রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ০৫:১৮ অপরাহ্ন

সৈকতে সাবধানতা

মকবুলা পারভীন
  • আপডেট টাইম : রবিবার, ২৯ মে, ২০২২
  • ২৬০ বার

কক্সবাজার সমুদ্রসৈকত পর্যটকদের জন্য অনন্য আকর্ষণীয় এক স্থান। সময় পেলেই সৌন্দর্যপিয়াসীরা ছুটে যান সমুদ্রের কাছে। জনৈক নারী পর্যটককে খেটেখাওয়া স্থানীয় এক নারী প্রশ্ন করছিলেন, আপনারা কী দেখতে এখানে আসেন? বালি আর পানি কি আপনাদের এলাকায় নেই?

সত্যি, প্রশ্নটা পর্যটককে ভাবনায় ফেলে দেয়ার মতোই। এর কোনো উত্তর হয় না বলেই হয়তো নারী পর্যটক আর কথা বাড়াননি। যারা নিত্য দেখেন সৈকত, বালি, পানি আর কর্মসংস্থানের জন্য হাড়ভাঙা খাটুনি খাটেন, তাদের কাছে এর মোহনীয় রূপ দেখার, বিমোহিত হওয়ার কিছু নেই।

এই সুদূরপ্রসারী সৈকত আর বালি-পানিই পর্যটকদের মন টানে। তারা উচ্ছি¡সিত আনন্দে সূর্যোদয়-সূর্যাস্ত দেখে সমুদ্রে গা ভিজান, ঢেউয়ের গর্জন ও ফেনা তাদের মনকে দোলায়িত করে। মনের আনন্দে বালিয়াড়িতে হেঁটে বেড়ান।

ঈদের ছুটি, জাতীয় দিবসের ছুটি বা হাতে অবসর পেলেই প্রকৃতির কাছে ছুটে যায় মানুষ। লকডাউন বা মহামারীকাল স্তিমিত হয়ে এলে কক্সবাজারে এত পর্যটক ভিড় করেছিলেন যে, হোটেলে স্থানাভাবে অনেকে শীতের রাত কাটিয়েছেন সৈকতে। মানুষের শখ আর প্রকৃতিপ্রেম বলে কথা! কেউ সাগরের মোহে পড়ে একবার নয়, বারবার সৈকতে যান। বারবারই একরাশ ভালো লাগা নিয়ে ফেরেন।

কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতের সীমা ১২০ কিলোমিটার। এর মধ্যে কলাতলী, সুগন্ধা, সিগাল ও লাবণী পয়েন্টে গোসলের ব্যবস্থা আছে। সমুদ্রসৈকতে নামার নির্দিষ্ট সময়ের নির্ঘণ্ট দেয়া হয়। সাধারণত ভাটার সময় সৈকতে গোসল করা নিষেধ। অনেকে আবেগ উচ্ছ¡াস নিয়ে সাগরের কাছে গিয়েই উজান-ভাটার তোয়াক্কা না করেই গোসলে নেমে পড়েন। এতে যে বিপত্তি ঘটে তা প্রায়ই সংবাদমাধ্যমে ছাপা হয়। সমুদ্রে যখন ঘূর্ণিঝড়ের সঙ্কেত দেয়া হয় তখন সাগরে ঢেউয়ের উচ্চতাও অনেক বেশি থাকে। বহু পর্যটক কোনোরকম প্রটেকশন ছাড়া অর্থাৎ লাইফ জ্যাকেট না পরে উচ্ছ¡সিত আনন্দে বয়া নিয়ে বা না নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েন পানিতে। এমনো নজির রয়েছে, বয়া থেকেও প্রবল ঢেউ এসে ভাসিয়ে নিয়ে গেছে পর্যটককে।

মোটামুটি ছয় কিলোমিটার জায়গায় গোসলের স্থান আছে। বাদ বাকি সৈকত অরক্ষিত। ওই ছয় কিলোমিটারের মধ্যে চার কিলোমিটারেই সাম্প্রতিক ঈদের ছুটিতে লাখো পর্যটক গোসলে নামেন। বউ, বাচ্চা, আত্মীয়স্বজন মিলে লোকে লোকারণ্য ছিল। এর মধ্যে উঁচু ঢেউয়ে ভেসে যাওয়ার ঘটনাও ঘটেছে তবে যথাসময়ে উদ্ধার করায় অঘটন কিছু ঘটেনি।

সাগরের সৈকতে পানির নিচে হঠাৎ করে বালি সরে গিয়ে গভীর খাদ সৃষ্টি করে। এগুলোকে বলে গুপ্ত খাল। কারো পায়ের নিচে হঠাৎ বালি সরে গুপ্ত খাল খুলে গেলে মানুষ ভারসাম্য হারিয়ে ভেসে যায়।

এক তথ্যে জানা গেছে, গত পাঁচ বছরে চার কিলোমিটার সৈকতে উদ্ধার হয় ছয়জন পর্যটকসহ ২৫ জনের লাশ। ভেসে যাওয়ার সময় জীবিত উদ্ধার করা হয়েছে ৫২৩ জনকে। এর মধ্যে নাকি ১৫ শতাংশ নারী। সৈকতের কলাতলী, সুগন্ধা, সিগাল ও লাবণী পয়েন্টে পাঁচ-ছয়টির বেশি গুপ্ত খালের সন্ধান পাওয়া গেছে। তবে ভাটার সময় এর দু-একটি ছাড়া অন্যগুলো দৃশ্যমান নয় বলে জানা গেছে।

এত যে পর্যটক যান, তারা নিজেরা কি যথেষ্ট সাবধান? সবাই না। আবেগ বাঁধ মানে নাÑ অনেকের ক্ষেত্রে তা স্বাভাবিক। অসাধারণ সৌন্দর্য মানুষের মাথা খারাপ করে দিতে পারে। আর এটা নারী, তরুণ ও কিশোরদের ওপর বেশি ভর করে। স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী এবং নারীদের দুর্ঘটনায় পতিত হওয়ার উদাহরণ বেশি। আনন্দ বিষাদে রূপ নেয়ার উদাহরণ যেহেতু আছে, সেহেতু সাবধানতা অবলম্বনই শ্রেয়।

ভেসে যাওয়া মানুষ উদ্ধার করেন কে? সি-সেফ নামের একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান অর্থাৎ লাইফগার্ড প্রতিষ্ঠানের কর্মীরা চারটি স্পটে কাজ করেন বলে জানা যায়। লাখের ঘরে পর্যটকের জন্য সেখানে মাত্র ২৬ জন লাইফগার্ড নিয়োজিত। বাকি ১১৬ কিলোমিটার সৈকতে পর্যটকের নিরাপত্তা রক্ষার বিষয়ে তেমন কেউ নেই। ভাবতে অবাকই লাগে। এত পর্যটকের নিরাপত্তা দেখতে এখানে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে আরো বেশি নিরাপত্তারক্ষী বা লাইফগার্ড নিয়োগ দেয়া খুবই আবশ্যক।

বিদেশীরাও সৈকতে ভ্রমণে এসে থাকেন। আজ পর্যন্ত তাদের ভেসে যাওয়ার কথা শোনা যায়নি, কারণ তারা সঠিক নিয়ম-কানুন মেনেই পানিতে নামেন।

প্রকৃতির সৌন্দর্যপিয়াসী মানুষ ছুটে যান পাহাড়, অরণ্য আর সাগরের কাছে। বিপদ আছে জেনেও যান, নিরাপত্তা পেলে আরো বেশি যান। বাংলাদেশ ছোট দেশ হলেও এর দু’টি বড় সম্পদ কক্সবাজার সমুদ্রসৈকত ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের উপক‚ল ঘেঁষা সুন্দরবন। ভ্রমণপিয়াসীরা যাবেনই যাবেন সেখানে। মনের প্রশান্তি অর্জন করতেই যাওয়া।

আল্লাহর পৃথিবী বিচিত্র আর আশ্চর্য সব জিনিসে ভরপুর। যেগুলো দেখতে দেশে দেশে গড়ে উঠেছে পর্যটনশিল্প। পর্যটন থেকে আয়টা দেশের অর্থনীতিতে যোগ হয়। আর ভ্রমণ হচ্ছে হাতে-কলমে শিক্ষা। বই পড়ে শুধু জ্ঞানার্জন করা যায় আর ভ্রমণে খোলে জ্ঞানচক্ষু। প্রকৃতি হচ্ছে উন্মুক্ত পাঠশালা। সেই পাঠশালায় পাঠ নিতে ভ্রমণের কোনো বিকল্প নেই। এ থেকে আহরিত জ্ঞান ও দর্শন মানুষের চিন্তাশক্তি প্রসারিত করে। কাজেই ভ্রমণের প্রয়োজনীয়তা সেই আদিকাল থেকে সাম্প্রতিক সময়ে এসে একটুও কমেনি। যুগে যুগে ছিল, থাকবে।
শুধু একটু সতর্কতা চাই। ভাগ্যের ওপর কারো হাত নেই; কিন্তু যা এড়ানো যায়, সতর্ক হয়ে সেটুকু করা অবশ্যই উচিত। হ
লেখক : কথাশিল্পী, সাংবাদিক

নিউজটি শেয়ার করুন..

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো খবর..
© All rights reserved © 2019 bangladeshdailyonline.com
Theme Dwonload From ThemesBazar.Com