নতুন ১৩তম নির্বাচন কমিশন গঠনের পথে রয়েছে। যারাই নিয়োগ পান না কেন তারা নিশ্চয়ই নিজ নিজ ক্ষেত্রে প্রচুর অভিজ্ঞতা নিয়ে আসবেন। কাজেই নতুন করে নির্বাচনী ব্যবস্থাপনার সাথে পরিচিত হতে হবে। তবে তারা যদি ভালো একটি নির্বাচনের জন্য দৃঢ়সংকল্প হয়ে থাকেন তবে তাদের সামনে বেশ কয়েকটি বড় চ্যালেঞ্জ রয়েছে, সেগুলোর দিকে প্রথমেই নজর দিয়ে কৌশল উদ্ভাবন করতে হবে।
নব নিযুক্ত নির্বাচন কমিশনের সামনে রয়েছে জনগণ তথা ভোটারদের আস্থাহীনতা। কারণ বিগত দুটি জাতীয় সংসদ নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হয়নি। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে যাকে বলা হয়েছে ব্যর্থ এবং ত্রুটিপূর্ণ নির্বাচন। তার ওপরে রয়েছে দু-একটি ছাড়া সব ধরনের স্থানীয় সরকার নির্বাচনে দারুণ ব্যর্থতা। গত ইউনিয়ন কাউন্সিল নির্বাচনে ১০০-এর ওপরে নিহত হওয়ার ঘটনা, যার কোনো প্রতিকারই হয়নি। জনগণকে ধারাবাহিকভাবে ভোটকেন্দ্রবিমুখ করেছে। এসব নির্বাচনে পড়েছে জাতীয় সংসদ নির্বাচনগুলোর রেশ। সব ধরনের অনিয়মে ভরা ছিল নির্বাচনগুলো অথচ বিগত কমিশন ছিল নির্বিকার। তাদের বিদায়বেলাতে নিজেদের মধ্যে চলেছে বিবাদ। এসবই দেশের জনগণকে নির্বাচন কমিশনের মতো রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ সংস্থার ওপরে শুধু আস্থাই নষ্ট করেনি এমনকি বিমুখ করে ফেলেছে। এখানেই হবে নির্বাচন কমিশনের সবচাইতে বড় চ্যালেঞ্জ।
একুশ শতকের নির্বাচনী ব্যবস্থাপনায় প্রচুর পরিবর্তন, অন্তত তাত্ত্বিক (theoratical) পর্যায়ে এনেছে, যাকে এখন পরিচিত নির্বাচন প্রশাসন বা শাসন (Governance) হিসেবে। এই তত্ত্বে¡ বলা হয়ে থাকে যে, একটি নির্বাচনী চক্র বা সাইকেল এক জাতীয় সংসদ হতে আরেক জাতীয় সংসদ নির্বাচনে যে কারণে কমিশনের মেয়াদ সেভাবেই রাখা হয়। তবে বহু দেশে ধারাবাহিকতা বজায় রাখবার জন্য কমিশন গঠিত হয়, যা আমাদের দেশে প্রবর্তন করার সুপারিশও করা হয়েছে বহুবার।
তবে আমাদের দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি এবং নির্বাচন কমিশন নিয়ে প্রচুর বিতর্কের কারণে এমন ধারাবাহিকতার সংস্কৃতিও সম্ভব নয়। অথচ উপমহাদেশে ভারতসহ বহু দেশে ধারাবাহিকতার প্রচলন রয়েছে, যার কারণে অভিজ্ঞতার কোনো গ্যাপ থাকে না। আমি এর আগেই সুপারিশ করেছিলাম যে, পাঁচজনের কমিশনের তিনজন প্রথম ধাপে এবং দুজনকে নির্বাচনের পূর্বে নিযুক্ত করলে এক ধরনের ধারাবাহিকতা রক্ষা হতো।
যাই হোক, ওপরের বিবরণের প্রেক্ষাপটে আরও কয়েকটি চ্যালেঞ্জের বিষয় উল্লেখ করতে চাই। আমি নির্বাচন প্রশাসন বা শাসনের কথা বলেছি, যার মধ্যে নির্বাচন কমিশনের অন্যতম কাজ নির্বাচনী প্রশাসনে শক্তিশালী শরিকদের বিষয়ে। যে কোনো গণতান্ত্রিক নির্বাচনে অন্যতম শক্তিশালী এবং প্রধান শরিক রাজনৈতিক দলগুলো। কারণ রাজনৈতিক দলগুলোই নির্বাচনে প্রার্থী দিয়ে থাকে এবং প্রার্থীর সফলতার মধ্য দিয়েই সংসদ তৈরি হয় এবং একই সাথে শাসক দল এবং সংসদে প্রধান বিরোধী দল নির্বাচিত হয়। সংসদীয় গণতন্ত্রে সংখ্যাগরিষ্ঠতাই প্রধান বিষয় এবং এরই লক্ষ্যে বড় বড় দল প্রতিযোগিতামূলক রাজনীতিতে অবতীর্ণ হয়। কাজেই রাজনৈতিক দলগুলোর নিকট নির্বাচন কমিশনকে যেমন গ্রহণযোগ্য হতে হবে তেমনি নির্বাচন কমিশনকে সব দলের সাথে সর্বক্ষণিকভাবে যোগাযোগ রক্ষা করতে হয়। সে কারণে নির্বাচন কমিশনকে রাজনৈতিক দলগুলোর সার্বিক আস্থা অর্জন করতে হবে তেমনি তাদের গ্রহণযোগ্যতার বিষয়ে আশ্বস্ত করতে হবে। শুধু রাজনৈতিক দলগুলোই একমাত্র শরিক নয়। মিডিয়া, নাগরিক সমাজ, নির্বাচন বিশেষজ্ঞজন, কমিশনের জনবল, নির্বাচনকালীন সরকার এবং ভোটাররা নির্বাচন এবং কমিশনের প্রধান শরিক। নির্বাচন কমিশনকে অবশ্য সকল শরিকের সহযোগিতার প্রয়োজন রয়েছে। বিগত দিনে গত দুই কমিশনকে শরিকদের আস্থায় নিতে দেখা যায়নি। এ কারণেই ২০০৭-১২তে শরিকদের হতে নির্বাচন কমিশন যে ধরনের সহযোগিতা পেয়েছিল দুঃখজনক হলেও সত্য যে, পরে সে ধারাবাহিকতা বজায় থাকেনি। আস্থা অর্জনে ব্যর্থ হওয়াতে নির্বাচন কমিশনগুলোকে সমস্যার মোকাবিলা করতে হয়েছিল।
বিগত দশ বছরে বাংলাদেশের নির্বাচনী ব্যবস্থাপনায় যে ধস নেমেছে এবং ক্রমান্বয়ে যে ধরনের নির্বাচনী দুর্নীতি হচ্ছে সেগুলোকে রোধ করার লক্ষ্যে নির্বাচনী আইনকে শক্তিশালী করা হয়নি। ২০০৭-১২ সময়ে যে ব্যাপক সংস্কার করা হয়েছিল তার পরে নির্বাচনী মূল আইনগুলোকে আর সংস্কার করা হয়নি। আরপিও-তে নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতা বেশ সংকীর্ণ। বিগত নির্বাচনে রাতে ব্যালটবাক্স ভরার ব্যাপক অভিযোগ সত্ত্বেও কমিশন আমলেই নেয়নি। তার দুটি কারণ হতে পারে; প্রথমত নির্বাচন কমিশন আমলেই নিতে চায়নি যেসব কারণে তার ব্যাখ্যা পাওয়া যায়নি। তবে বিদায়কালে বিদায়ী প্রধান নির্বাচন কমিশনার বলেছেন যে, তিনি নিজ চোখে দেখেননি। অত্যন্ত হাস্যকর বক্তব্য।
যাই হোক, এর দ্বিতীয় কারণ হতে পারে অভিযোগের প্রেক্ষাপটে এমন অভিযোগের দৃশ্যমান কোনো প্রমাণ পাওয়া গেলেও, বিশেষ করে পুনঃগণনার মতো অনুরোধ এলেও রিটার্নিং কর্মকর্তার দস্তখতের পর নির্বাচন কমিশনের পুনঃগণনা অথবা নির্বাচন বাতিল করবার মতো পরিষ্কার আইন নেই। এর আগে দু-একটি বিরল উদাহরণ থাকলেও তা সংবিধানের ধারা ১১৯-এর আওতায় অনুল্লেখিত সর্বময় ক্ষমতার আওতায় ব্যবস্থা নিয়েছিল। তবে যেহেতু ওই সময় নির্বাচন কমিশনের এমন কাজের বিরুদ্ধে কেউ আইনের আশ্রয় নেয়নি, নির্বাচন কমিশনকে আরপিও-র এসব জায়গায় সংস্কারের প্রয়োজন রয়েছে। ২০১১ সালে আরপিওসহ আরও কিছু সংস্কারের লিখিত আকারে সুপারিশ করা হয়েছিল। কিন্তু বিগত দুই কমিশন এমন সুপারিশ হয়তো খুলেও দেখেনি। নবনিযুক্ত কমিশন আইনের প্রয়োজনীয় সংস্কারে হাত দেবে বলে আশা করি।
নির্বাচনকালে যত জনবলের প্রয়োজন তার প্রায় অর্ধেক বিভিন্ন বাহিনীর নিরাপত্তা সদস্য। অথচ এদের কাজের বিশদ বিবরণ এবং নিরাপত্তা বিন্যাসের (Security Deployment) ম্যানুয়াল না থাকার কারণে নিরাপত্তায় নিয়োজিত সদস্যদের সঠিকভাবে নির্বাচন কমিশন ও রিটার্নিং অফিসারের পক্ষে সময়মতো এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হয় না। ম্যানুয়েলের অভাবে দায়িত্ব নিরূপণ এবং বেআইনি কর্মকাণ্ডে অথবা কর্তব্যে অবহেলার বিরুদ্ধে নির্বাচন কমিশন কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নিতে পারে না। বিদায়ী কমিশনের সময় অনুষ্ঠিত স্থানীয় নির্বাচনের সময়কালে, বিশেষ করে ইউনিয়ন কাউন্সিল নির্বাচনে প্রায় ১০০ জনের ওপরে নিহত হওয়ার মতো ঘটনা ঘটলেও নির্বাচন কমিশন দায়িত্ব নিরূপণে অপারগতা প্রকাশ করে এসব হতাহতের দায়দায়িত্ব প্রার্থীদের ওপরে চাপিয়ে দায় সেরেছিল। আশা করি যে এ ধরনের অবস্থা থেকে বের হতে নবনিযুক্ত কমিশন একটি ‘সিকিউরিটি ম্যানুয়াল’ তৈরি করার কাজ হাতে নেবে।
নির্বাচনী অভিযোগের নিষ্পত্তি করা নির্বাচনী ব্যবস্থাপনা এবং নির্বাচনী প্রশাসনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব, বিশেষ করে আমাদের মতো রাজনৈতিক ও নির্বাচনী নেতিবাচক সংস্কৃতির দেশে। নির্বাচনী বা নির্বাচনকালের অভিযোগের, যেভাবে কমিশনে উত্থাপিত হোক, সমাধান না করলে নির্বাচন কমিশনের কাজের এবং উদ্দেশ্যের স্বচ্ছতা নিয়ে জনমনে সন্দেহের উদ্রেক হবে। অভিযোগ যে কোনো পর্যায়ে যে কোনো উপায়ে উত্থাপিত হতে পারে, মৌখিক অথবা লিখিত অথবা পরোক্ষভাবে বিভিন্ন মিডিয়ার মাধ্যমে। কাজেই নির্বাচন কমিশনকে উত্থাপিত অথবা গোচরীভূত হওয়া সব অভিযোগকে আমলে নেওয়া অথবা না নেওয়া সেগুলোর নিষ্পত্তির ধরন ইত্যাদির জন্য নির্ধারিত রীতি তৈরি করা উচিত। এসব অভিযোগ স্বচ্ছভাবে উত্থাপন এবং নিষ্পত্তির নিমিত্তে বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশনের একটি ‘কমপ্লেইন ম্যানুয়াল’ প্রস্তুতকরত প্রচার হওয়া প্রয়োজন।
বিশেষ করে দল, প্রার্থী এবং ভোটারদের কাছে নির্বাচন কমিশনের স্বচ্ছতার জন্য এ বিষয়ের ওপরে ম্যানুয়ালের বিকল্প নেই। নির্বাচন কমিশন তাদের গ্রহণযোগ্যতা প্রতিষ্ঠা করার নিমিত্তে এবং নির্বাচনী ব্যবস্থাপনায় হারানো আস্থা পুনরুদ্ধারের পথে আরেকটি বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ ইভিএম (EVM)-এর গ্রহণযোগ্যতা, বিশেষ করে রাজনৈতিক দলগুলোর নিকট। বহু অর্থ ব্যয়ে, প্রযুক্তির সন্নিবেশ ঘটাতে এই অত্যাধুনিক ইভিএম বাংলাদেশে তৈরি হলে এত দিনেও এর গ্রহণযোগ্যতা এবং বিশ্বাসযোগ্যতা বাড়াতে পারেনি। ইভিএম-এর বিরুদ্ধে প্রধান অভিযোগ এক মার্কার ভোট অন্য মার্কায় চলে যাওয়ার। এ ধরনের অভিযোগ ঠেকাতে ভারতে যোগ করা হয়েছিল ‘পেপার ট্রেল অডিট’ যা ভিভিপিটি (V.V.P.T) হিসেবে পরিচিত। বাংলাদেশেও এর সংযোজনের দাবি উঠলেও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
অপরদিকে, মিডিয়ার খবরে প্রকাশ, ইভিএম সংরক্ষণ করা নিয়ে বিপাকে রয়েছে নির্বাচন কমিশন এবং বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ তৈরি হয়েছে। ইভিএম একটি আধুনিক পদ্ধতি কিন্তু যে চুরি ঠেকাতে এ মেশিনের প্রবর্তন তা সম্ভব হচ্ছে না। বুথ দখল অথবা ইভিএম দখল অথবা সিল দখল করে ভোটে অনিয়ম অথবা ভোটারদের ভোট দিতে না দেওয়ার মতো বিষয় নির্বাচন কমিশন বন্ধ না করতে পারলে অত্যাধুনিক কোনো প্রযুক্তিই নির্বাচনকে স্বচ্ছ করতে পারবে না।
যাই হোক বিগত এক দশকে বাংলাদেশের নির্বাচনী ব্যবস্থাপনায় যে ধস নেমেছে সে অবস্থা হতে স্বচ্ছ ব্যবস্থাপনায় ফিরিয়ে আনাই নবনিযুক্ত কমিশনের সকল উদ্যোগ হতে হবে। আশা করি নবনিযুক্ত কমিশন এসব বিষয় গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করবে।
ড. এম সাখাওয়াত হোসেন : নির্বাচন বিশ্লেষক, সাবেক সামরিক কর্মকর্তা এবং এসআইপিজির সিনিয়র রিসার্চ ফেলো (এনএসইউ)