অনেক ধর্মপ্রাণ মুসলিম তাদের ছেলেমেয়েদের বিয়ের কার্ডে মহাগ্রন্থ আল কুরআন নিম্নলিখিত আয়াতটি লিখে থাকেন- ‘আর তাঁর নিদর্শনসমূহের মধ্যে রয়েছে, তিনি তোমাদের জন্য তোমাদেরই জাতি থেকে সৃষ্টি করেছেন স্ত্রীগণকে, যাতে তোমরা তাদের কাছে প্রশান্তি লাভ করো এবং তোমাদের মধ্যে ভালোবাসা ও দয়ামায়া সৃষ্টি করেছেন। অবশ্যই এর মধ্যে বহু নিদর্শন রয়েছে তাদের জন্য যারা চিন্তাভাবনা করে।’ (আল কুরআন ৩০:২১)
কুরআনের আধুনিক তাফসির তাহফিমুল কুরআনে এ আয়াতটির ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে যে- ‘ভালোবাসা বলতে এখানে কামসিক্ত ভালোবাসার (Sexual love) কথা বলা হয়েছে। নারী ও পুরুষের এটি আকর্ষণের প্রাথমিক উদ্যোক্তায় পরিণত হয়। তারপর এটি তাদের মধ্যে স্থায়ী বন্ধুত্বের এমন এক সম্পর্ক জুড়ে দেয়, যা দু’টি পৃথক পরিবেশে লালিত আগন্তুককে একসাথে মিলিয়ে গভীরভাবে সংযুক্ত করে দেয়। আর রহমত তথা দয়া হচ্ছে এমন একটি আত্মিক সম্পর্ক, যা স্বামী-স্ত্রীর জীবনে পর্যায়ক্রমে বিকাশ লাভ করে। এ কথা স্পষ্ট যে, কোটি কোটি মানুষ তাদের জীবনে এই ভালোবাসা ও দয়ার অভিজ্ঞতা লাভ করেছে। একজন নারী ও পুরুষের শারীরিক গঠনে যেসব উপাদানের সমাবেশ ঘটানো হয়েছে, তা নিশ্চিতভাবে ব্যাখ্যা করে যে, একজন প্রাজ্ঞ স্রষ্টা স্বেচ্ছাকৃতভাবে একটি উদ্দেশ্য সাধনের উদ্দেশ্যে পূর্ণ সামঞ্জস্যসহকারে তা সংস্থাপন করে দিয়েছেন (তাহফিমুল কুরআন,খণ্ড-১১ পৃষ্ঠা : ৬৮-৬৯)
এই হচ্ছে বিয়ে পরবর্তী ভালোবাসার সুফল। আয়াতটির শুরুতে মহান আল্লাহ বিয়েকে তাঁর একটি নিদর্শন হিসেবে উল্লেখ করেছেন। আয়াতটির শেষে তিনি বলেছেন, এর মধ্যে বহু নিদর্শন রয়েছে তাদের জন্য যারা চিন্তাভাবনা করে। আমরা কি চিন্তা করে দেখেছি, একটি গাভীর যৌন আকাক্সক্ষা বছরে মাত্র একবার? তাও উদ্দেশ্য হচ্ছে শুধু সন্তান ধারণ করা। অথচ মানুষের যৌন আকাক্সক্ষা বছরে অসংখ্যবার। এর কারণ হচ্ছে, বিভিন্ন গৃহপালিত প্রাণীকে মানুষের কল্যাণে সৃষ্টি করা হয়েছে। তাদের জন্য রতিক্রিয়াকে (সেক্স) বিনোদনের কোনো মাধ্যম বানানো হয়নি। তারও কারণ রয়েছে। গৃহপালিত প্রাণীদের বাচ্চাগুলো জন্মের পরে কিছু দিনের মধ্যেই স্বাবলম্বী হয়ে যায়। জন্মের এক বছর পর গরু তার সন্তানকে চিনতে পারে না। সন্তানও তার মাকে শনাক্ত করতে সক্ষম হয় না। অথচ মানব শিশু তাদের চেয়ে খুবই দুর্বল অবস্থায় জন্মগ্রহণ করে। এ শিশুটি স্বাবলম্বী হওয়ার জন্য বাবা-মা উভয়ের দীর্ঘ দিনের অনেক শ্রমের প্রয়োজন হয়। এভাবেই পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র বিকশিত হয়ে থাকে। মা-বাবার দৃঢ় বন্ধন তথা মানব শিশুর বিকাশের জন্য কামসিক্ত ভালোবাসা বিরাট ভূমিকা পালন করে থাকে। অর্থাৎ মা-বাবার সামাজিক দায়িত্ব পালনের পুরস্কার হিসেবে মহান আল্লাহ বিভিন্ন সৃষ্টির মধ্যে শুধু মানুষের জন্য যৌনতাকে দীর্ঘস্থায়ী বিনোদনের মাধ্যম বানিয়েছেন।
প্রাণীদের যৌনমিলন হয় উন্মুক্ত স্থানে, তাতে কোনো ভালোবাসা নেই, নেই কোনো পূর্বপরিচিতি, প্রতিনিয়ত যৌন সাথী পরিবর্তিত হয় আর মিলন-পরবর্তীও আর কোনো বন্ধন থাকে না। তবে তাদের যৌনাচার কঠোর নিয়মে বাঁধা। মহান আল্লাহর দেয়া সুনির্দিষ্ট পদ্ধতির বাইরে যাওয়ার কথা তারা চিন্তাও করতে পারে না। আর মানুষের যৌন মিলন অনেক দিক থেকে অনন্য বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। স্বামী-স্ত্রীকে একই বিছানায় শয়ন করতে হয়। সাধারণত মুখোমুখি অবস্থান করতে হয়, যৌন মিলনের জন্য রাতের অন্ধকার বা দিনের নির্জনতা বেছে নিতে হয় এবং দৈহিক মিলনের আগে ভালোবাসা (Foreplay) প্রদর্শন করতে হয়।
‘আর আমি তো আদম সন্তানদের সম্মানিত করেছি এবং তাদেরকে স্থলে ও সমুদ্রে বাহন দিয়েছি, তাদেরকে দিয়েছি উত্তম রিজিক। আর আমাদের বহুসংখ্যক সৃষ্টির ওপর তাদের সুস্পষ্ট প্রাধান্য দান করেছি।’ (আল কুরআন ১৭:৭০) মানুষ ও অন্যান্য সৃষ্টির অস্তিত্ব, স্থায়িত্ব ও বংশধারা বজায় রাখার জন্য মহান আল্লাহ এই কামসিক্ত ভালোবাসার ব্যবস্থা রেখেছেন। এর মাধ্যমে প্রাণিজগতে তাঁর সৃষ্টিধারা নিরবচ্ছিন্নভাবে লাখ লাখ বছর ধরে বহাল রয়েছে। মানুষ হচ্ছে এর ব্যতিক্রম। এর যথোপযুক্ত ব্যবহার না করায় বিভিন্ন জাতি ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে। লুত আ:-এর জাতির ধ্বংস ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে আছে আজো লুত সাগরে। সমকামিতার কারণে মহান আল্লাহ তাদেরকে তিন ধরনের কঠোর শাস্তি দিয়ে ধ্বংস করেছিলেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ফরাসি বাহিনীতে যৌন রোগ এত ছড়িয়ে পড়ে যে, সহজেই তারা শত্রুবাহিনীর কাছে পরাজিত হয়। এইচআইভি আফ্রিকার অনেক দেশে মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়েছে এবং কোনো কোনো দেশ ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। শুধু ২০২০ সালে ছয় লাখ ৮০ হাজার মানুষ এ রোগে মৃত্যুবরণ করেছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, বর্তমানে পৃথিবীতে বিভিন্ন রোগের মধ্যে ২০ শতাংশ মহিলা ও ১৪ শতাংশ পুরুষ যৌন রোগে আক্রান্ত। যৌন স্বেচ্ছাচার ইউরোপের অনেক জাতিকে বিলীন করে দিচ্ছে। জার্মানিতে ১৯৭০ সাল থেকে জন্মহার মৃত্যুহারের চেয়ে কম। প্রফেসর হান্টিংটন তার Clash of Civilizations বইয়ে উল্লেখ করেছেন, ইউরোপের উন্নত জাতিগুলো তাদের শক্তিশালী সশস্ত্রবাহিনী, সুন্দর শিক্ষাব্যবস্থা, দক্ষ প্রশাসন, অত্যাধুনিক যুদ্ধোপকরণ, ইন্টারনেট, বৈজ্ঞানিক উন্নতি সব কিছু থাকার পরও ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে শুধু জনসংখ্যার অভাবে। আমি জার্মানিতে দেখেছি- বিয়ে, পরিবার, অধিক সন্তান নেয়া ইত্যাদির পক্ষে কত প্রচারণা ও প্রণোদনা। আধুনিক বিশ্ব কিভাবে কম্পিউটার, গাড়ি, মারণাস্ত্র ও অন্যান্য ভোগ্যপণ্য উৎপাদন করতে হয়, তা জানে কিন্তু মানুষ তৈরি করার ব্যাপারে তারা আজ অসহায়। তাই অস্তিত্বের জন্যই তাদের ইসলামের দিকে ফিরে আসতে হবে।
বিয়ে হচ্ছে মহান আল্লাহর দেয়া এমন এক উপহার, যা বেহেশত থেকে মানুষ এ পৃথিবীতে নিয়ে এসেছে। কোনো কোনো ধর্মে সাত ধরনের বিয়ে, যৌতুক প্রথা প্রবর্তন করে, বিধবা বিয়ে ও বিচ্ছেদকে নিষিদ্ধ করে সংসার জীবনে জটিলতা সৃষ্টি করা হয়েছে। কোনো কোনো ধর্ম আধ্যাত্মিকতার মাপকাঠি হিসেবে বিয়েকেই নিষিদ্ধ করে চিরকুমার ও চিরকুমারিত্বকে উৎসাহিত করেছে। এর প্রতিবাদে ভ্যালেন্টাইন নামক এক ধর্মযাজক অবৈধ যৌনাচার, ধর্ষণ ইত্যাদি শুরু করলে তাকে ফাঁসি দেয়া হয়। এখন আবার তারাই বছরে এক দিন ভ্যালেন্টাইন ডে বা ভালোবাসা দিবস পালন করছে। অথচ মহান আল্লাহ বিয়ের মাধ্যমে ভালোবাসা সপ্তাহ, ভালোবাসা মাস, ভালোবাসা বছর ও ভালোবাসা জীবন প্রবর্তন করে এটি তাঁর একটি নিয়ামত হিসেবে উল্লেখ করেছেন।
ইসলামে পারিবারিক জীবনকে আধ্যাত্মিকতার সাথে সম্পৃক্ত করা হয়েছে। ‘(হে মুহাম্মদ) তোমার আগেও আমি অনেক রাসূল পাঠিয়েছি। আর তাদের জন্যও স্ত্রী ও সন্তানের ব্যবস্থা করেছি।’ (আল কুরআন ১৩:৮) ‘আর আল্লাহ তোমাদের জন্য তোমাদের থেকে জোড়া সৃষ্টি করেছেন এবং তোমাদের জোড়া থেকে তোমাদের পুত্র-কন্যা, নাতি-নাতনি সৃষ্টি করেছেন।’ (আল কুরআন ১৬:৭২) রাসূল সা:ও এ ধারণা সুন্দরভাবে প্রকাশ করেছেন- ‘তোমাদের দুনিয়া থেকে নারী ও সুগন্ধিকে আমার কাছে প্রিয় করা হয়েছে। আর নামাজ হচ্ছে আমার চক্ষু শীতলকারী।’ তিনি আরো বলেন, ‘বিয়ে করা আমার রীতি ও স্থায়ী কর্মপন্থা। অতএব যে ব্যক্তি আমার এ সুন্নাত ও রীতি অনুযায়ী আমল করবে না সে আমার উম্মতের অন্তর্ভুক্ত নয়।’ (ইবনে মাজাহ)
রাসূল সা: আরো বলেন, ‘যখন কেউ বিয়ে করে সে দ্বীনের অর্ধেক অংশ পূর্ণ করে।’ এভাবে মহান আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (সা:) বিয়ে ও পারিবারিক জীবনকে উৎসাহিত করেছেন। দুঃখজনকভাবে সত্যি যে, পাশ্চাত্য জীবনধারায় বিয়ে ও পারিবারিক জীবনের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে অবজ্ঞা করে জাতিগুলো অস্তিত্বের সঙ্কটে নিপতিত হতে যাচ্ছে। ইসলামে নিষিদ্ধ জিনিসগুলো যেমন- মদ, ক্যাসিনো (জুয়া), অশ্লীল ছায়াছবি, পর্নোগ্রাফি, নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশা, লিভ টুগেদার, লাগামহীন যৌনাচার, গর্ভপাত, পতিতাবৃত্তি, সমকামিতা, জটিল পারিবারিক আইন, ঘরের বাইরে মহিলাদের জীবিকার জন্য কঠোর পরিশ্রম ইত্যাদি পাশ্চাত্যে পরিবার গঠনে প্রতিবন্ধক হিসেবে কাজ করছে। আমার এক খ্রিষ্টান সহপাঠী বলত, দোকানে যদি দুধ কিনতে পাওয়া যায়, তা হলে গরু কিনে লাভ কী! পাশ্চাত্যের ধ্বংসপ্রায় পারিবারিক ব্যবস্থায় হতাশ হয়ে মানুষ বিশেষ করে মহিলারা অধিক হারে বর্তমানে ইসলাম গ্রহণ করছে। তবে তাদের এ বোধোদয় হতে কয়েক শ’ বছর লেগেছে বা এখনো লাগছে।
বিপরীত কথা হচ্ছে- আমাদের নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের অনেকে পাশ্চাত্য জীবনকে রঙিন চশমা দিয়ে দেখছে। এর প্রভাবে বিয়ে করা বর্তমানে আমাদের শহুরে সমাজে জটিল হয়ে যাচ্ছে আর ঠুনকো কারণে বিয়ে বিচ্ছেদ ঘটে যাচ্ছে। এভাবে তারা একাকিত্বের জীবন বেছে নিয়ে নানা রকম মানসিক ও সামাজিক অস্থিরতার কারণ হচ্ছে। তাদের ভাবনায় হয়তো আছে ‘প্রেম একবারই আসে হায়’। রাসূল সা: বলেছেন, ‘যার স্ত্রী নেই সে দরিদ্র দরিদ্র দরিদ্র, যদিও সে বিরাট সম্পদশালী হয়ে থাকে। যে নারীর স্বামী নেই সে মিসকিন মিসকিন মিসকিন, যদিও সে সম্পদশালী হয়ে থাকে (গুনিয়াতুত তালেবিন, আবদুল কাদের জিলানি) রাসূল সা: আরো বলেন, ‘হে যুবসমাজ! তোমাদের মধ্যে যে বিয়ের সামর্থ্য রাখে, সে যেন বিয়ে করে নেয়। কেননা বিয়ে দৃষ্টিকে নিচু করে এবং তার যৌন জীবনকে সংযমী করে আর যে বিয়ের সামর্থ্য রাখে না সে যেন সিয়াম পালন করে। কেননা সিয়াম তার যৌন কামনা কমিয়ে দেয়।’ (বুখারি) রাসূল সা: ও তাঁর সাহাবিরা ছিলেন আমাদের সময়ের চেয়ে অনেক বেশি প্রগতিশীল ও আধুনিক। ওই সময় কোনো মহিলা বা পুরুষকে একাকী থাকতে হতো না। অথচ বর্তমানে ইউরোপে ঝঢ়রহংঃবৎ বা চিরকুমারী মেয়ের সংখ্যা প্রায় ৪০ শতাংশ। যুক্তরাষ্ট্রে বিয়ে বিচ্ছেদের হার হচ্ছে ৫০ শতাংশ ।
সাহাবিদের সময় গায়ের রঙ, উচ্চতা, বয়স, কুমারিত্ব, সম্পদ, সামাজিক মর্যাদা ইত্যাদি বিবেচনা করা হতো না। তাকওয়া বা পরহেজগারি ছিল তাদের মাপকাঠি । রাসূল সা:-এর সহধর্মিণীরা ছিলেন সবাই বিধবা শুধু একজন ছাড়া। জান্নাতি এ মহিলাকে বিয়ে কে করবে, রাসূল সা:-এর এ ঘোষণা শুনে জায়েদ রা: তার চেয়ে বয়সে বেশ বড় কৃষ্ণকায় দাসী বারাকা রা:-কে বিয়ে করেন। তৎকালীন প্রভাবশালী খলিফা ওমর রা: সামাজিক মর্যাদা ভুলে গিয়ে গোয়ালিনীর এক দ্বীনদার মেয়ের সাথে তার ছেলের বিয়ের ব্যবস্থা করেন। ওমর রা:-এর শাহাদতের পর তার স্ত্রী আতিকা রা: একাকী থাকা পছন্দ করেননি, বরং জুুবায়ের রা:-এর সাথে বিয়ে বন্ধনে আবদ্ধ হন তার আরো স্ত্রী থাকা সত্ত্বেও। আনাস রা: তার ভাইবোনরা কিছুটা বড় হলে তার বিধবা মায়ের বিয়ের ব্যবস্থা করেন।
যে সময়ে অবাধ যৌনাচার, পতিতাবৃত্তি, মেয়েদের জীবন্ত কবর দেয়া, মহিলাদের উলঙ্গ হয়ে কাবা তাওয়াফ করা, পিতার মৃত্যুর পর সৎমাকে বিয়ে করা, স্ত্রীর মর্যাদা ছিল ঘোড়ার চেয়ে কম, সেখানে ইসলাম অনেক সামাজিক সংস্কারের পাশাপাশি বিয়ের মাধ্যমে এমন এক ভারসাম্যপূর্ণ সমাজ প্রতিষ্ঠা করে, যা পৃথিবীর ইতিহাসে স্বর্ণযুগ হয়ে থাকবে।
লেখক : মেডিসিন ও হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ