মহামারী করোনার প্রভাবে গত দুই বছর ধরে কর্মজীবী মানুষের আয় কমেছে। বেশির ভাগেরই আয় আগের অবস্থায় ফিরে আসেনি। এর মধ্যে ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’ হয়ে আপতিত হয়েছে নিত্যপণ্যের উচ্চমূল্য। লক্ষণীয়, কয়েক সপ্তাহ ধরে নিত্যপণ্যের দাম অব্যাহতভাবে বেড়েই চলেছে। প্রধান খাবার চাল-ডাল-তেল-সবজির দাম বাড়ছে হু হু করে। জিনিসপত্রের মূল্য ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রাখতে সরকার টিসিবি এবং ওএমএসের মাধ্যমে এসব পণ্য বিক্রি করলেও কোনো প্রভাব পড়ছে না বাজারে। পদক্ষেপগুলো খানিকটা লোক দেখানোর পর্যায়ে চলে গেছে বলেই মনে হয়।
চাল আমাদের প্রধান খাদ্য। অপরিহার্য এই খাদ্যদ্রব্যের দাম গত সপ্তাহে খুচরা বাজারে কেজি-প্রতি দুই টাকা বেড়েছে। এক বছর আগে একই সময়ের তুলনায় কেজি-প্রতি চালের দাম বেড়েছে পাঁচ থেকে ১৫ টাকা। পাশাপাশি ডালের দাম গত বছরের তুলনায় বেড়েছে ১০ থেকে ৩৫ টাকা পর্যন্ত। ফলে দিশেহারা হয়ে পড়েছে মানুষজন। বিশেষ করে নিম্নমধ্যবিত্ত এবং নিম্ন আয়ের মানুষ অসহায় বোধ করছেন। বাজার করতে গিয়ে শূন্য হাতে ফিরতে হচ্ছে তাদের। বিপুল এ জনগোষ্ঠীর জীবন চালানোই এখন দায় হয়ে উঠছে।
সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের শুধু চালের বাজারের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, রাজধানী ঢাকায় মোটা চাল বিক্রি হচ্ছে ৫০-৫২ টাকা কেজি দরে। অথচ ২০২১ সালের একই সময়ে এ চালের দাম ছিল ৪৩ থেকে ৪৫ টাকা কেজি। কেজি-প্রতি দাম বেড়েছে পাঁচ থেকে সাত টাকা। মাঝারি মানের পাইজাম চালের কেজি ৫৫-৫৮ টাকা। এক বছর আগেও এ চাল বিক্রি হতো ৪৫-৪৮ টাকা কেজি দরে। এ ছাড়াও বাজারে ভালো মিনিকেট চাল খুচরা বিক্রি হচ্ছে ৬৫-৭০ টাকা কেজি। পাইকারি দর ৬২ টাকা কেজি। মাঝারি মানের মিনিকেট বিক্রি হচ্ছে ৬২-৬৫ টাকায়, পাইকারি দর ৬০ টাকা। এ ছাড়াও নিম্নমানের মিনিকেট চাল বিক্রি হচ্ছে ৬০ টাকা কেজিতে। গত বছর এ চাল সর্বোচ্চ ৫৪-৫৮ টাকা কেজিতে বিক্রি হয়েছে। ভালো মানের নাজিরশাইল খুচরা বিক্রি হচ্ছে ৭৫ টাকা। মাঝারি মানের নাজিরশাইল ৭০ টাকা এবং নিম্নমানের নাজিরশাইল বিক্রি হচ্ছে ৬৮-৭০ টাকা কেজি দরে। গত বছর এ চাল বিক্রি হয়েছিল ৫৮-৬৫ টাকা কেজিতে। অন্য দিকে কাটারিভোগ ১০০ টাকা এবং চিনিগুঁড়া চাল বিক্রি হচ্ছে ৯০-৯৫ টাকা কেজিতে।
দুই মাস ধরে চালের দাম বাড়তি। গত সপ্তাহে নতুন করে আরেক দফা বেড়েছে। অথচ চলতি বছর দেশে প্রাকৃতিক দুর্যোগে ফসল বিনষ্ট হয়নি। তারপরও চাল-ডালসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বেড়েই চলেছে। আমাদের যে পরিমাণ ধান প্রয়োজন গত অর্থবছরেও এর কাছাকাছি ধান উৎপাদন হয়েছে। তারপরও চালের দাম বাড়ছে কেন, সেই প্রশ্ন সবার। কিন্তু সরকারের তরফ থেকে এ বিষয়ে কোনো সন্তোষজনক উত্তর জনগণ পাচ্ছে না।
শুধু চাল নয়, প্রতিটি নিত্যপণ্যের দামে ‘আগুন লেগেছে’। নয়া দিগন্তে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, শুক্রবার বাজারে প্রতি কেজি টমেটোর দাম ছিল ৪০-৫০ টাকা, শিম ৫০-৬০ টাকা, বেগুন (গোল) ৮০ টাকা, ফুলকপি ও বাঁধাকপি প্রতিটি সর্বোচ্চ ৬০ টাকা, গাজর প্রতি কেজি ৬০ টাকা, চালকুমড়া একটি ৬০ টাকা, লাউ আকার ভেদে ৭০-১০০ টাকা, মিষ্টি কুমড়ার কেজি ৫০ টাকা, কচুর লতি ৬০ টাকা ও পেঁপের কেজি ৪০ টাকা, ব্রয়লার মুরগির কেজি ১৬০-১৭০ এবং সোনালি মুরগি ২৬০-২৯০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়েছে। লাল ডিমের ডজন ছিল ১১৫-১২০ টাকা, হাঁসের ১৯৫ টাকা, দেশী মুরগির ডিমের ডজন ২১০ টাকা। সোনালি মুরগির ডিমের ডজন বিক্রি হয় ১৮০ টাকায়। গরুর গোশতের কেজি ছিল ৬৪০-৬৫০ টাকা; গত সপ্তাহে ছিল ৬০০-৬২০ টাকা। খাসির গোশতের দর ছিল ৮৫০-৯৫০ টাকা কেজি। একইভাবে সব ধরনের মাছের দাম বেড়েছে।
অর্থনীতিবিদদের মতো আমরাও মনে করি, টিসিবির মাধ্যমে সীমিত আয়ের মানুষের কাছে নিত্যপণ্যের সরবরাহ বাড়িয়ে বাজারদর নিয়ন্ত্রণে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারে সরকার; কিন্তু পরিস্থিতি দেখে মনে হওয়া স্বাভাবিক, এমন ইচ্ছা আদৌ রয়েছে কি না। সার্বিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে এ কথা বলা অসঙ্গত নয় যে, দেশে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা দুর্বল হওয়ায় কর্তৃপক্ষের জবাবদিহির মনোভাব কমে গেছে। ফলে নিত্যপণ্যের দাম বেড়ে নাগরিকদের দুর্ভোগ অনেক বাড়লেও গা করছেন না কেউ।