নামকরা উচ্চশিক্ষিত মানুষের জীবনীভিত্তিক লেখায় দেখা যায়, তারা তাদের জীবনগঠন ও পড়ালেখার শক্ত ভিত্তি গঠনে শিক্ষকদের অবদানের কথা তুলে ধরেন। একজন শিক্ষক শিক্ষার্থীদের অন্তরে জ্বালিয়ে তুলতে পারেন জ্ঞানের আলোক, জ্ঞানতৃষ্ণা। সামনের আলোকিত পথের দিকনির্দেশনাও তাদের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা পেয়ে থাকেন। তাই বিদ্যালয়ে সুযোগ্য ও দক্ষ শিক্ষকের চাহিদা সবসময় থেকেই যাবে।
স্কুল আছে, কম্পাউন্ড আছে, বেঞ্চ, টেবিল, চেয়ার আছে, খেলার মাঠ, লাইব্রেরি, শিক্ষার্থীও আছে কিন্তু শিক্ষক নেই – এমন বিদ্যালয় চলবে কি? আবার চাহিদানুরূপ শিক্ষক নেই, প্রধান শিক্ষকের পদশূন্য, সেখানেও কি লেখাপড়া সঠিক পদ্ধতিতে চলবে, না ছাত্ররা ক্লাসে আসবে, না শিক্ষা সম্পূর্ণ হবে বা প্রত্যাশিত রেজাল্ট হবে? এর উত্তর অবশ্য অবশ্যই ‘না’। ড্রাইভার ছাড়া গাড়ি চলে না, আবার গাড়ির কলকব্জা ঠিক না থাকলেও গাড়ি চলে না। শিক্ষাও তেমনি। শিক্ষক ছাড়া শিক্ষা হয় না। শিক্ষা হচ্ছে ‘গুরুমুখী’।
সংবাদপত্রে বিভিন্ন সময় বিদ্যালয়ে শিক্ষকসঙ্কটের বিষয় নিয়ে রিপোর্ট হয়। অনেক স্কুলেই কম-বেশি শিক্ষকসঙ্কট থাকে। সংশ্লিষ্ট বিষয়ে শিক্ষক না থাকায় বা নিয়োগ না দেয়ায় শিক্ষার্থীরা সঙ্কটে নিপতিত হয় এবং কোনোক্রমে জোড়াতালি দিয়ে পড়িয়ে বা না পড়িয়েই শিক্ষার্থীদের পাবলিক পরীক্ষায় বসিয়ে দেয়া হয়। যাদের অর্থবিত্ত আছে তারা স্কুলের সংশ্লিষ্ট বিষয়ে শিক্ষক আছে না আছে সেটা বিবেচনা না করে বাইরে প্রাইভেট পড়িয়ে অভিভাবকরা বিষয়টা পুষিয়ে নেন। প্রাইভেট পড়তে যাদের সামর্থ্যরে অভাব, মূলত তাদের সমস্যাটাই বেশি।
বেসরকারি স্কুলে সমস্যাটা থাকলে খোঁজখবর, তদারকির ব্যবস্থা নেই। সরকারি স্কুলে তা থাকা দরকার। কিন্তু ‘দরকার’টা অবহেলিত থেকে যায়। যেমন, পত্রিকায় প্রকাশিত এক রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে, পার্বত্য জেলা খাগড়াছড়ির রামগড় সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ে বিষয়ভিত্তিক শিক্ষকসঙ্কটসহ প্রধান শিক্ষকের পদও শূন্য। ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে সংশ্লিষ্ট বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক অন্যত্র বদলি হয়ে যাওয়ার পর থেকেই এই পদশূন্যতা। শূন্য পদ এখনো পূরণ না হওয়ায় শিক্ষাকার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। ওই বিদ্যালয়ের ২৭টি শিক্ষক পদের মধ্যে নাকি ১৯টিই বর্তমানে শূন্য। বিষয়ভিত্তিক গণিত, জীববিজ্ঞান, কৃষি, ভ‚গোল, চারুকলা বিষয়ে নাকি শিক্ষক নেই।
শিক্ষার্থীরা কী পড়ছে তাহলে! এমনিতেই গণিতসহ সায়ন্সের বিষয়গুলো খুবই হার্ড। শিক্ষক ছাড়া পাঠদান অসম্ভব। আর চারুকলা সাবজেক্টে সরকারি বিভিন্ন স্কুলে শিক্ষক থাকলেও বহু বেসরকারি স্কুলে এ শিক্ষকের কোনো অস্তিত্বই নেই। খোদ রাজধানীতেও কিছু স্কুলে এ অবস্থা। অথচ বেতনভাতা সবই ঠিকঠাক নেয়া হচ্ছে।
এক দিকে শিক্ষিত যুবসমাজের বেকারত্ব অন্য দিকে শিক্ষকসঙ্কট– এর মাঝে ছাত্রছাত্রীদের অনিশ্চিত ভবিষ্যতের জটিল অঙ্ক। প্রতি বছর বিপুলসংখ্যক উচ্চশিক্ষিত নাগরিক কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সার্টিফিকেট নিয়ে বের হচ্ছে। নিয়োগ পরীক্ষায় প্রার্থী বা পরীক্ষার্থীদের প্রচণ্ড ভিড় জানান দেয়, বেকারত্বের দুঃসহ যন্ত্রণা তাদের কতটা পেরেশানিতে রেখেছে। লাখ লাখ বেকারের দেশে সরকারি চাকরি সোনার হরিণ। সেটা ধরতে ইচ্ছুকরা ছুটে বেড়াচ্ছে আর সরকারি ‘কর্মখালি’ বিষয়টা মেলে না। একটা সরকারি চাকরি যেমনই হোক, হোক টিচিংয়ের মতো পেশা সেটা পেতে বিজ্ঞপ্তি থেকে পরীক্ষা, ফলাফল, নিয়োগ পর্যন্ত আসতে তিন থেকে চার বছর সময় ব্যয় হচ্ছে। সবই লম্বা প্রসেস। ফলে শিক্ষকপদ শূন্য থাকছে দীর্ঘ দিন। এই দীর্ঘ সময়ে যথাযথ পড়াশোনা ছাড়াই শিক্ষার্থীরা ক্লাস ডিঙ্গিয়ে প্রাইমারি, ক্লাস এইট আর মাধ্যমিকের মতো চূড়ান্ত পরীক্ষায় বসছে। তারা কী পড়ছে, কী শিখছে আর কী পরীক্ষা দিচ্ছে তা আল্লাহ তালাই ভালো জানেন। পরীক্ষায় রেজাল্ট খারাপ হলে তার দায় স্কুল কর্তৃপক্ষ নেয় না, দায় সংশ্লিষ্টজনের। আর এভাবে খুঁড়িয়ে চলা শিক্ষা জাতিকে কী দেবে? মাধ্যমিকে বেশির ভাগ ছাত্রছাত্রী ফেল করে বিজ্ঞান, গণিত, আইসিটি ও ইংরেজি বিষয়ে।
কোচিং সেন্টারগুলো ছাত্রছাত্রীদের পড়ায় উচ্চ বেতনে। যাদের সামর্থ্য আছে তারা এটা কভার করে নেয়। যাদের সেই সামর্থ্য নেই, তারাই ডোবে। এভাবে চলছে। খোঁজ নিলে দেখা যাবে, সমস্যাটা শুধু রামগড় সরকারি স্কুলের নয়, বহু সরকারি, বেসরকারি স্কুল এবং কলেজেরই। নির্ধারিত শিক্ষক না থাকায় হাইস্কুলের বাংলা ইংরেজি গ্রামার ক্লাসে মাঝে মাঝে প্রক্সি দিচ্ছে বিজ্ঞানের শিক্ষক, ইসলামিয়াত পড়াচ্ছে সমাজের শিক্ষক, ভ‚গোল বুঝাবার কেউ নেই, বায়োলজি কেমেস্ট্রি বুঝতে কোনো কলেজের ল্যাব সহকারীর কাছে ছুটছে প্রাইভেট পড়তে। এমন অনেক সঙ্কট নিয়েই শিক্ষার্থীদের শিক্ষাবর্ষ শেষ হয়ে যায়।
যারা নামকরা বেসরকারি স্কুলে পড়ে তাদের এই সমস্যা নেই, থাকলেও কম। সেখানে পড়াশোনার খরচ বেশি, শিক্ষকরাও উচ্চশিক্ষিত, সর্বোপরি প্রাইভেট টিউশন শিক্ষার্থীদের অনেকটা এগিয়ে দেয়। সরকারি স্কুলগুলোর শিক্ষকরা অবশ্যই দক্ষতার পরীক্ষায় উত্তীর্ণ, সুনাম অর্জনকারী। কিন্তু পদ খালি থাকলে কী করে পড়াশোনা সচল থাকবে, ছাত্ররাই বা কী শিখবে!
তাই সরকারি স্কুলে শিক্ষক পদের শূন্যতা পূরণ করতে হবে জরুরি ভিত্তিতে। দরকার হলে নিয়োগ পরীক্ষা নিয়ে সম্ভাব্য দ্রুততম সময়ে পদ পূরণ করা আবশ্যকীয়। তিন চার বছর ধরে লম্বা সময় নিয়ে শিক্ষক নিয়োগ হতাশাজনক। স্থানীয় নাগরিকদের স্থানীয় সরকারি বিদ্যালয়ে নিয়োগ দেয়া হলে বদলিজনিত শূন্যতার সমস্যার একটা সমাধান হতে পারে।