১৯৪৭ সালে জন্ম হওয়ার পর থেকে ৭৫ বছরের ইতিহাসে ৩৪ বছরই দেশটির ক্ষমতায় ছিল সেনাবাহিনী। শুধু তাই নয়, পাকিস্তানের ৭৫ বছরের ইতিহাসে কোনো শাসকই মেয়াদ পর্যন্ত ক্ষমতা ধরে রাখতে পারেননি। অনেকে ব্যঙ্গ করে বলে থাকেন, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী মানেই পতন। স্বাধীনতার পর থেকে এক প্রকার অস্থিতিশীলতার মধ্য দিয়েই গেছে সে দেশের রাজনীতি। হত্যা, খুন, অভিসংশন কিংবা সরকার বাতিলের মধ্য দিয়ে বারবার ক্ষমতার পালাবদল ঘটেছে সেখানে। ইমরান খান যেভাবে বিপুল ভোটে ক্ষমতায় এসেছিলেন, তাতে অনুমান করা হয়েছিল- তিনি অন্তত টিকে যাবেন। কিন্তু সেই সম্ভাবনাও শেষ। অনাস্থা ভোটে হেরে মেয়াদ ফোরানোর আগেই বিদায় নিচ্ছেন সাবেক এই ক্রিকেটার তথা রাজনীতিবিদ। এ বিষয়ে বিস্তারিত জানিয়েছেন-আজহারুল ইসলাম অভি
খাজা নাজিমুদ্দীন
খাজা নাজিমুদ্দীন ১৯৫১ সালের ১৭ অক্টোবর থেকে ১৯৫৩ সালের ১৭ অগস্ট পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রæয়ারি ভাষা আন্দোলনের মিছিলে বাংলার জন্য সমান ও সরকারি মর্যাদা দাবি করলে তাতে গুলি বর্ষণ করা হয়। এর আগে মোহাম্মদ আলি জিন্নাহ উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রীয় ভাষা করার ঘোষণা দিয়েছিলেন। খাজা নাজিমুদ্দীনের সময়কালে বাংলা ভাষা আন্দোলন নিয়ে লাহোরে একাধিক সহিংসতার ঘটনা ঘটে। পরিস্থিতি সামলাতে ব্যর্থ হওয়ার কারণ দেখিয়ে তাকে গদি ছাড়ার নির্দেশ দেন পাকিস্তানের গর্ভনর জেনারেল মালিক গোলাম। কিন্তু তিনি এই নির্দেশ না মেনে নিতে চাওয়ায় নিজের বিশেষ ক্ষমতা ব্যবহার করে নাজিমুদ্দীনকে ক্ষমতাচ্যুত করেন মালিক। নাজিমুদ্দীন মোট ১ বছর ১৮২ দিন ক্ষমতায় ছিলেন।
বেনজির ভুট্টো
পাকিস্তানের একাদশ ও প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ক্ষমতায় আসেন জুলফিকারের মেয়ে বেনজির ভুট্টো। ১৯৮৬ সালে লন্ডন থেকে দেশে ফেরত এসে সরকারবিরোধী আন্দোলনে বেনজির ভুট্টো জনমত গঠন করেন এবং অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনে জয়ী হয়ে প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। ১৯৯০ সালের ৬ আগস্ট তিনি বরখাস্ত হন। এর পর ১৯৯৩ সালের নির্বাচনে আবার তিনি জয়লাভ করেন এবং দ্বিতীয়বারের মতো পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। ১৯৯৬ সালের ৬ নভেম্বর তাকে পুনরায় বরখাস্ত করা হয়। ১৯৯৭ সালের নির্বাচনে তিনি হেরে যান। ১৯৫১ সালের ১৬ অক্টোবর রাওয়ালপিন্ডি পৌরসভা পার্কের সভায় লিয়াকত আলি খানকে যেখানে খুন করা হয়েছিল, ঠিক একই জায়গায় প্রায় ৫৬ বছর পর পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী বেনজির ভুট্টো আততায়ীর হামলায় নিহত হন।
নওয়াজ শরিফ
১৯৯০ সালে পাকিস্তানের দ্বাদশ প্রধানমন্ত্রী হন নওয়াজ শরিফ। ১৯৯৩ সালে প্রেসিডেন্ট ইসহাক পাকিস্তানের সংসদ ভেঙে দেওয়ার পর তিনি গদিচ্যুত হন এবং বিরোধী নেতা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। ত্রয়োদশ ও চর্তুদশ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে পাকিস্তান শাসনের ভার পান বেনজির ভুট্টো ও নওয়াজ শরিফ। নওয়াজের দ্বিতীয়বারের শাসনকাল ছিল ২ বছর ২৩৭ দিন। ১৯৯৯ সালে পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর অভ্যুত্থানের ফলে তার শাসনকালের অবসান ঘটে। এর পর ২০১৩ সালের জুনে তৃতীয়বারের মতো আবার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ফিরে আসেন এবং ৪ বছর ৫৩ দিন ক্ষমতায় ছিলেন। তবে ২০১৭ সালে পানামা পেপার দুর্নীতিতে যুক্ত থাকার অভিযোগে তাকে ক্ষমতাচ্যুত করেন সুপ্রিম কোর্ট। সুপ্রিম কোর্ট ২০১৮ সালে তাকে ১০ বছরের জন্য কারাবাসে পাঠানোরও নির্দেশ দেন।
লিয়াকত আলি খান
১৯৪৭-১৯৫১ সাল পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী পদে ছিলেন লিয়াকত আলি খান। তাকে বলা হয় স্বাধীন পাকিস্তানের প্রথম প্রধানমন্ত্রী। ১৯৪৭ সালের ১৪ অগস্ট তিনি প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বভার নেন। এদিনটি পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবস হিসেবে পালিত হয়। ১৯৫১ সালের ১৬ অক্টোবর রাওয়ালপিন্ডি পৌরসভা পার্কের এক সভায় লিয়াকত আলি খানের একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘোষণা দেওয়ার কথা ছিল। ওই সভায় মঞ্চ থেকে মাত্র ১৫ গজ দূরে উপস্থিত থাকা সাদ আকবর নামে এক আততায়ী তাকে গুলি করে। তার বুকে দুটি গুলি লেগেছিল। তিনি নিহত হন। তার এমন হত্যার কারণ এখন পর্যন্ত অজানা। মৃত্যুর পর তাকে শহীদ-এ-মিল্লাহ উপাধিতে ভ‚ষিত করা হয়। রাওয়ালপিন্ডির যে উদ্যানে তিনি নিহত হন, সে উদ্যানের নামকরণ করা হয় ‘লিয়াকত বাগ’। মোট চার বছর ৬৩ দিন ক্ষমতায় ছিলেন লিয়াকত আলি খান।
জুলফিকার আলি ভুট্টো
১৯৭০ সালে পাকিস্তানের সাধারণ পরিষদের নির্বাচনে তার দল পশ্চিম পাকিস্তানে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানের আওয়ামী লীগ সার্বিক সংখ্যা গরিষ্ঠতা অর্জন করা সত্তে¡ও তাদের ওপর ক্ষমতা অর্পণে ভুট্টো আপত্তি তোলেন। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাত ১২টার পর পাকিস্তানি বাহিনী অপারেশন সার্চ লাইটের মাধ্যমে বাঙালিনিধন অভিযান শুরুর সময় তিনি ঢাকার ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে ছিলেন। পরে তাকে পাকিস্তানে ফেরত পাঠিয়ে দেওয়া হয়। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে পাকিস্তানের পরাজয়ের পর ভুট্টো ইয়াহিয়া খানের স্থলে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট হন। ১৯৭৩ সালে দেশের সংবিধান পরিবর্তনের মাধ্যমে তিনি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর পদ গ্রহণ করেন। ১৯৭৭ সালে পুনরায় প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। কিন্তু অল্পদিনের মধ্যেই জেনারেল জিয়াউল হক দ্বারা সংঘটিত এক সামরিক অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হন। ১৯৭৮ সালের ১৮ মার্চ এক ব্যক্তিকে হত্যার ষড়যন্ত্রে জড়িত থাকার অভিযোগে ১৯৭৯ সালের ৪ এপ্রিল সামরিক আদালত তাকে মৃত্যুদÐ দেন এবং রাওয়ালপিন্ডির আদিয়ালা কারাগারে তাকে ফাঁসি দেওয়া হয়।
ইউসুফ রাজা গিলানি
ইউসুফ রাজা গিলানি ২০০৮ সালের সাধারণ নির্বাচনের পর ১৮তম প্রধানমন্ত্রী হন। তার দল পাকিস্তান পিপলস পার্টি (পিপিপি) জাতীয় পরিষদের সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন অর্জন করে। কিন্তু ২০১২ সালে শীর্ষ আদালত অবমাননার মামলায় দোষী সাব্যস্ত হলে তাকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়।
সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতায় এসেছিলেন যারা
জেনারেল জিয়াউল হক
১৯৭৭ সালের ৬ জুলাই। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জুলফিকার আলি ভুট্টোর বিরুদ্ধে সামরিক অভ্যুত্থান করেন তখনকার সেনাপ্রধান জেনারেল জিয়াউল হক। তবে মজার বিষয় হলো, এই জুলফিকার আলি ভুট্টোই সাতজন সিনিয়র লেফটেন্যান্ট জেনারেলকে ডিঙিয়ে সেনাপ্রধান করেন এই লেফটেন্যান্ট জেনারেল জিয়াউল হককে। সেনাপ্রধানের পদে নিয়োগের পাশাপাশি চারতারকা জেনারেল পদেও প্রমোশন পান জিয়াউল হক। ক্ষমতা দখল করেই সামরিক আইন জারি করেন জিয়াউল হক। তার ১১ বছরের শাসনের মধ্যে পাকিস্তানকে আট বছরই কাটাতে হয়েছে সামরিক আইনের মধ্যেই। পাকিস্তানে সবচেয়ে বেশি সময় ধরে ক্ষমতায় থাকা এই শাসকের শাসনের সমাপ্তি ঘটে বিমান দুর্ঘটনার মাধ্যমে ১৯৮৮ সালের ১৭ আগস্ট। তবে এটি নিছকই বিমান দুর্ঘটনা, নাকি হত্যাকাÐ- এ নিয়ে রয়েছে ব্যাপক সংশয়।
পারভেজ মোশাররফ
১৯৯৮ সালের অক্টোবর পারভেজ মোশাররফের পদবি লেফটেন্যান্ট জেনারেল থেকে পূর্ণ জেনারেল পদবিতে উন্নীত করেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ। ১৯৯৯ সালে ভারতে হামলার মূল পরিকল্পনা পারভেজই করেছিলেন- যেটি পরে কার্গিল যুদ্ধে রূপ নেয়। প্রধানমন্ত্রী শরিফের সঙ্গে বিভিন্ন বিষয়ে পারভেজের তর্কাতর্কি থাকায় শরিফ পারভেজকে সামরিক বাহিনী থেকে বরখাস্ত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। জেনারেল পারভেজ এর জবাব হিসেবে নওয়াজ শরিফকে এক সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে সরিয়ে দেন ১৯৯৯ সালে। জেনারেল মোশাররফ পাকিস্তানের ক্ষমতায় থাকতে বিচার বিভাগের সঙ্গে এক ধরনের লড়াইয়ে নেমেছিলেন। তিনি দেশের আইনের বিরুদ্ধে গিয়ে একই সঙ্গে সেনাবাহিনীর প্রধান ও প্রেসিডেন্ট পদে আসীন থাকতে চেয়েছিলেন। এ জন্য তিনি প্রধান বিচারপতি ইফতেখার মোহাম্মদ চৌধুরীকে বরখাস্ত করেন। এতে দেশব্যাপী প্রতিবাদ শুরু হয়। বিক্ষোভ দমনে তিনি বেশকিছু পদক্ষেপ নেন। এতে পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। এর পর নওয়াজ নির্বাসন থেকে দেশে ফেরেন। তার ফিরে আসার মধ্য দিয়ে মোশাররফ জমানার অবসানের শুরু হয়। ২০০৮ সালের নির্বাচনে হেরে যায় তার দল। এই নির্বাচনে হেরে যাওয়ার ছয় মাস পর অভিশংসন এড়াতে পদত্যাগ করেন তিনি।
ইমরান খান
২০১৮ সালের ১৮ আগস্ট নির্বাচনে জিতে প্রধানমন্ত্রীর পদে বসেন ইমরান খান। নির্বাচনে তার জোটসঙ্গী ছিল মুত্তাহিদা কওমি মুভমেন্ট পাকিস্তান (এমকিউএম)। পাকিস্তানের রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার ধারা বজায় রেখে পূর্বসূরিদের মতো ইমরান খানও মেয়াদ শেষ করতে পারলেন না। পাকিস্তানের ইতিহাসে অনাস্থা ভোটে হেরে যাওয়া প্রথম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নাম লেখালেন ইমরান খান। শনিবার মধ্যরাতে অনাস্থা ভোটে হেরে যান তিনি। দেশটির ইতিহাসে অনাস্থা ভোটে হেরে কোনো প্রধানমন্ত্রী পদ হারাননি। অনাস্থা ভোটের অধিবেশনটি পরিচালনা করেন সাবেক স্পিকার আয়াজ সাদিক। বিরোধীদের অনাস্থা প্রস্তাবে ইমরানের বিরুদ্ধে ভোট পড়েছে ১৭৪টি। প্রস্তাব পাসের জন্য দরকার ছিল ১৭২ ভোট। পাকিস্তানের ২২তম প্রধানমন্ত্রী ছিলেন ইমরান খান। অনেক চেষ্টা করেও প্রধানমন্ত্রিত্ব ধরে রাখতে পারলেন না ২২ গজের ক্রিকেট পিচ দাপিয়ে বেড়ানো ইমরান। তার ক্ষমতাচ্যুতির মধ্য দিয়ে দেশটির নির্বাচিত একজন প্রধানমন্ত্রীও মেয়াদ পূর্ণ করতে পারলেন না।