেন। এটা গোপন থাকেনি, প্রকাশ পেয়ে যায়, তাকে বন্দী করা হয় এবং মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়। ১৪ ফেব্রুয়ারি ছিল তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার দিন। লক্ষণীয় যে, সেই ভ্যালেন্টাইনের মৃত্যুদিবসে আনন্দ উল্লাসের যে জোয়ার তা মূল ঘটনা বেদনার স্মৃতির সাথে বেমানান।
মৃত্যুদণ্ডের আগের দিন তিনি জেলখানার পরিচালকের মেয়েকে একটা চিঠি লিখেছিলেন, ভালোবাসার চিঠি। তার মৃত্যুর ২০০ বছর পরে ক্যাথলিক চার্চের পোপ এই দিনটিকে স্বীকৃতি দেন ভ্যালেন্টাইন্স ডে হিসেবে। এখানে খ্রিষ্টান ধর্ম ছাড়া অন্য ধর্মাবলম্বীদের কোনো রকমের সম্পৃক্ততা নেই। এটা ক্যাথলিক চার্চের স্বীকৃত একটা অনুষ্ঠান। এর সাথে একীভূত করা হয় স্থানীয়দের ‘লোপার ক্যালিয়া’ উৎসব। স্থানীয়রা এই দিনে কুকুর ও ছাগল জবাই করে উর্বরাশক্তির দেবীকে উৎসর্গ করত ভালো ফসলের আশায়। উৎসবের দিন স্থানীয় কুমারী মেয়েরা একটি নির্দিষ্ট গাছে তাদের নাম লিখে রাখত। অবিবাহিত যুবকেরা ওই নাম থেকে একটি মেয়ের নাম পছন্দ করত এবং পছন্দনীয় নামের ছেলেমেয়েরা পরবর্তী এক বছর একসঙ্গে বসবাস করত। এক বছর পরে তারা সিদ্ধান্ত নিত বিয়ে করবে কিনা। ক্যাথলিক চার্চ পরবর্তী সময়ে লোপারক্যালিয়া উৎসব ও খ্রিষ্টীয় ধর্মের সংমিশ্রণ করে এটাকে ভ্যালেন্টাইন দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। প্রথম দিকে যদিও এটা সীমিত পরিসরে পালিত হতো; পরবর্তী সময়ে এতে বাণিজ্যিক চরিত্র যোগ হয় ও ব্যাপকতা লাভ করে। ভ্যালেন্টাইন ডেতে বিভিন্ন ধরনের কার্ড, পোশাক, উপহার দেয়ার প্রচলন শুরু হয়। ভালোবাসা দিবস বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ডে রূপান্তরিত হয়। বিভিন্ন রকম কার্ড, উপহার সামগ্রী ও ফুলের ব্যবসা; এমনকি এই দিনের বিশেষ পোশাকু সবমিলিয়ে জমে ওঠে বিশাল বাণিজ্যের মেলা। হারিয়ে যায় সেই ভ্যালেন্টাইনের বেদনাবিধুর ঘটনার কথা।
বাংলাদেশে ১৯৯৩ সালে ‘যায়যায়দিন’ পত্রিকা ১৪ ফেব্রæয়ারি উপলক্ষে ভালোবাসা সংখ্যা নামে একটি বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করে বাণিজ্যিক ভালোবাসা দিবসের প্রবর্তন করে। আমাদের দেশেও এটা তরুণ সমাজকে প্রভাবিত করেছে। তারাও সবকিছু না জেনে ও বুঝে ঝুঁকে পড়েছে ‘ভালোবাসা দিবসের’ কর্মকাণ্ডে। আমাদের জাতীয় সংস্কৃতির সাথে সাংঘর্ষিক এই প্রবাহ তরুণ প্রজন্মকে ক্রমশই নৈতিকস্খলনের দিকে ঠেলে দেবে না, তার নিশ্চয়তা কোথায়? এ ব্যাপারে সবারই সতর্ক হওয়া প্রয়োজন।
লেখক : অধ্যাপক ও চক্ষুরোগ বিশেষজ্ঞ