তেজগাঁও পুরাতন বিমানবন্দরে ৪৮ বছর আগে বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের ঘটনাপ্রবাহের প্রতীকী মঞ্চায়নের মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকীর ক্ষণগণনার সূচনা হল।
বঙ্গবন্ধুর দুই মেয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা, তাদের পরিবারের সদস্য, সরকারের মন্ত্রিসভার সদস্য, দুই হাজারের বেশি আমন্ত্রিত অতিথি এবং দশ হাজারের বেশি নিবন্ধিত দর্শকের উপস্থিতে শুক্রবার বিকালে স্মরণ করা হল সেই মুহূর্তটিকে, যেদিন পূর্ণতা পেয়েছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতার আনন্দ।
১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধুকে তার ধানমণ্ডির ৩২ নম্বর সড়কের বাড়ি থেকে পাকিস্তানি সেনারা আটক করে তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যায়। ওই রাতেই বাংলাদেশের নিরস্ত্র মানুষের উপর শুরু হয় বর্বর হামলা।
সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্য দিয়ে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশের অভ্যুদয় হলেও তখনও পাকিস্তানে বন্দি ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান; উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় ছিলেন সদ্য স্বাধীন দেশের মানুষ।
চাপের মুখে পাকিস্তান সরকার মুক্তি দিলে যুদ্ধে বিজয়ের ২৪ দিন পর ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি নিজের স্বপ্নের স্বাধীন দেশে পা রাখেন শেখ মুজিবুর রহমান। কাঙ্ক্ষিত সেই মানুষটির বাংলার মাটিতে পা রাখার মধ্য দিয়েই সেদিন বাংলাদেশের স্বাধীনতা পূর্ণতা পেয়েছিল।
তখন থেকে দিনটি বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস হিসেবে পালিত হয়ে এলেও ৪৮ বছর পর এবার আয়োজনে ভিন্ন আঙ্গিক নিয়ে এসেছে ‘মুজিববর্ষ’।
বেঁচে থাকলে এই বছরই ১০০ বছর পূর্ণ করতেন বঙ্গবন্ধু। আর তাই তার জন্মশতবার্ষিকী ঘটা করে উদযাপনের যে পরিকল্পনা নিয়েছে বাংলাদেশ, তার ক্ষণগণনা শুরু হচ্ছে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবসে তেজগাঁওয়ের পুরনো বিমানবন্দরের এই অনুষ্ঠান থেকে।
আমন্ত্রিত অতিথি ও নিবন্ধিতদের জন্য দুপুরের পর থেকেই উন্মুক্ত করে দেয়া হয় অনুষ্ঠানস্থলের নির্ধারিত প্রবেশ পথগুলো। সবাইকে নিরাপত্তা তল্লাশির মধ্য দিয়ে ভেতরে প্রবেশের অনুমতি দেয়া হয়।
মন্ত্রিসভার সদস্য, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের প্রতিনিধিসহ নানা শ্রেণি পেশার মানুষ বেলা ২টা থেকেই অনুষ্ঠানস্থলে প্রবেশ করতে শুরু করে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদ্যাপন জাতীয় কমিটির সভাপতি অধ্যাপক মো. রফিকুল ইসলামকে সাথে নিয়ে বিকাল সাড়ে ৪টার দিকে অনুষ্ঠানস্থলে এসে মঞ্চে বসেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী, বঙ্গবন্ধুর দৌহিত্র সজীব ওয়াজেদ জয়, আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃবৃন্দ এবং দেশের জ্যেষ্ঠ নাগরিকরা উপস্থিত ছিলেন অনুষ্ঠানে।
আমন্ত্রিত অতিথিদের মধ্যে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের শীর্ষ নেতা গণফোরাম সভাপতি কামাল হোসেন এবং বিকল্প ধারা বাংলাদেশের সভাপতি সাবেক রাষ্ট্রপতি একিউএম বদরুদ্দোজা চৌধুরীও ছিলেন।
মূল অনুষ্ঠানের শুরুতে পুরাতন বিমানবন্দরে অবতরণ করে সি-১৩০জে মডেলের একটি উড়োজাহাজ।
পাকিস্তানের কারগার থেকে মুক্তি পাওয়ার দুই দিন পর লন্ডন হয়ে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি অপরাহ্নে ব্রিটিশ রয়্যাল এয়ারফোর্সের এরকম একটি উড়োজাহাজে করেই তেজগাঁওয়ের বিমানবন্দরে পৌঁছান বঙ্গবন্ধু।
বিমানটি ধীরে ধীরে এসে টারমাকে অনুষ্ঠান মঞ্চ থেকে নির্দিষ্ট দূরত্বে এসে থামে। এ সময় বাজানো হয় সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠের সেই গান- ‘বঙ্গবন্ধু ফিরে এলে তোমার স্বপ্নের স্বাধীন বাংলায়’।
বিমানটি টারমাকে পৌঁছানোর পর দরজা খোলা হলে ২১ বার তোপধ্বনি দেওয়া হয়। পাতাকা হাতে ১৫০ জন তখন সেখানে লাল গালিচার পাশে বঙ্গবন্ধুকে স্বাগত জানাতে প্রস্তুত।
তাদের জয়বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু স্লোগান আর লেজার লাইটের মাধ্যমে বিমানের দরজার ফুটিয়ে তোলা হয় বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি। পুষ্পবৃষ্টির মধ্যে সেই আলোকবর্তিকা ধীরে ধীরে সিঁড়ি বেয়ে নেমে এসে লাল গালিচার মাথায় ছোট্ট মঞ্চে এসে থেমে যাবে। এরপর গার্ড অব অনার দেয় সশস্ত্র বাহিনীর একটি চৌকস দল।
বঙ্গবন্ধু যে আলোকবর্তিকা হয়ে সেদিন দেশে ফিরেছিলেন, তারই প্রতীকী উপস্থাপনা ছিল এ আয়োজন।
প্রধানমন্ত্রী বক্তব্য দেয়ার পর মুজিববর্ষের লোগো উন্মোচন ও ক্ষণগণনার উদ্বোধন করবেন ল্যাটপটের বোতাম চেপে। দেশের ১২ সিটি করপোরেশনে ২৮টি স্পটে, ৫৩ জেলায় ও দুটি উপজেলা মিলিয়ে মোট ৮৩টি জায়গায় বসানো কাউন্টডাউন ক্লকও সাথে সাথে চালু হয়ে যায়।
এই ক্ষণ গণনা শেষে আগামী ১৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনে সূচনা হবে মুজিববর্ষের বছরব্যাপী অনুষ্ঠানের; বছরজুড়ে চলবে সেই আয়োজন। দেশের সীমানা ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক পর্যায়েও নানা আয়োজন থাকবে।