রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ১০:২৩ অপরাহ্ন

রমজানের আগে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ করা জরুরি

শফিকুল ইসলাম
  • আপডেট টাইম : রবিবার, ১৩ মার্চ, ২০২২
  • ১৩৭ বার

নিত্যপণ্যের দাম বৃদ্ধি নিয়ে সরকার ও আমরা- সবাই উদ্বিগ্ন। যেভাবে প্রতিদিন পণ্যের দাম বৃদ্ধি পাচ্ছে, তা কোনোভাবেই কাম্য নয়। সরকার চেষ্টা করে যাচ্ছে। এর পরও নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হচ্ছে না। জীবনযাত্রায় আমাদের নানা জিনিসের প্রয়োজন হয়। এর মধ্যে চাল, তেল, পেঁয়াজ অন্যতম। চাল, ডাল, আলু, আদা ও রসুন, পেঁয়াজসহ ১৪টি পণ্যর দাম বৃদ্ধি পাচ্ছে কয়েকদিন ধরে। তা মানুষকে বিপদে ফেলে দিয়েছে। যে পেঁয়াজ ছিল ৩০-৩৫ টাকা, এখন তা ৭৫ টাকা। নতুন পেঁয়াজ বাজারে। পেঁয়াজের ঘাটতি নেই। তবুও দাম বেড়েই চলছে।

পর্যাপ্ত উৎপাদনের পরও বাড়ছে আলুর দাম। তিন থেকে চার দিনের ব্যবধানে আলুর কেজিতে দাম বেড়েছে পাঁচ থেকে ছয় টাকা। চার দিন আগে বিক্রি হওয়া ১৫ টাকার সাদা আলুর দাম এখন ২০ থেকে ২২ টাকায় উঠেছে। আর লাল আলু বিক্রি হচ্ছে ২২ থেকে ২৫ টাকা। তা তিন থেকে চার দিন আগে পাওয়া যেত ১৮ থেকে ২০ টাকায়। কিন্তু কৃষি মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী দেশে আলুর চাহিদা রয়েছে ৮০ লাখ থেকে ৯০ লাখ টন। ২০২১ সালে উৎপাদন হয়েছে এক কোটি ছয় লাখ টন। অর্থাৎ আলুর দাম বৃদ্ধি পাওয়ার কোনো কারণ নেই। এর মানে, সিন্ডিকেট করে অসাধু ব্যবসায়ীরা দাম বাড়িয়েছে।

তেলের মূল্যে ঊর্ধ্বগতিতে নিম্নআয়ের মানুষের জীবন ওষ্ঠাগত। কারণ পাঁচ লিটার বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম ৮৭০ টাকা। ওই তেল গত বছর ৫৩০ টাকায় কিনেছি। বাজারে এখনো অনেক নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে থাকলেও পেঁয়াজ ও তেলের দাম লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। অস্বীকার করার উপায় নেই, আমাদের জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন হয়েছে। করোনায় নিম্নআয়ের মানুষ যা আয় করছে, এর পুরোটাই জীবনধারণের জন্য ন্যূনতম খাদ্যদ্রব্য কিনতেই শেষ হয়ে যাচ্ছে। স্বাস্থ্য, চিকিৎসা, শিক্ষা ইত্যাদির জন্য ব্যয় করার মতো অর্থ তাদের হাতে থাকছে না।

নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধি নিম্নআয়ের মানুষের জন্য কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ একটিই। তা হচ্ছে বাজারের ওপর কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। ভোজ্যতেলের কোনো ঘাটতি না থাকলেও ডিলারদের কারসাজিতে বাজারে সয়াবিন তেলের ‘কৃত্রিম সংকট’ তৈরি হয়েছে। অর্থনীতির সংজ্ঞা অনুযায়ী বাজারে চাহিদা ও জোগানের ওপর দব্যমূল্য নির্ভর করে। কিন্তু এ সংজ্ঞা এখন অনেক ক্ষেত্রে কাজ করছে না।

সরকারি মনিটরিং, পত্রিকায় লেখালেখি, আলোচনা, সমালোচনা ও পরামর্শÑ বহু কিছু হলেও ব্যবসায়ীরা তেলের দাম নিয়ে নানা কারসাজি করেই যাচ্ছে। বরং অনেক ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের মাধ্যমে ভোজ্যতেল গুদামজাত করে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে আমাদের দুর্ভোগ বাড়িয়ে দিয়েছে। তবে আন্তর্জাতিক সংকট কিছুটা দায়ী।

ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করে বিভিন্ন অজুহাতে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়িয়ে সাধারণ মানুষকে বিপদে ফেলছে। গরিব মানুষের কথা একবারও চিন্তা করে দেখছে না। একবার যে পণ্যের দাম বাড়ে, তা আর কমে না। এটিই এখন স্বাভাবিক কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসা একান্ত কাম্য। অন্যথায় ভবিষ্যতে আরও খারাপ পরিস্থিতি আসতে পারে। তাই সরকারকে সতর্ক থাকতে হবে।

দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে বেকায়দায় পড়েছে সাধারণ মানুষ। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের অত্যধিক দাম ও ক্রয়ক্ষমতার বাইরে হওয়ায় কিছু পরিবারের প্রয়োজনীয় খাদ্যসামগ্রী কিনতে পারছে না। তবে এ পরিস্থিতির জন্য মনে হচ্ছে নিয়মিত বাজার মনিটরিং না হওয়া এবং ব্যবসায়ীদের অযৌক্তিক মুনাফা লোটার বিষয়টিকে দায়ী করেছেন ভোক্তারা। এ ক্ষেত্রে জেলার প্রতিটি বাজার ও হাটে প্রশাসনিক নজরদারি বাড়ানোর ওপর জোর দেওয়া উচিত।

সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হচ্ছে, দেশে পর্যাপ্ত খাদ্যপণ্যের মজুদ রয়েছে। কিন্তু বাজারে নিত্যপণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে নেই। আর নিয়ন্ত্রণে রাখার দায়িত্বে থাকা বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের মনিটরিং সেলের তেমন কোনো তৎপরতাও নেই। মাঝে মধ্যে দেখা যায়। জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের নৈতিক দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করতে হবে। অনেক সময় অভিযান চালিয়ে অনেক প্রতিষ্ঠানকে জরিমানা করা হলে পণ্যের দাম বৃদ্ধি এবং ভেজাল পণ্যের সংখ্যা কমছে না। সরকারের কার্যক্রম আরও গতিশীল ও তৎপর হতে হবে।

রমজান মাস এলেই বাড়ে নিত্যপণ্যের দাম। এবারও ব্যতিক্রম হবে না। রমজানের শুরুতে রাজধানীর কারওয়ান বাজার, কাঁঠালবাগান বাজার ও হাতিরপুল বাজারে গবেষণা করলে দেখা যাবে কীভাবে রমজানে পণ্যের দামে গরমিল হয়। রমজানের শুরুর এক সপ্তাহ আগে ও পরে দামের পার্থক্য বেশ।

রমজান শুরু হলেই আমাদের দেশে পণ্যের দাম বাড়ে। এটি নতুন নয়। তবে শুনেছি অন্য দেশে বিভিন্ন উৎসবে দাম কমে। পবিত্র রমজান উপলক্ষে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোয় রমজানের সব পণ্য এবং পবিত্র বড়দিন উপলক্ষে ইউরোপ ও আমেরিকার দেশগুলোয় পণ্যবাজারে বিশাল মূল্যহ্রাস করে। কিন্তু আমাদের দেশে পরিস্থিতি পুরোপুরি উল্টো। রমজান উৎসব এলেই আমাদের দেশের খুচরা থেকে মাঝারি ও বড় বড় ব্যবসায়ী ভোক্তাদের পকেট কাটার উৎসবে মেতে ওঠে। ফলে জনগণের নাভিশ্বাস ওঠে। এই দাম বৃদ্ধির সংস্কৃতি থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। এ ক্ষেত্রে সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থার তদারকি নিয়মিত করতে হবে।’

রমজানের শুরুতেই চাল, ডাল সবজিসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের বাজারে দাম বেড়ে যায়। করোনার এই সংকটে রমজান ঘিরে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বৃদ্ধি বন্ধ থাকবে না। জিনিসের দাম বৃদ্ধিতে হতাশ হয়ে পড়ে সাধারণ মানুষ। বিক্রেতারা নানা অজুহাত বা সংকটে দেখিয়ে থাকে। কিন্তু এই অজুহাত থেকে কীভাবে বের হওয়া যায়, এর উপায় খুঁজে বের করতে হবে। সরকারকে ওই বিষয়ে বেশি উদ্যোগী হতে হবে। রমজান আসার আগে সংশ্লিষ্ট দপ্তরের অনেক কাজ করতে হবে- যাতে অসাধু ব্যবসায়ীরা পণ্যর দাম না বাড়াতে পারে। রমজানে দেশের সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম নির্ধারণ করে একটু ভালোভাবে বেঁচে থাকার নিশ্চয়তা প্রদানে সরকার ও ব্যবসায়ীদের সদিচ্ছাই যথেষ্ট ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে বলে মনে করছি।

প্রয়োজনীয় সচেতনতা ও যথেষ্ট অভিজ্ঞতা না থাকায় দেশের অধিকাংশ ক্রেতা-ভোক্তা তাদের অধিকার, দায়িত্ব-কর্তব্য সম্পর্কে সচেতন নন। ফলে সহজেই অসাধু ব্যবসায়ীরা এভাবে পণ্যর দাম বাড়িয়ে অনেক লাভ করে নিয়ে যায়। তা কোনোভাবেই যৌক্তিক নয়। অধিকন্তু অধিকাংশ ভোক্তা আসল-নকল চিহ্নিত করে সঠিক পণ্য পছন্দ করতে পারেন না। ফলে তারা অনেক সময় বিপাকে পড়ে যান। তাই ব্যাপক সচেতনতামূলক কার্যক্রম ও অনেক প্রচার করতে হবে- যাতে সাধারণ নাগরিক জানতে পারে, তাদের কীভাবে সঠিক পণ্য কিনতে এবং কোনো অন্যায় দেখলে সেখানে প্রতিবাদ করতে হবে। ব্যবসা-বাণিজ্য সংক্রান্ত যে কোনো নীতিনির্ধারণীমূলক ক্ষেত্রে ভোক্তাদের অংশগ্রহণ বাড়াতে হবে- যাতে তাদের অধিকারের কথা তুলে ধরতে পারেন।

নিম্ন ও মধ্যম আয়ের মানুষ আকাশছোঁয়া দামের মধ্যে ভর্তুকি মূল্যে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য কিনতে রাজধানীতে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) ট্রাকে ভিড় করছে। পবিত্র রমজান সামনে রেখে রোববার রাজধানীতে মাসব্যাপী নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য বিক্রির কার্যক্রম শুরু করেছে টিসিবি। কর্মসূচির অংশ হিসেবে রাষ্ট্র পরিচালিত সংস্থাটি রাজধানীতে পেঁয়াজ, মটরশুঁটি, খেজুর, চিনি, মসুর ডাল ও সয়াবিন তেল দুটি ধাপে বিক্রি করবে। প্রথম ধাপ ২৪ মার্চ পর্যন্ত চলবে এবং দ্বিতীয় ধাপটি ২৭ মার্চ থেকে শুরু হয়ে চলবে আগামী ২৪ এপ্রিল পর্যন্ত চলবে। এটি অবশ্যই প্রশংসনীয় উদ্যোগ। দুই সিটি করপোরেশনের আওতাধীন প্রতিটি ওয়ার্ডে ডিলার ও দেড়শ ট্রাকের মাধ্যমে ভর্তুকি দেওয়া পণ্য বিক্রি করা হচ্ছে। এভাবে সরকারের এগিয়ে আসতে হবে- যাতে সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা পূরণ হয়। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি নিয়ে রাজনৈতিক বক্তব্য প্রত্যাহার করে সব রাজনৈতিক দলের উচিত সরকারকে সঠিক পরামর্শ দিয়ে সাধারণ মানুষের পাশে দাঁড়ানো।

 

শফিকুল ইসলাম : শিক্ষক ও সাবেক সভাপতি, শিক্ষক সমিতি, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়, ত্রিশাল, ময়মনসিংহ

নিউজটি শেয়ার করুন..

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো খবর..
© All rights reserved © 2019 bangladeshdailyonline.com
Theme Dwonload From ThemesBazar.Com