রোজার প্রচলন ছিল সব নবী-রসুলের আমলে। হজরত আদম (রা.)-এর সময় রোজা শুরু। তবে শেষ পয়গম্বরের উম্মতদের মতো অন্য কোনো নবীর উম্মতরা সুনির্দিষ্টভাবে কোনো বিশেষ মাসে রোজা পালন করত কি না সে সম্পর্কে সুস্পষ্ট কোনো তথ্য-প্রমাণ নেই।
মহান আল্লাহ রোজার ঐতিহাসিক পটভূমির প্রতি ইঙ্গিত দিয়ে ইরশাদ করেন, ‘হে মুমিনগণ! তোমাদের ওপর রোজা ফরজ করা হলো, যেমন তোমাদের পূর্বসূরিদের ওপর ফরজ করা হয়েছিল।’ এ আয়াতে আগে সব শরিয়তেই রোজা ফরজ ছিল বলে ঘোষণা করা হয়েছে।
আল্লামা মাহমুদুল হাসান (রহ.) উপরোক্ত আয়াতের তাফসিরে বলেন, ‘রোজার হুকুম যথারীতি হজরত আদম (আ.)-এর যুগ থেকে শুরু করে আজও বিদ্যমান রয়েছে।’ মাওলানা মাহমূদুল হাসানের মতে হজরত নুহ (আ.)-এর যুগে বিস্তৃত শরিয়ত অবতীর্ণ হয়। তাঁর আগেও পৃথিবীর প্রথম যুগে, শরিয়তের বিষয়াদির ওহি ছিল অত্যন্ত সীমিত। সে যুগে বেশির ভাগই ছিল পৃথিবী গড়ার প্রয়োজনীয় নির্দেশাবলি-সংক্রান্ত ওহি। আর এ প্রশ্নে হজরত নুহ (আ.)-এর যুগ ছিল একেবারেই স্বতন্ত্র। এ যুগেই শুরু খোদাদ্রোহিতা ও ওহির আদেশের অমান্যতা।
হজরত নুহ (আ.)-কে লক্ষ্য করেই আল্লাহ ইরশাদ করেন, ‘যারা ইমান এনেছে তারা ছাড়া আর কেউ ইমান আনবে না।’ তখন হজরত নুহ (আ.) অতিষ্ঠ হয়ে আল্লাহর দরবারে মুনাজাত করেছিলেন, ‘হে আমার রব! পৃথিবীর বুকে কোনো কাফিরের ঘর যেন অবশিষ্ট না থাকে।’ হাশরের ময়দানে শাফায়াতের জন্য উম্মতরা সর্বপ্রথম হজরত নুহ (আ.)-এর কাছে গমন করবে। আল্লামা ইবনে কাসির স্বীয় প্রসিদ্ধ তফসিরে লিখেছেন, হজরত জেহাক বলেছেন হজরত নুহর যুগ থেকে প্রতি মাসেই তিনটি রোজা পালন করার হুকুম ছিল এবং এ হুকুম রসুল (সা.)-এর যুগ পর্যন্ত বহাল ছিল। এরপর যখন রমজানে রোজা পালনের হুকুম হলো তখন থেকে প্রতি মাসে তিনটি রোজা পালনের হুকুম রহিত হলো।
আল্লাহ হজরত মুসা (আ.)-কে তুর পর্বতে ডেকে যখন তাওরাত প্রদানের প্রতিশ্রুতি দিলেন তখন আল্লাহ মুসাকে সেখানে ৩০ রাত অবস্থানের নির্দেশ দিলেন। এ সম্পর্কে কোরআনে বলা হয়েছে, ‘এবং স্মরণ কর ওই সময়কে যখন আমি মুসার জন্য ৩০ রাত নির্ধারণ করেছিলাম এবং আরও ১০ দ্বারা তা পূর্ণ করেছিলাম। এভাবে তার প্রতিপালকের নির্ধারিত ৪০ রাত পূর্ণ হয়।’ এ বর্ণনা দ্বারা বোঝা যায় হজরত মুসা (আ.)-এর যুগেও রোজার হুকুম ছিল।
হজরত ইবনে আমরকে রসুল (সা.) রোজা পালনের আদেশ এভাবে করেছিলেন, ‘আল্লাহর কাছে যে রোজা উত্তম সে রোজা রাখ। আর সে রোজা হলো যা দাউদ রেখেছেন।’ ইনজিলে দার বাদশাহর সময় বায়তুল ইলের বাসিন্দা ও বনি ইয়াহুদাদের প্রতি রোজা রাখার কথা স্পষ্টভাবে উল্লেখ রয়েছে। রসুল (সা.)-এর উম্মতদের আগে যে রোজা প্রচলিত ছিল তা ছিল কঠোর। কিন্তু আল্লাহ আখেরি নবীর উম্মতদের জন্য তা সহজ করে দেন।
সাহাবি সালমান ফারসি (রা.) থেকে বর্ণিত, রসুল (সা.) আমাদের রমজান মাসের গুরুত্ব ও মর্যাদা সম্পর্কে সুদীর্ঘ একটি ভাষণ উপস্থাপন করেন। এতে তিনি বলেন, ‘হে লোকজন! তোমাদের কাছে একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ ও পবিত্র মাস আগমন করেছে। এ মাসে একটি রাত আছে তা হাজার মাস অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ। এ মাসের দিনে আল্লাহতায়ালা রোজা ফরজ করেছেন এবং রাতে নফল নামাজ দিয়েছেন। এ মাসে যারা কোনো নফল কাজ করবে সে অন্য মাসের ফরজ সমতুল্য বিনিময় এবং এ মাসের প্রতিটি ফরজ কাজে অন্য মাসের ৭০ গুণ ফরজ সমতুল্য বিনিময় লাভ করবে।
এ মাস ধৈর্য ও সহনশীলতার। আর ধৈর্যের প্রতিফল হলো বেহেশত। এ মাস পরস্পর সাহায্য ও সহনশীলতার। এ মাসে আল্লাহ মুমিন বান্দাদের রিজিক বৃদ্ধি করে দেন। এ মাসে যে একজন রোজাদারকে ইফতার করাবে তার সব গুনাহ আল্লাহ ক্ষমা করে দেবেন। পরকালে তাকে আগুন থেকে মুক্তি দান করবেন এবং তাকে রোজাদারের সমতুল্য বিনিময় দান করবেন। অথচ ওই রোজাদারের বিনিময়ে কোনো কমতি হবে না। সাহাবিরা বলেন, ইয়া রসুলুল্লাহ! আমাদের সবাই ইফতার করানোর মতো সক্ষমতা রাখে না।
উত্তরে মহানবী বললেন, যে একজন রোজাদারকে একটি খেজুর, সামান্য পানি অথবা অল্প দুধের মাধ্যমে ইফতার করাবে আল্লাহ তাকেও এ মহাবিনিময় দান করবেন। এ মাসের প্রথম অংশ রহমত, মধ্যের অংশ ক্ষমা এবং শেষ অংশ আগুন থেকে মুক্তির জন্য বরাদ্দ। এ মাসে যারা কর্মচারীদের কাজ হালকা করে দেবে আল্লাহ তার পাপ মুছে দেবেন এবং দোজখ থেকে তাকে মুক্তি দান করবেন। অতএব তোমরা চারটি কাজ বেশি বেশি কর। দুটি কাজের মাধ্যমে আল্লাহকে সন্তুষ্ট করা যায়।
লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ (আল্লাহ ছাড়া কোনো উপাস্য নেই) এ সাক্ষ্য প্রদান করা এবং ক্ষমাপ্রার্থনা করা। আর দুটি কাজ এমন যা ছাড়া তোমাদের কোনো উপায় নেই। তা হলো আল্লাহর কাছে বেহেশত এবং দোজখ থেকে মুক্তি চাওয়া। যে ব্যক্তি একজন রোজাদারকে পান করাবে আল্লাহ তাকে আমার হাউসে কাওসার থেকে পান করাবেন, ফলে বেহেশতে প্রবেশ করা পর্যন্ত আর কখনো পিপাসা হবে না।’ ইবনে হিব্বান, ইবনে খুজাইমা, বায়হাকি ও আত তারগিব ওয়াত তারহিব।
লেখক : ইসলামবিষয়ক গবেষক।