তারুণ্য হচ্ছে শক্তি। এই শক্তির অপচয় ঘটে তরুণদের মধ্যে বিধিনিষেধ উপেক্ষার প্রবণতা থেকে, বিবেচনাবোধের বিকাশ না হওয়া থেকে।
রাস্তাঘাটে, বিশেষ করে গ্রামীণ বা মফস্বলের পথে এক বাইকে দুই-তিনজন তরুণ কখনো তীব্র বেগে, কখনো এঁকেবেঁকে বাইক চালিয়ে যায়। তারা সিনেমার হিরোদের মতো চুল উড়িয়ে নিজেদের কল্পনা করে কোনো মুভির দৃশ্যে অভিনয় করছে; কিন্তু এ ক্ষেত্রে তাদের জানটা যে আর থাকছে না এটা কি তারা বুঝতে সক্ষম হয়? হয় না। তাই প্রচলিত আইন, অভিভাবকের অনুরোধ তোয়াক্কা না করে হাইস্পিডে বাইক চালিয়ে বাহাদুরিতে মত্ত হয়। এভাবে যে বাইক চালায়, দোষটা তার। তারই ‘বাহাদুরি’তে পেছনে বসা তরুণদের অপমৃত্যু ঘটছে।
ঢাকায় ঈদের দিন বিপুলসংখ্যক একেবারেই নওল কিশোরের হাতে মোটরসাইকেল ছিল। অলিগলি, রাস্তায় অতি উচ্চ গতিতে তারা মোটরসাইকেল চালিয়ে পথচলা মানুষদের আতঙ্কের মধ্যে ফেলে দিয়েছিল। এমনিতে পুলিশের ভয়ে বড় রাস্তায় যেতে না পারলেও ছোট রাস্তা বা গলিতে এরা প্রায় সময়ই উচ্চ গতিতে বাইক চালায়। হয়তো বড় ভাই বা বাবার টাকা কারো কাছ থেকে ধারে নেয়। এগুলো যে, বিপজ্জনক তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
এবার ঈদে বহু মানুষ মোটরবাইকে গ্রামের বাড়ি ফিরেছে। ভাড়া করে নিয়েছে বা নিজেরা চালিয়েছে। কেউ কেউ কুমিল্লা, ফেনী, যশোর, টাঙ্গাইল, সিরাজগঞ্জ, ময়মনসিংহ তথা ঢাকা থেকে সারা দেশেই গেছে। এ যে কত বড় রিস্ক তা তারা নিজেরাও জানে না। মহাসড়কে বড় বড় দ্রুতগতির যানের ফাঁকে ফাঁকে চলার উপযুক্ত ট্রেনিংও কারো কারো নেই। ফলে দুর্ঘটনা এড়ানো সম্ভব হয়নি।
উল্লেখ্য, পত্রিকায় প্রকাশিত এক জরিপে জানা গিয়েছিল, প্রায় এক কোটি মানুষ ঢাকা ছেড়েছিল। এর মধ্যে বাসে ৩২ লাখ, নৌপথে ২৫ লাখ, মাইক্রো ও প্রাইভেট কারে ১৬ লাখ, ট্রেনে পাঁচ লাখ, আকাশপথে ৩০ হাজার, মোটরসাইকেলে ১২ লাখ। গণপরিবহনে যাত্রীর চাপে ও উপযুক্ত গণপরিবহনের অভাবে তরুণদের মধ্যে মোটরবাইক কেনার প্রবণতা বাড়ছে। বাইক উৎপাদন ও বিক্রিও বাড়ছে। যেকোনো এলাকায় যানজট পড়লেই দেখা যাচ্ছে, মোটরসাইকেলের ভিড় জমে যায়। এতে স্পষ্ট হয়, দেশে, বিশেষ করে ঢাকায় মানুষ এই যানটি প্রচুর ব্যবহার করছে। বাবারা ছেলে-মেয়েদের স্কুলে আনা-নেয়ার জন্য ছুটছে এই যান নিয়ে। ছানাপোনা সন্তান ও স্ত্রী নিয়ে বেড়াতে যাচ্ছেন। এ ক্ষেত্রে পরিবারের কর্তার মাথাতেই হেলমেট দেখা যায়; স্ত্রী ও সন্তান অরক্ষিত। মোটরসাইকেল ছোট ও হালকা হওয়ায় বেপরোয়া বাস, ট্রাক, ট্যাক্সি, হলার, থ্রি হুইলার সহজেই আঘাত হানে। এতে পড়ে গিয়ে হতাহত হওয়া ও মাথায় আঘাত পাওয়ার ঘটনাই বেশি ঘটে। তাই যাত্রীদের হেলমেট পরা বাধ্যতামূলক। এ আদেশটি মানতে খুব একটা দেখা যায় না। পুলিশ জরিমানাও করে। দু’জনের জায়গায় তিনজন চড়লে জরিমানা করে। তবুও এ প্রবণতা কমার লক্ষণ নেই।
কোনো কোনো ব্যক্তি মোটরসাইকেলে একেবারেই ছোট শিশুদের দু-তিনজনকে তোলে। শিশুদের ভয়কাতর চাহনি বলে দেয়, তারা যেকোনো সময় পড়ে যাওয়ার আশঙ্কায় আছে। রাজপথে বাস-ট্রাক বা ভারী যানবাহনের মধ্যে তাদের চলা সত্যিই হৃদয়বিদারক। তারা চোখ বন্ধ করে থাকে। আসলে মোটরসাইকেল কি গণপবিহনের বিকল্প? তা নয়। তবু মানুষ তা বিকল্প হিসেবে নিয়েছেÑ রিকশা, ইজিবাইকও ব্যবহার করছে। নিত্যসুবিধা যাত্রীদের লক্ষ্য।
এ প্রতিবেদনে জানা গেছে, ‘প্রতি বছর পাঁচ লাখ মোটরসাইকেল বিপণন করে সরকার। এতে পাঁচ হাজার কোটি টাকা আয় হলেও দুর্ঘটনায় ২০ থেকে ২৫ হাজার কোটি টাকার আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে।’
দু’টি সংস্থার প্রতিবেদন সম্প্রতি বিভিন্ন কাগজে প্রকাশিত হয়েছে। প্রতিবেদনে জানা গেছে, শুধু এবারের ঈদযাত্রায় ৪৪ শতাংশ মৃত্যু হয়েছে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায়! প্রতিবেদনের সারসংক্ষেপে যে কয়েকটি দিকে আলোকপাত করা হয়েছে তা হলোÑ ‘নিহতের অর্ধেকের বয়স ১৪ থেকে ২০, মুখোমুখি সংঘর্ষ ঘটেছে ১৬.১৯৫, ৪১.৯৫ শতাংশ মোটরসাইকেল নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে দুর্ঘটনা ঘটে, ৩৭২টি দুর্ঘটনায় ৪১৬ জন নিহত, ৩৯ শতাংশ সময় মোটরসাইকেলকে চাপা ও ধাক্কা দেয়া হয়, ঈদে সবচেয়ে বেশি ১২৫ চালকের মৃত্যু হয়।’ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব বলেছেন, ‘বর্তমানে মোটরসাইকেল ও ইজিবাইক বেড়ে যাওয়ায় পঙ্গু হাসপাতালে প্রতিদিন দুর্ঘটনায় গড়ে ১৫০ জন রোগী ভর্তি হলেও ঈদের সময়ে দৈনিক ২০০ থেকে ২৫০ জন রোগী ভর্তি হয় যার ৬০ শতাংশ মোটরসাইকেলে ও ২৫ শতাংশ ইজিবাইক দুর্ঘটনার শিকার হয়েছে বলে জানা যায়।’
কয়েক দশক আগেও শুধু মধ্যবয়সী মানুষ যেমনÑ ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, কলেজ বা স্কুলশিক্ষক, আইনজীবী ও ধনাঢ্য পরিবারের বয়স্কদের চলাচলে মোটরসাইকেলের ব্যবহার দেখা যেত। এ ছাড়া যৌতুক হিসেবে এই বাহনটি স্ত্রীপক্ষ থেকে আদায় করার প্রবণতা ছিল। যৌতুকের বিষয়টি এখন আরো বেড়েছে। প্রেস্টিজ রক্ষায় অনেক তরুণ অভিভাবকের কাছ থেকে জোর করেই এই বাহনটি আদায় করছে। প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ না থাকায় ও সাবধানতা অবলম্বন না করায় দুর্ঘটনায় পড়তে সময় লাগছে না। এতে বহু পরিবার তরুণ ছেলে হারিয়ে বা পঙ্গু হওয়ায় হাহাকার করছে। ১৪ থেকে ২০ বছর বয়সী তরুণদের পাগলপারা চালানোর বলি পথচারী বা নিজেরা যেই হোকÑ এটি ভবিষ্যতের জন্য রোধ করতেই হবে। রাস্তায় বড় যানবাহনগুলো যাতে ইজিবাইক বা মোটরসাইকেলসহ আরোহী চাপা না দেয় সে জন্য টিভি ফুটেজ দেখে সাথে সাথে ব্যবস্থা নিতে হবে। বেপরোয়া যানবাহন দীর্ঘস্থায়ী কান্নার কারণ। এ থেকে অবশ্যই উদ্ধার পেতে হবে।
সড়ক-মহাসড়কে দুর্ঘটনায় মৃত্যু ও আহত হওয়া নিয়ে মাথা ঘামানো হয় কম না। কত সংগঠন হলো, কত সড়কের উন্নতি হলো, দুর্ঘটনা যদি কমতই তাহলে প্রতিদিন প্রাণঝরা আর আহত হওয়ার খবর কমে আসত। এক দিনও তো দেখা গেল না, ‘আজ দুর্ঘটনা শূন্যের কোঠায়’।
সড়ক ও মহাসড়ক, ফ্লাইওভারে ছোট যানবাহন চলাচলের জন্য আলাদা লেন করতে হবে। প্রশিক্ষিত চালক ছাড়া কারো হাতেই স্টিয়ারিং দেয়া চলবে না। সড়কে পুলিশের সংখ্যা বাড়াতে হবে। সিসি টিভি ফুটেজ দেখে দ্রæতগতির চালক শনাক্ত করে সাথে সাথে তার বাহন আটকে ব্যবস্থা নিতে হবে। দুর্ঘটনায় শুধু যাত্রীই মারা যাচ্ছে না, চালকও মারা যাচ্ছে, আহত হচ্ছে, পঙ্গু হচ্ছে। সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে আশা করি দ্রæতই সুব্যবস্থা নেবে।
লেখক : কথাশিল্পী, সাংবাদিক