দেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখার জন্য মুদ্রানীতি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মুদ্রানীতির মূল লক্ষ্য মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রেখে জিডিপির প্রবৃদ্ধিকে ত্বরান্বিত করা, যেন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়। এছাড়া মুদ্রার বিনিময় হারের স্থিতিশীলতা বজায় রাখাও মুদ্রানীতির অন্যতম কাজ। তবে মহামারী করোনার বৈশ্বিক ও অভ্যন্তরীণ প্রভাবে মুদ্রানীতির উপকরণগুলো সঠিকভাবে কাজ করছে না।
চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে মুদ্রানীতির বেশিরভাগ লক্ষ্যমাত্রাই অর্জিত হয়নি। এ সময়ে মুদ্রানীতির মৌলিক উপকরণ যেমন টাকার প্রবাহ এবং সরকারি ও বেসরকারি খাতে ঋণের জোগান খুব একটা বাড়েনি। তারপরও নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়েছে মূল্যস্ফীতি। এতে সাধারণ মানুষের কষ্ট বেড়েছে। অন্যদিকে প্রবাসী আয়ের নিম্নগতি ও অস্বাভাবিক আমদানির চাপে বৈদেশিক লেনদেনের চলতি হিসাব ও সার্বিক ভারসাম্যে তৈরি হয়েছে ঘাটতি। এতে ডলারের বিপরীতে কমে যাচ্ছে টাকার মান।
বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, এবার টাকার সরবরাহজনিত কারণে মূল্যস্ফীতি হয়নি। বরং আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলসহ বিভিন্ন পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি ও অভ্যন্তরীণ পণ্য সরবরাহে ঘাটতির কারণে মূল্যস্ফীতি হচ্ছে।
আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বৃদ্ধির জেরে গত বছরের ৪ নভেম্বর থেকে দেশেও জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো হয়। এর প্রভাবে পরিবহন ও উৎপাদন ব্যয়সহ জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছে। এতে আগে থেকে ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতায় থাকা মূল্যস্ফীতির পারদ আরও চড়েছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হালনাগাদ প্রতিবেদনে দেখা যায়, সর্বশেষ ডিসেম্বরে দেশে পয়েন্ট টু পয়েন্ট সাধারণ মূল্যস্ফীতি ৬ দশমিক শূন্য ৫ শতাংশে উঠেছে। অর্থাৎ ২০২০ সালের ডিসেম্বরে যে পণ্য ও সেবায় ১০০ টাকা খরচ হয়েছিল, গত ডিসেম্বরে সেই পণ্য ও সেবা কিনতে মানুষকে ১০৬ টাকা শূন্য ৫ পয়সা খরচ করতে হয়েছে। চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেটে মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয় ৫ দশমিক ৩ শতাংশ। অর্থাৎ মূল্যস্ফীতির হার সরকারের নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার অনেক ওপরে রয়েছে।
গত ডিসেম্বরে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে অনুষ্ঠিত ব্যাংকার্স সভায় চলতি অর্থবছরের মুদ্রানীতি ও সার্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতির ওপর একটি প্রতিবেদন উপস্থাপন করা হয়।
ওই প্রতিবেদনের ওপর আলোচনায় অংশ নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুদ্রানীতি বিভাগের নির্বাহী পরিচালক মো. হাবিবুর রহমান বলেন, বিশ্ববাজারে পণ্যমূল্যের দাম বৃদ্ধির কারণে দেশীয় বাজারেও পণ্যমূল্য বিশেষ করে খাদ্যবর্হিভূত পণ্যমূল্য ঊর্ধ্বমুখী হওয়ায় ভবিষ্যতে সাধারণ মুল্যস্ফীতি আরও বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে। ফলে অর্থবছর শেষে গড় সাধারণ মূল্যস্ফীতি লক্ষ্যমাত্রার মধ্যে রাখা চ্যালেঞ্জিং হতে পারে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুদ্রানীতি বিভাগের দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা আমাদের সময়কে বলেন, রিজার্ভ মানি, ব্যাপক মুদ্রা, সরকারি ও বেসরকারি খাতে ঋণের জোগান প্রথম ছয় মাসের জন্য নির্ধারিত সিলিংয়ের অনেক নিচে রয়েছে। এর মানে- যেসব জিনিস দিয়ে মূল্যস্ফীতিকে পরিমাপ করি সেগুলোর বাইরে অন্য কারণে হচ্ছে। অন্য কারণগুলো হলো আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যমূল্য বৃদ্ধির কারণে আমদানি খরচ বেড়েছে। আমদানি খরচ বেড়ে যাওয়ায় আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার বহিঃপ্রবাহ বেড়ে গেছে, অন্তঃপ্রবাহ কমে গেছে। আর অন্তঃপ্রবাহ কমে যাওয়ায় বৈদেশিক লেনদেনের ভারসাম্য নেতিবাচক হয়ে পড়েছে। এতে টাকার বিনিময় হারের ওপরও চাপ সৃষ্টি হয়েছে।
চলতি অর্থবছরের মুদ্রানীতিতে গত ডিসেম্বর পর্যন্ত বাজারে রিজার্ভ মুদ্রা বাড়ানোর বার্ষিক লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১৪ শতাংশ। এর বিপরীতে ওই সময় পর্যন্ত অর্জিত হয়েছে মাত্র ৬ দশমিক ৪৫ শতাংশ, যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে অর্ধেকের কম। গত অর্থবছরের একই সময় পর্যন্ত এ খাতে অর্জিত হয়েছিল রেকর্ড ২১ দশমিক ১৮ শতাংশ। মূলত এবার বৈদেশিক মুদ্রার অন্তঃপ্রবাহ কম হওয়ায় রিজার্ভ মানির প্রবৃদ্ধি তলানিতে নেমেছে। বৈদেশিক মুদ্রার অন্তঃপ্রবাহ কমার কারণ, রেকর্ড প্রায় ৫৪ শতাংশ আমদানি খরচ বৃদ্ধি। আবার প্রবাসী আয়েও নিম্নগতি রয়েছে, অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে কমেছে প্রায় ২০ শতাংশ।
এ সময়ে রপ্তানি আয় বাড়লেও তা কাক্সিক্ষত হারের চেয়ে কম রয়েছে, সাত মাসে প্রবৃদ্ধি ৩০ শতাংশ। ফলে গত ৫-৭ মাস ধরে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভও কমতির দিকে রয়েছে, গত ২ ফেব্রুয়ারি রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ৪৫ দশমিক ৪৭ বিলিয়ন ডলার। তবে রিজার্ভ মুদ্রার প্রবৃদ্ধি কম হলেও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে ব্যাপক গতি ফেরার ইঙ্গিত দিচ্ছে মানি মাল্টিপ্লেয়ার বা অর্থগুণক। ডিসেম্বর পর্যন্ত মানি মাল্টিপ্লেয়ারের ৪ দশমিক ৮৬ গুণ বাড়ার প্রত্যাশা করা হলেও বেড়েছে ৫ গুণেরও বেশি। অর্থাৎ বাজারে থাকা ১ টাকা পাঁচবার হাতবদল হয়েছে। অর্থাৎ রিজার্ভ মুদ্রার মাধ্যমে বাজারে যে টাকার জোগান গেছে, সেই টাকা ৫ গুণ হাতবদল হয়ে ব্যাপক মুদ্রা সরবরাহের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৯ দশমিক ৬০ শতাংশ। গত অর্থবছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত ব্যাপক মুদ্রার সরবরাহ বেড়েছিল আরও বেশি, ১৮ দশমিক ২৩ শতাংশ। তবে ওই সময় মানি মাল্টিপ্লেয়ার কম বেড়েছিল, ৪ দশমিক ৮৬ শতাংশ।
চলতি বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত বেসরকারি খাতে বার্ষিক ঋণপ্রবাহ বাড়ানোর লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১১ তাংশ। এর বিপরীতে অর্জিত হয়েছে ১০ দশমিক ৬৮ শতাংশ। গত অর্থবছরের একই সময়ে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ বেড়েছিল মাত্র ৮ দশমিক ৩৭ শতাংশ। অর্থাৎ করোনার শঙ্কা কেটে যাওয়ায় বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ বাড়তে শুরু করে।
অন্যদিকে ডিসেম্বর পর্যন্ত সরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ বাড়ানোর লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৩০ দশমিক ৬ শতাংশ। এর বিপরীতে বেড়েছে ২২ দশমিক ৬২ শতাংশ। অর্থাৎ সরকারি ঋণ বেড়েছে লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় অনেক কম। গত অর্থবছরের একই সময়ে এ খাতে ঋণপ্রবাহ কমেছিল ২১ দশমিক ৯৪ শতাংশ। এ সময়ে অভ্যন্তরীণ ঋণপ্রবাহের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১৪ দশমিক ১ শতাংশ, অর্জিত হয়েছে ১২ দশমিক ৩৭ শতাংশ। গত অর্থবছরের একই সময়ে এ খাতে অর্জিত হয়েছিল ৯ দশমিক ৯১ শতাংশ।
এদিকে আমদানিতে ডলারের চাহিদা ব্যাপক বৃদ্ধি পাওয়ায় গত বছরের আগস্ট থেকেই ঊর্ধ্বমুখী রয়েছে ডলারের দাম। ফলে প্রতিনিয়ত ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমে যাচ্ছে। তবে বাজারে ডলারের সরবরাহ বাড়িয়ে অর্থের মান ধরে রাখার চেষ্টা করছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, বর্তমানে আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজারে প্রতি ডলারের দাম ৮৬ টাকা। খোলাবাজারে ডলারের দাম আরও বেশি, প্রায় ৯১ টাকা। টাকার বিপরীতে ডলারের দাম বাড়ায় আমদানিকারক ও সাধারণ মানুষ উভয় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। কারণ এতে আমদানি খরচ বেড়ে পণ্যমূল্যও বেড়ে যাচ্ছে।