সাবেক রাষ্ট্রপতি বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহমদ ইন্তেকাল করেছেন (ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। আমার দোয়ায় যদি কোনো কাজ হয় তাহলে আল্লাহকে বলবো তার সকল পাপ, অন্যায়, ভুলত্রুটি ক্ষমা করে তাকে জান্নাতুল ফেরদাউসে দাখিল করতে।
রাষ্ট্রের ‘প্রেসিডেন্ট’ পদটি অনেক উঁচু, এই ইংরেজি শব্দটির অর্থ ‘রাষ্ট্রপতি’। ‘প্রেসিডেন্ট’ শব্দের ভিন্ন অর্থও আছে ‘সভাপতি’। ব্যবসায়িক কোম্পানি, ক্লাব-সমিতি এসবের প্রেসিডেন্টরা ‘সভাপতি’। কিন্তু রাষ্ট্রের যিনি প্রেসিডেন্ট তিনি কোনোভাবেই ‘সভাপতি’ নন। বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি ‘মহামান্য’। বলা হয়, দেশের সবচেয়ে সহজ সরল, সিধেসাদা রাষ্ট্রপতি ছিলেন বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহমদ, যিনি চায়ে বিস্কুট ভিজিয়ে খেতেন। তার ১৯৯৬-২০০১ মেয়াদে প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালনের সময় আমি নিজেও তার সহজ সরল জীবন এবং অপচয় রোধ করতে তার উদ্যোগের প্রশংসা করে দৈনিক মানবজমিনে আমার সংক্ষিপ্ত কার্যকালে একটি রিপোর্টও করেছিলাম। ওই রিপোর্টে চাপাকলা ও চিড়া দিয়ে সকালের নাশতা করার কথা এবং বঙ্গভবনে রাষ্ট্রীয় খরচে তার পরিবারের একান্ত সদস্যদের বাইরে অন্তত ৪০ জন লোক, যারা রাষ্ট্রের কর্মচারী তারাও তিনবেলা ভোজন করতেন। প্রেসিডেন্ট সাহাবুদ্দিন খোঁজখবর নিয়ে রাষ্ট্রীয় ভোজনালয়টি বন্ধ করেন।
প্রেসিডেন্ট সাহাবুদ্দিনের দায়িত্ব পালনের সময়ে একদিন বাংলার বাণীতে আসেন তার জামাতা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের প্রফেসর আহাদুজ্জামান মোহাম্মদ আলী। আমি তখন বাংলার বাণীর নিউজ এডিটর। প্রফেসর আহাদুজ্জামানও বঙ্গভবনেই বসবাস করতেন। মানবজমিনে আমার রিপোর্টটির কথা বলি। তিনিও তার শ্বশুরের কৃচ্ছতার কথা স্বীকার করেন এবং বলেন যে, তাকে ও তার স্ত্রীকে (প্রফেসর সেতারা পারভীন। তিনি ২০০৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রে এক সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হন)। নিজেদের খরচে খেতে হয়। শুধু থাকা ফ্রি। সুবহানআল্লাহ! অনেকে তার ইন্তেকালের পর তার কৃচ্ছসাধনের আরও অনেক দৃষ্টান্ত উল্লেখ করেছেন। মহান আল্লাহ তাকে এসব কাজের জন্য উপযুক্তভাবে পুরস্কৃত করুন।
আমার প্রশ্ন হলো, এত সরল মানুষটি আসলে কতটুকু সরল? নিজের স্বার্থে বা সাধারণ ভাষায় আখের গোছাতে কেউ যদি রাষ্ট্রের বৃহত্তর ক্ষেত্রে কু-দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন, তাহলে উপরোক্ত সরলতাগুলো আসলে কতটা সরলতা, আর কতটা হীন স্বার্থবুদ্ধি সম্পন্ন তা বিশ্লেষণ করা আবশ্যক।
আমার বিজ্ঞ ভাইবোনেরা কী বাংলাদেশের সংবিধানের একাদশ সংশোধনীটি একটু উল্টে-পাল্টে দেখবেন? প্রেসিডেন্ট এরশাদের ক্ষমতা ছাড়ার পর ১৯৯১ সালের ৬ আগস্ট এই সংশোধনী জাতীয় সংসদে পাস করা হয় বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহমদের দায়িত্ব গ্রহণ নিয়ে, যে সংশোধনীর মাধ্যমে প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহমদের ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে নিয়োগ দানকে বৈধ ঘোষণা করা হয়, আরও বলা হয় যে, নতুন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর ভাইস প্রেসিডেন্ট পুনরায় প্রধান বিচারপতি হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করতে পারবেন এবং ভাইস প্রেসডেন্ট হিসেবে তার কার্যকাল বিচারপতির কার্যকাল হিসেবে গণ্য হবে। এ সংশোধনীতে সুস্পষ্ট যে বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহমদের একগুঁয়েমির কারণে তাকে ভাইস প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালন শেষে পুনরায় প্রধান বিচারপতির পদে ফিরিয়ে আনার সুযোগ সৃষ্টি এবং তার অনুপস্থিতকালীন সময়কেও বিচারপতি হিসেবে তার কার্যকাল হিসেবে গণ্য করার জন্য সংবিধানে এই সংশোধনী আনা হয়েছিল। রাজনীতিবিদরা নিজ স্বার্থে সংবিধানের অনেকবার খোলনলচে পাল্টেছেন, একজন প্রধান বিচারপতিও যদি অনুরূপ ব্যক্তি স্বার্থে রাষ্ট্র ও সংবিধানকে জিম্মি করে ফেলেন, সেখানে জাতি কার কাছে কী আশা করবে!