দুর্নীতিবিরোধী অভিযান থেকে বাঁচতে কেউ পাড়ি দিয়েছিলেন বিদেশে, অনেকে হয়েছিলেন এলাকাছাড়া। তবে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটির নির্বাচনকে কেন্দ্র করে তাদের অনেকে এলাকায় ফিরেছেন। কাউন্সিলর পদে নির্বাচনে অনেকে বাগিয়ে নিয়েছেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সমর্থনও। যারা মনোনয়ন পাননি তারাও বিদ্রোহী হিসেবে রয়েছেন নির্বাচনী মাঠে।
ক্যাসিনো ও মাদককারবার, টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ, জমি দখল, চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন অপকর্মের সঙ্গে জড়িত অভিযুক্ত অনেক কাউন্সিলরও মনোনয়ন পেয়েছেন আওয়ামী লীগের। সরকারের চলমান শুদ্ধি অভিযানের মধ্যে এমন বিতর্কিতদের দলীয় সমর্থন দেওয়ায় অনেকে প্রশ্ন তুলেছেন। তারা বলছেন, শুদ্ধি অভিযানের কারণে সাধারণ মানুষের মধ্যে সরকারের ইতিবাচক ভাবমূর্তি গড়ে উঠেছিল। কিন্তু বিতর্কিতদের কাউন্সিলর প্রার্থী হিসেবে সমর্থন ও বিতর্কিত অনেকে বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে মাঠে থাকায় এ অভিযানকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে তোলা হয়েছে।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সমর্থন পাওয়া বিতর্কিত কাউন্সিলরদের মধ্যে রয়েছেনÑ ২ নম্বর ওয়ার্ডের আনিসুর রহমান, ৫ নম্বরের আশ্রাফুজ্জামান ফরিদ, ৭ নম্বরে আব্দুল বাসিত খান, ২০ নম্বরের ফরিদউদ্দিন
আহমেদ রতন, ৩০ নম্বরে মো. হাসান, ৫১ নম্বরের হাবিবুর রহমান হাবু, ৫৬ নম্বরে মোহাম্মদ হোসেন ও ৫৯ নম্বরে আকাশ কুমার ভৌমিক। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সমর্থন পাওয়া কাউন্সিলরদের মধ্যে রয়েছেন ৪ নম্বরে জামাল মোস্তফা, ৫ নম্বরে আবদুর রউফ নান্নু, ১৮ নম্বরে জাকির হোসেন বাবুল, ২৯ নম্বরে নুরুল ইসলাম রতন ও ৩০ নম্বরে আবুল হাসেম হাসু।
কাউন্সিলর আনিসুর রহমানের বিরুদ্ধে জমি ও ফ্ল্যাট দখল এবং সহযোগীদের বিরুদ্ধে মাদক ব্যবসার বিস্তর অভিযোগ রয়েছে। তিনি যে বাড়িতে থাকেন সেই বাড়ির চারটি ফ্ল্যাটও দখল করে নিয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। ভবন নির্মাতা প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন সময় টাকা চাইলেও তিনি প্রতিবারই হুমকি দিয়ে এলাকাছাড়া করেছেন। স্থানীয়রা জানান, নতুন কোনো ভবন কেউ করতে চাইলে সেখানে এই কাউন্সিলরের লোকজন গিয়ে মোটা অঙ্কের টাকা দাবি করে। অথবা সেখানে ইট-বালু-রড-সিমেন্ট সরবরাহের কাজ তাদের দিতে হয়।
কাউন্সিলর আশ্রাফুজ্জামান ফরিদের বিরুদ্ধে স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, জমি দখল, ভাগ্নে শাওনকে দিয়ে মাদককারবার নিয়ন্ত্রণ, সরকারি জমিতে বাজার বসিয়ে অর্থবাণিজ্য, কমিউনিটি সার্ভিসের নামে স্থানীয় বাসিন্দাদের কাছ থেকে টাকা আদায়, বিএনপির স্থানীয় নেতাদের মাধ্যমে ডিশ ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ, সিএনজি স্টেশন থেকে মাসিক চাঁদা আদায় করেন তিনি। সবুজবাগে কোনো নতুন ভবন করতে হলেও কাউন্সিলর ফরিদকে নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা দিতে হয়।
কাউন্সিলর আবদুল বাসিত খানের বিরুদ্ধে নিজ দলের এক নেতার স্ত্রীকে ধর্ষণের অভিযোগ রয়েছে। এ ছাড়া জমি দখল, অনুগতদের দিয়ে চাঁদাবাজিসহ নানা অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে।
ডিএসসিসির কাউন্সিলরদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি বিতর্কিত ফরিদউদ্দিন আহমেদ রতন। র্যাবের হাতে আটক ক্যাসিনোকা-ে আলোচিত যুবলীগ নেতা খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া, ঠিকাদার জিকে শামীম ও ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাটের ঘনিষ্ঠ ও ব্যবসায়িক সম্পর্ক রয়েছে তার। বিশেষ করে গুলিস্তানের মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ক্রীড়াচক্রের ক্যাসিনো বাণিজ্যের উল্লেখযোগ্য অংশের নিয়ন্ত্রণ ছিল তার হাতে। অভিযোগ আছে, শূন্য থেকে হাজার কোটি টাকার মালিক হওয়া রতন নগর ভবন, গণপূর্ত অধিদপ্তর, বিদ্যুৎ ভবনে ঠিকাদারি নিয়ন্ত্রণ করেন। সেগুনবাগিচায় ফুটপাত দখল করে দোকান বসানো এবং ডিএসসিসির একটি পাঁচতলা ভবনের তিনটি ফ্লোর দখল করে রাখার অভিযোগও আছে তার বিরুদ্ধে। তবে বরাবরই তিনি আমাদের সময়ের কাছে এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। রতন বলেন, সব আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র। আমি নির্মোহ রাজনীতি করি।
কাউন্সিলর মো. হাসানের বিরুদ্ধে এলাকার সব ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে চাঁদাবাজি, নিষিদ্ধ পলিথিন ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ ও সোয়ারীঘাট বেড়িবাঁধ এলাকায় ট্রাক থেকে চাঁদা তোলার অভিযোগ রয়েছে।
হাবিবুর রহমান হাবুকে ২০১৬ সালে সায়েদাবাদে অবৈধ ট্রাকস্ট্যান্ড উচ্ছেদে বাধা ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটকে লাঞ্ছিত করার অভিযোগে সাময়িক বরখাস্ত করেছিল স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। এই কাউন্সিলরের বিরুদ্ধে পরিবহনে চাঁদাবাজি ও সায়েদাবাদ-শ্যামপুর এলাকায় বিভিন্ন জমি দখলের অভিযোগ দীর্ঘদিনের।
কাউন্সিলর মোহাম্মদ হোসেনের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের জমি, খাসজমি, নদীর তীর, খেয়াঘাট, ট্রলারঘাট, রাস্তা, ফুটপাত দখলসহ নিজ দলীয় নেতাকর্মীদের মারধরসহ নানা অপকর্মে জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে। ডিশ-ইন্টারনেটের ব্যবসা, এলাকার ব্যাটারিচালিত রিকশা ও অটোরিকশার নিয়ন্ত্রণও তার হাতে। কাউন্সিলর আকাশ কুমার ভৌমিকের সম্পদ অনুসন্ধান করছে দুদক। এলাকায় তার একটি বাহিনী রয়েছে। তারা আকাশের পক্ষে এলাকায় চাঁদাবাজি ও ঠিকাদারি কাজ নিয়ন্ত্রণ করে।
এর বাইরে ডিএসসিসিতে আরও কয়েকজন বিতর্কিত নেতাকে কাউন্সিলর পদে সমর্থন দেওয়া হয়েছে। তাদের মধ্যে অন্যতম ২ নম্বর ওয়ার্ডে মাহবুব আলম। খিলগাঁও থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মাহবুব আলমের বিরুদ্ধে নির্মাণাধীন অডিটোরিয়াম দখল, ফুটপাত দখল করে ব্যবসাসহ নানা অভিযোগ রয়েছে। ৩৮ নম্বর ওয়ার্ডে সমর্থন পাওয়া আহমদ ইমতিয়াজ মন্নাফীর বিরুদ্ধে রাজধানীর কাপ্তানবাজারের মুরগিপট্টি এলাকা নিয়ন্ত্রণ করে সেখান থেকে অর্থ আদায়ের অভিযোগ রয়েছে। এ টাকা আদায় নিয়ে একাধিকবার স্থানীয় সরকারদলীয় লোকজনের সঙ্গে বিরোধে জড়িয়েছেন তিনি।
ঢাকা উত্তর সিটির (ডিএনসিসি) কাউন্সিলর মো. জামাল মোস্তফা নিজে সরাসরি অপরাধে না জড়ালেও ছেলে রফিকুল ইসলাম রুবেল নানা অপকর্মের সঙ্গে জড়িত। মাদকসহ গ্রেপ্তারও হয়েছিলেন তিনি। পুলিশের মাদকবিরোধী অভিযানকালে এক গোয়েন্দা প্রতিবেদনে উঠে আসা ৪৫ শীর্ষ মাদককারবারির মধ্যে জামাল মোস্তফার ছেলের নাম ছিল ১২ নম্বরে। তবে জামাল মোস্তফা এসব অভিযোগকে ষড়যন্ত্র বলে দাবি করেছেন আমাদের সময়ের কাছে। এ ছাড়া থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি হওয়ার সুযোগে নিজের পরিবারসংশ্লিষ্ট অন্তত ১২ জনকে তিনি ওয়ার্ড ও থানার নেতা বানিয়েছেন।
ডিএনসিসির ৫ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর আবদুর রউফ নান্নুর বিরুদ্ধে রাস্তা দখল করে মার্কেট নির্মাণের অভিযোগ রয়েছে। তিনি কয়েক বছর আগে মিরপুর ১১ নম্বর এলাকায় সড়কের একটি বড় অংশ দখল করে অর্ধশত দোকান বানিয়েছেন। এ স্থানটি বর্তমানে ‘নান্নু মার্কেট’ নামে পরিচিত।
১৮ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর জাকির হোসেন বাবুলের বিরুদ্ধে বনানী এলাকায় ক্যাসিনো কারবারে জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে। চলমান শুদ্ধি অভিযানে বেশ কিছু দিন আত্মগোপনে ছিলেন তিনি। ১৮ নম্বর ওয়ার্ড ও আশপাশের এলাকার জমি দখল, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজিসহ বিভিন্ন ধরনের অনৈতিক কর্মকা-, কড়াইল বস্তিতে অবৈধভাবে গ্যাসসংযোগ দিয়ে বিপুল অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে।
৩০ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর আবুল হাসেম হাসুর বিরুদ্ধে রাজধানীর মোহাম্মদপুরের আদাবর এলাকায় নিজস্ব লোকজন দিয়ে জমি দখল ও ফুটপাতে চাঁদাবাজির অভিযোগ রয়েছে। শ্যামলী ও আদাবর এলাকার ত্রিশ থেকে চল্লিশটি বাড়ি ও প্লট দখলের অভিযোগ তার বিরুদ্ধে। তার ভাই কাসুকে নিয়েও রয়েছে বিস্তর অভিযোগ।
৬ নম্বর ওয়ার্ডের বর্তমান কাউন্সিলর ও রূপনগর থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি হাজী রজ্জবের বিরুদ্ধে চলন্তিকা বস্তিতে ঘরবাণিজ্য, মাদক ব্যবসা, চাঁদাবাজিসহ নানা অভিযোগ রয়েছে। এর আগে তিনি র্যাবের হাতে গ্রেপ্তারও হন। আওয়ামী লীগের মনোনয়ন না পেলেও তিনি বিদ্রোহী প্রার্থী হয়ে নির্বাচন করছেন।
ঢাকা মহানগর উত্তর যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক তাইজুল ইসলাম চৌধুরী বাপ্পীও এই ওয়ার্ডে বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করছেন। তার বিরুদ্ধে অটোরিকশা, সিএনজিচালিত অটোরিকশা থেকে নিয়মিত চাঁদা আদায়ের অভিযোগ রয়েছে। এ ছাড়া বৃহত্তর মিরপুর এলাকার ঝুট ব্যবসার একক নিয়ন্ত্রণ, সাধারণ মানুষের প্লট দখল করে টাকা আদায়সহ নানা অভিযোগ রয়েছে।
সমর্থনবঞ্চিত ৩ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর কাজী জহুরুল ইসলাম মানিকের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের জমি দখলের অভিযোগ রয়েছে। এ নিয়ে ভুক্তভোগীরা বিভিন্ন সময় সংবাদ সম্মেলনও করেছেন। বিদ্রোহী প্রার্থী হয়ে নির্বাচনে লড়ছেন তিনি।
১৪ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর হুমায়ুন রশিদ জনির বিরুদ্ধেও রয়েছে বিস্তর অভিযোগ। তিনিও বিদ্রোহী হিসেবে নির্বাচন করছেন। অভিযোগ রয়েছে এলাকার সব বিরোধপূর্ণ জমিতে একক দখল প্রতিষ্ঠা করেছেন তিনি।
১৬ নম্বর ওয়ার্ডে কাফরুল থানা আওয়ামী লীগের স্থগিত কমিটির সহ-সভাপতি আলাউদ্দিন বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করছেন। এক সময়ের ফুটপাতের হকার আলাউদ্দিন বর্তমানে শত শত কোটি টাকার মালিক। রয়েছে আলিশান বাড়ি ও গাড়ি। দখল, চাঁদাবাজিসহ নানা অপরাধে সিদ্ধহস্ত তিনি। বিভিন্ন অপরাধের কারণে জেলও খেটেছেন।