সোমবার, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ১২:২৩ অপরাহ্ন

মহানবীর প্রতি মহাত্মা গান্ধীর সম্মান বিজেপি নেতার কটূক্তি

রিপোর্টারের নাম
  • আপডেট টাইম : বুধবার, ১৫ জুন, ২০২২
  • ১১৬ বার

‘আমি সর্বপ্রথম দক্ষিণ আফ্রিকায় যাই, একজন মুসলমানের মালিকানাধীন আইনি প্রতিষ্ঠান বা ল’ ফার্মে চাকরির সুবাদে। সেখানে আমার কয়েকজন মুসলমান বন্ধুর সঙ্গে মেশার সৌভাগ্য হয়, যা বছরের পর বছর বজায় ছিল। এই সম্পর্কের সূত্র ধরে আমি উপলব্ধি করি যে, নবী হজরত মুহাম্মদ সা:-এর জীবন সম্পর্কে আমার জানা উচিত। আমি দক্ষিণ আফ্রিকাতেই তাঁর সম্পর্কে জানা শুরু করি। তা পর্যাপ্ত ছিল না কিন্তু ভারতে ফিরে আমি কারারুদ্ধ হই। এই কারাগার আমার জীবনে হজরত মুহাম্মদ সা:-এর জীবনী পাঠ করার সৌভাগ্য নিয়ে আসে। আমার পাঠলব্ধ জ্ঞান থেকে আমি অনুধাবন করি মহানবী হজরত মুহাম্মদ সা: ছিলেন একজন সত্যের সন্ধানী। তিনি ছিলেন খোদাভীরু। আমি জানি, তোমাদের নতুন কিছু বলছি না। আমি শুধু বুঝাতে চাই কীভাবে তাঁর জীবনী আমাকে মুগ্ধ ও বিমোহিত করেছে।’ উপরোক্ত সত্যবচন ভারতের জাতির পিতা মহাত্মা গান্ধীর।

প্রায় ২০০ বছরের ইংরেজ শাসন, শোষণ এবং সীমাহীন অত্যাচার থেকে তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের স্বাধীনতা এনে দিতে সামনে থেকে নেতৃত্ব দেয়া এক ক্ষণজন্ম চরিত্র মোহনদাস করম চাঁদ গান্ধী ওরফে মহাত্মা গান্ধী। ‘দি টাইমস অব ইন্ডিয়া’ পত্রিকা ২০১৬ সালের ১২ ডিসেম্বর ‘দি প্রফেট ওয়াজ এ সিকার অব ট্রুথ : মহাত্মা গান্ধী’ অর্থাৎ মহানবী সা: ছিলেন একজন সত্যের সন্ধানী এ শিরোনামে একটি প্রবন্ধ প্রকাশ করে। প্রবন্ধ মতে, ১৯৩৪ সালের ২৩ জুন তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতে মহাত্মা গান্ধী আহমেদাবাদে আঞ্জুমান-এ ফিদাই ইসলাম নামক একটি সংগঠন কর্তৃক আয়োজিত অনুষ্ঠানে মহানবী সা:-এর অসাধারণ জীবনীর ওপর উপরোক্ত মন্তব্য করেন। মহাত্মা গান্ধী মহানবী সা: সম্পর্কে আরো বলেন, ‘হজরত মুহাম্মদ সা: দারিদ্র্যের মাঝে দিন অতিবাহিত করেছেন, অথচ তাঁর সামনে ছিল অগাধ ধনসম্পদ লাভের সুযোগ। আমি যখন তাঁর নিজের, পরিবার এবং অনুসারীদের অবর্ণনীয় দুঃখ-দুর্দশা ও দারিদ্র্যের কথা অবগত হয়েছি, তখন আমার চোখ ভিজে যায়। তিনি স্রষ্টার প্রতি একনিষ্ঠ ও অনুগত ছিলেন, সর্বদা স্রষ্টাকে ভয় করতেন এবং তাঁর মনে ছিল মানবজাতির জন্য প্রবল মায়া-মমতা।’

বিশ্ব মানবতার মুক্তির দিশারি হজরত মুহাম্মদ সা:-এর অমীয় বাণী হাদিসগ্রন্থ পড়ে গান্ধী এতই মুগ্ধ হন যে, এই হাদিস তথা মহানবী সা:-এর বাণীকে তিনি কেবল মুসলমান নয়; বরং সমগ্র মানবজাতির জন্য অমূল্য সম্পদ বলে উল্লেখ করেন। ঢাকা থেকে প্রকাশিত দি ডেইলি স্টার পত্রিকার মাসিক প্রকাশনা ‘দি ফোরাম’-এর আগস্ট ২০১০ সংখ্যায় ‘গান্ধী অ্যান্ড ইসলাম’ শীর্ষক একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। এই প্রবন্ধ মতে, মহাত্মা গান্ধী মহানবী সা: সম্পর্কে জানতে এতই আগ্রহী ছিলেন যে, যখন তিনি মহানবী সা: সম্পর্কিত পড়ার মতো কিছুই পেতেন না, তখন খুবই দুঃখ অনুভব করতেন। মহাত্মা গান্ধী বলেন, ‘আমি শ্রেষ্ঠতম সেই মানুষের জীবন সম্পর্কে আরো জানতে চাই, যিনি আজ কোটি কোটি মানুষের হৃদয়ে প্রভাব বিস্তার করে আছেন। আমি নিশ্চিত যে, এর নেপথ্যে তরবারি বা গায়ের জোরে নয়; বরং মহানবী সা:-এর সারল্য, আত্মত্যাগ, দৃঢ়সঙ্কল্প, ভক্ত ও অনুসারীদের প্রতি মমত্ববোধ, সৎসাহস সর্বোপরি নিজের উদ্দেশ্য ও সৃষ্টিকর্তার ওপর অগাধ আস্থা তাঁকে এই সাফল্য এনে দিয়েছিল।’

এছাড়া স্বাধীন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী পণ্ডিত জওয়াহের লাল নেহরু, স্যার পিসি রাম, স্বামী আহিয়ার, স্বামী বিবেকানন্দ, সবোজনী নাইডু, এনি এ বেচান্ত, বেদ প্রকাশ উপাধ্যায়, সুশান্ত ভট্টাচার্য, এম এন রায়, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বি এন পান্ডে, স্বামী লক্ষ্মী শঙ্করাচার্যদের চোখ সৃষ্টির শ্রেষ্ঠজন সা:-কে চিনতে ভুল করেননি। তারাও স্বীকার করেছেন নবী মোস্তফা সা:-এর শ্রেষ্ঠত্ব।

প্রকৃতপক্ষে স্বয়ং আল্লাহ তায়ালাই মহানবী হজরত মুহাম্মাদ সা:-কে সমগ্র মানব জাতির জীবনাদর্শ হিসেবে ঘোষণা করেছেন। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলেন, ‘ওয়া ইন্নাকা লাআলা খুলকিন আজিম।’

হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিশ্ব মানবতার অনুপম আদর্শ। ক্ষমা, দয়া, ধৈর্য, সহনশীলতা, মহানুভবতা ইত্যাদি গুণাবলি তাঁর চরিত্রের প্রধান বৈশিষ্ট্য। তাঁর পবিত্র পয়গাম কোনো বিশেষ জাতি বা ভৌগোলিক পরিসীমার মধ্যে আবদ্ধ ছিল না। তাঁর নবুয়ত বিশ্বব্যাপী সব মানুষের কল্যাণের জন্য প্রযোজ্য ছিল। এ জন্য প্রত্যেক জাতির কবি-সাহিত্যিক, রাজনীতিবিদ, ধর্মগুরু তথা পণ্ডিতরা প্রিয়নবী সা:-এর প্রশংসায় পঞ্চমুখ ছিলেন। বিশ্ব মানবমণ্ডলীর হিদায়াতের জন্য আমাদের প্রিয়নবী মুহাম্মাদ সা:-কে প্রেরণ করা হয়েছে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, তিনি বিভিন্ন সময় নানা রকমের বাধা বিপত্তি ও অবমাননার শিকার হয়েছেন। হজরতের নবুয়ত প্রকাশের শুরু থেকে আজ পর্যন্ত বিভিন্ন রকমের কটূক্তি, অবমাননা, এমনকি তাঁর পরিবারের ওপর অপবাদ দেয়া হয়েছে। হুজুর পাকের নাম বিকৃতি করা, পূতপবিত্র চরিত্র নিয়ে আপত্তিকর মন্তব্য করা, বিভিন্ন ইবাদত নিয়ে ব্যঙ্গ করাসহ নানাভাবে পত্রিকা, ব্লগ, ফেসবুক ও বিভিন্ন মিডিয়ায় তাঁকে অবমাননা করা হচ্ছে।

প্রিয় নবীকে কটূক্তিকারী নির্লজ্জদের কাতারে শামিল হয়েছে ভারতের ক্ষমতাসীন দল বিজেপির মুখপাত্র নূপুর শর্মা ও নবীন কুমার জিন্দাল। যেখানে ভারতের জনক মহাত্মা গান্ধী ও প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওয়াহের লাল নেহরুসহ ভারতীয় পণ্ডিতরা মহানবী হজরত মুহাম্মদ সা:-এর শ্রেষ্ঠত্ব স্বীকার করেছেন, সেখানে মহানবী সা:-এর প্রতি বিজেপি নেতার কটূক্তি রাষ্ট্রদ্রোহিতার শামিল। পৃথিবীর সর্ববৃহৎ গণতান্ত্রিক দেশ ভারত নিজেদের সাংবিধানিকভাবে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসেবে নিজেদের উপস্থাপন করে। সে ক্ষেত্রে ভারতের ৩০ কোটিসহ পৃথিবীর ২০০ কোটি মুসলমানের হৃদয়ের সূর্য হুজুর সা:-কে কটূক্তি নিঃসন্দেহে সংবিধান অবমাননা এবং আন্তর্জাতিক অপরাধ।

রাসূল সা:-এর ওপর অপবাদ ও তাঁর ব্যাপারে কুৎসা রটনা মানবাধিকার লঙ্ঘন। এ ধরনের জঘন্য কাজ কোনো বিবেকবান মানুষ করতে পারে না। যারা এ ধরনের কাজে লিপ্ত থাকে মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায়ে তাদের দণ্ডিত করাই আইনের দাবি। রাসূল সা:-এর শানে অবমাননা একটি ফিতনাহ-ফাসাদতুল্য অপরাধ। কারণ এর লক্ষ্য হলো মানুষের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করা ও সমাজে অশান্তি তৈরি করা। ভিন্নধর্মাবলম্বীদের প্রতি হিংসার আগুন জ্বালিয়ে দেয়াসহ ধর্মপ্রিয় মানুষকে আঘাত করা। রাসূলুল্লাহ সা:-এর অবমাননা এবং তাঁকে বিদ্রুপ করার অধিকার কারো নেই। যে রাসূলকে অবমাননা এবং তাঁকে বিদ্রুপ করবে তার পরিণাম হবে অত্যন্ত ভয়াবহ। আর এ অপরাধের জন্য তাকে সর্বোচ্চ শাস্তির বিধানও রয়েছে। মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘নিশ্চয় যারা আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলকে কষ্ট দেয়, আল্লাহ তাদের প্রতি দুনিয়া ও আখিরাতে অভিসম্পাত করেন এবং তাদের জন্য প্রস্তুত রেখেছেন অবমাননাকর শাস্তি’ (সূরা আল-আহযাব-৫৭)।

মহানবী সা: ও উম্মুল মুমেনিন আয়েশা সিদ্দিকা রা:-এর ব্যাপারে কটূক্তি মুসলিম বিশ্ব সহ্য করবে না। মুসলমান নয় বিবেকবান মানুষমাত্রই প্রিয় নবীর অবমাননা মেনে নেবে না। নূপুর শর্মাসহ দুই নেতার অবমাননাকর মন্তব্যে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে আরব বিশ্ব। সৌদি আরব, কাতার, কুয়েত ও ইরান ভারতীয় রাষ্ট্রদূতকে তলব করেছে। ভারতীয় পণ্য বর্জন করে প্রতিবাদ চলছে দেশে দেশে। এ পরিস্থিতিতে ভারত সরকারের উচিত, জাতির জনক মহাত্মা গান্ধীর দৃষ্টিতে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ পূতপবিত্র চরিত্রের অধিকারী মহানবী হজরত মুহাম্মদ সা:-কে কটূক্তিকারী বিজেপি নেতা নূপুর শর্মা ও নবীন কুমার জিন্দালকে ভারতের সংবিধান অবমাননা ও রাষ্ট্রদ্রোহিতার অপরাধে সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করে জাতির জনকের সম্মান, সংবিধানের পবিত্রতা, রাষ্ট্রের সুনাম অক্ষুণ্ন রাখা।

লেখক : খতিব, কাজীপাড়া জামে মসজিদ, চট্টগ্রাম।

নিউজটি শেয়ার করুন..

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো খবর..
© All rights reserved © 2019 bangladeshdailyonline.com
Theme Dwonload From ThemesBazar.Com