রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ০২:৩৭ অপরাহ্ন

বাজেটে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগকারীরা হতাশ

আবু আহমেদ
  • আপডেট টাইম : রবিবার, ১৯ জুন, ২০২২
  • ১৪৩ বার

জাতীয় বাজেট প্রণয়নের আগে পুঁজিবাজারের জন্য প্রাতিষ্ঠানিক ও ব্যক্তি পর্যায়ে যেসব পরামর্শ দেওয়া হয়, এগুলোর প্রায় সবই অভিন্ন বিষয়। সবই অভিন্ন স্বার্থে দেওয়া হয়। পরামর্শগুলো যতটা না কয়েক হাজার ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীর স্বার্থে দেওয়া হয়, তার চেয়ে অনেক বেশি দেওয়া হয় দেশের সামগ্রিক অর্থনীতির স্বার্থে। এর পরও দুর্ভাগ্যজনকভাবে অর্থবিল লেখার সময় এসবের কোনোটাই আমলে নেওয়া হয় না।

প্রস্তাবিত বাজেট বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, বাজেটে তালিকাভুক্ত কম্পানির ক্ষেত্রে যে আড়াই শতাংশ করপোরেট কর কমানো হয়েছে, সেটা প্রায় এক-চতুর্থাংশ তালিকাভুক্ত (লিস্টেড) কম্পানির জন্যই প্রযোজ্য নয়। এর অর্থ দাঁড়াচ্ছে, তালিকাভুক্ত বিপুলসংখ্যক কম্পানিকে কোনো সুবিধাই দেওয়া হয়নি। অথচ তালিকাবহির্ভূত (নন-লিস্টেড) কম্পানিগুলোর জন্য ঢালাওভাবে আড়াই শতাংশ করপোরেট কর কমানো হয়েছে, যদিও ব্যাংকগুলো বাদ পড়েছে। লক্ষণীয় ব্যাপার হচ্ছে, তালিকাভুক্ত কোনো কম্পানিকে আড়াই শতাংশ করছাড় দেওয়ার জন্য তার পরিশোধিত মূলধনের ১০ শতাংশের বেশি শেয়ারবাজারে অফলোড করতে হবে বলে শর্ত দেওয়া হয়েছে। এ শর্তটি ঠিক আছে; কিন্তু তালিকাবহির্ভূত কম্পানিগুলোকে যে আড়াই শতাংশ করপোরেট করছাড় দেওয়া হলো, তাদের বেলায় কোনো শর্ত দেওয়া হয়েছে বলে কেউ কি বলতে পারবেন?

প্রস্তাবিত বাজেটে পুঁজিবাজারের জন্য অনেক কিছু দেওয়া হয়েছে—অর্থমন্ত্রী মহোদয় সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে এমন আভাস দিয়েছেন। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে শেয়ারবাজারের বিনিয়োগকারীরা পরিষ্কারভাবে শুনতে চায় আসলেই কী কী দেওয়া হয়েছে। মনে রাখা দরকার, বর্তমান অর্থমন্ত্রী মহোদয়ের প্রথম বাজেটেই তালিকাভুক্ত ও তালিকাবহির্ভূত কম্পানিগুলোর করপোরেট করছাড়ের পার্থক্যটা আড়াই শতাংশে নিয়ে আসা হয়েছে। আমার আহবান থাকবে, অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে বলা হোক, শেয়ারবাজারের সুবিধা থেকে তারা কিছু কেটে নেননি; বরং অতিরিক্ত কিছু দিয়েছেন। এটা যেন তারা পরিষ্কারভাবে প্রকাশ করেন। বাজেটে একসময় লভ্যাংশের (ডিভিডেন্ড) করমুক্ত আয় এক লাখ টাকা ছিল। এটা কমিয়ে একসময় ২৫ হাজার এবং পরে তা বাড়িয়ে ৫০ হাজার টাকা করা হয়। সুতরাং এ ক্ষেত্রেও বাজেটে নতুন করে কিছু করা হয়নি।

একটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে, তালিকাভুক্ত কম্পানিগুলোর শুধু করপোরেট আয়কর কমানোর দিকটি দেখা হলে মনে হবে বিশেষ কিছু করা হয়েছে। কিন্তু কম্পানিগুলোর ওপর বিভিন্ন ধরনের বাড়তি করারোপ করা হয়। যেমন—তালিকাভুক্ত কম্পানিগুলোর মধ্যে গ্রামীণফোন ৬৫ শতাংশ পর্যন্ত কর দেয়। এর মধ্যে সারচার্জসহ অতিরিক্ত বিভিন্ন কর রয়েছে। কয়েক দিন আগে একটি বিদেশি কম্পানির সিইও বললেন, এবার বাজেটে যে ২০ শতাংশ করপোরেট কর প্রস্তাব করা হয়েছে এটা ভালো। কিন্তু যদি বাড়তি বিভিন্ন কর ধরা হয়, তাহলে এটা ৩০ বা ৪০ শতাংশ পর্যন্ত পৌঁছে। সুতরাং বাংলাদেশে কাগজে-কলমে যা দেখানো হচ্ছে, প্রকৃত করপোরেট কর এর থেকে অনেক বেশি।

এখানে একটা কথা বলা দরকার, যেকোনো পুঁজিবাজারের মূল চালিকাশক্তি হচ্ছে কম্পানির ফান্ডামেন্টাল। কম্পানির ফান্ডামেন্টাল যদি ভালো হয়, তাহলে ভালো ডিভিডেন্ড দেয়। কিন্তু আমাদের সিস্টেমে ভালো ডিভিডেন্ড দেওয়ার কোনো উৎসাহ কি আছে? জবাবটি হচ্ছে নেই। তবে একসময় ছিল। ২৫ শতাংশ বা এর অতিরিক্ত ডিভিডেন্ড দিলে করছাড় পেত কম্পানিগুলো। সেটা অনেক আগেই তুলে দেওয়া হয়েছে। মোটকথা, শেয়ারবাজারে যেসব প্রণোদনা ও সুবিধা ছিল এবং তালিকাভুক্ত ও তালিকাবহির্ভূত কম্পানির মধ্যে করপোরেট করের পার্থক্য একসময় যা ১০ শতাংশ ছিল, তার সবই আস্তে আস্তে তুলে নেওয়া হয়েছে।

খুব বিস্ময়ের সঙ্গে প্রত্যক্ষ করলাম, বিভিন্ন মহল থেকে পুঁজিবাজারকে কিছু সুবিধা দেওয়ার জন্য জোরালো আহবান জানানো সত্ত্বেও বাজেটসংশ্লিষ্টরা তা গুরুত্বের সঙ্গে নেয়নি। অথচ পুঁজিবাজারের ইস্যুটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এখানে কোনো লবিতেই কাজ হয়নি। এই পরিস্থিতিতে পুঁজিবাজারের স্বার্থ দেখার উপায় কী? এ ক্ষেত্রে আমার একটা বিকল্পই অবশিষ্ট আছে বলে মনে হচ্ছে। সেটা হচ্ছে, আমাদের মন্ত্রিপরিষদের সব সদস্যের সঞ্চয়ের বেশির ভাগ যদি শেয়ারবাজারে রাখা যায়, তাহলেই কেবল কিছু হতে পারে। যত দিন প্লট, ফ্ল্যাট আর সঞ্চয়পত্র ও ব্যাংকের মধ্যে তাঁদের বিনিয়োগ সীমাবদ্ধ থাকবে, তত দিন পর্যন্ত শেয়ারবাজারের কথা শোনা হবে; কিন্তু মানা হবে না। যদি এমন নিয়ম করে দেওয়া হয় যে শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিদের সম্পদের বিরাট একটা অংশ স্টক মার্কেটে বিনিয়োগ করতে হবে, তাহলেই কেবল কিছু আশা করা যায়। মানে হচ্ছে শেয়ারবাজারসংক্রান্ত পরামর্শগুলো বাজেট প্রস্তুতকারীরা ময়লার বাক্সে ফেলে দেন। এর বাইরে অন্য কোনো ব্যাখ্যা দাঁড়ায় না।

দিন শেষে একটি স্টক মার্কেটে একজন বিনিয়োগকারী কেন বিনিয়োগ করবেন তা নির্ভর করে তিনি কতটা ডিভিডেন্ড পাবেন তার ওপর। আর ডিভিডেন্ড পাওয়াটা নির্ভর করে কম্পানির ‘আর্নিং পার শেয়ারের’ ওপর। আর আর্নিং পার শেয়ার নির্ভর করে করসহ অন্য কিছু বিষয়ের ওপর। এর মধ্যে যারা ম্যানুফ্যাকচারার, তাদের জন্য অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে বিভিন্ন ধরনের করহার। আর এ জন্যই আমরা কম্পানির ওপর কর কমাতে বলি।

বাজেট প্রণয়নের আগে আরেকটি ভালো পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল। সেটাও গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হয়নি। পরামর্শটি ছিল, ডিভিডেন্ড আয়ের ওপর থেকে যে ১০ শতাংশ উেস কর কেটে নেওয়া হয়, সেটাকেই চূড়ান্ত কর হিসেবে ঘোষণা করা। এটা করতে পারলে একটা যুগান্তকারী ফল পাওয়া যেত। অথচ যারা অর্থ পাচার করেছে, তারা ৭ শতাংশ কর দিলেই তাদের টাকা বৈধতা পাবে। এর মধ্য দিয়ে কি পাচারকারী ও পাচারকে উৎসাহিত করা হচ্ছে না? যাঁরা কষ্ট করে সত্ভাবে ব্যবসা করে ২৫ শতাংশ কর দিয়ে দেশের অর্থনীতিকে এগিয়ে নিচ্ছেন, তাঁদের তুলনায় যারা চুরি করে দেশের টাকা নিয়ে গেছে, তাদের ৭ শতাংশ কর দেওয়ার সুবিধা প্রদানের অর্থটা কী?

এই বিষয়টির দুটি খারাপ পরিণতি রয়েছে। একটা হচ্ছে যারা সত্ভাবে কর দেয় তাদের প্রতি অবিচার করা হচ্ছে, আরেকটা হচ্ছে মানি স্মাগলিং বা অর্থপাচারকে একধরনের বৈধতা দেওয়া। এটা হওয়া উচিত নয়। এই সুবিধা দেওয়ার ফলে কিছু লোক এমনটা করতে পারে যে যে অবৈধ অর্থ দেশের বাইরে নিয়ে পরে দেশে এনে বৈধ করে নেবে। এর মধ্য দিয়ে দেশে একদল উঠতি পাচারকারী সৃষ্টি হবে। আমার মনে হয়, এটা পুনর্বিবেচনা করা উচিত।

আমি পুঁজিবাজারের যেসব সুবিধার কথা বলছি, তা কতিপয় ব্যক্তির স্বার্থের জন্য নয় বা হাজার হাজার বিনিয়োগকারীর স্বার্থের জন্যও নয়; দেশের অর্থনীতির স্বার্থের জন্য বলছি। পুঁজিবাজারের বিপরীতে পুঁজির আরেক উৎস ব্যাংকগুলোকে ফতুর করার সুযোগ দেওয়া হচ্ছে কেন? ব্যাংকের এত দুরবস্থা হয়েছে কেন? সরকারকে বলব, আপনারা ব্যাংকগুলোকে স্বল্পমেয়াদি আমানত নিয়ে দীর্ঘমেয়াদীয় অর্থায়ন করতে দিচ্ছেন বলেই তো এমনটা ঘটছে। অথচ পুঁজির জন্য বিকল্প উৎস হতে পারত পুঁজিবাজার বা শেয়ারবাজার। সেই শেয়ারবাজারের ব্যাপারে আমরা নানাভাবে বলেছি যে শেয়ারবাজারকে ভালো করতে হলে ভালো কম্পানি তালিকায় আনতে হবে। আর ভালো কম্পানি আনতে হলে বাজেট সুবিধা দিতে হবে। সেই সুবিধা সরকারের জন্য কোনো ক্ষতির কারণ নয়। এর মধ্য দিয়ে কোনো ধরনের রাজস্ব হারানোর শঙ্কাও নেই। এর পরও মনে হচ্ছে বাজেট প্রণয়নকারীরা যেন অপারগ।

আমার প্রশ্ন হচ্ছে, ব্যাংকগুলোকে ফতুর করে পরে আবার রি-ক্যাপিটাইলাইজ করা হবে করদাতাদের অর্থে। এটা কেন? সরকার কেন ব্যাংকগুলোকে দীর্ঘ মেয়াদে অর্থায়ন করতে দেবে এবং তা-ও ভুলভাবে? পৃথিবীতে ব্যাংক থেকে দীর্ঘ মেয়াদে ঋণ নেওয়া উঠে গেছে অনেক আগেই। বাইরের দেশগুলো শুধু স্বল্পমেয়াদি চলতি মূলধনের অর্থায়ন করে থাকে। আর পুঁজির জন্য পুঁজিবাজারে আসতে হয়। কিন্তু সেদিকে না গিয়ে আমাদের অর্থনীতি শনৈঃ শনৈঃ করে বাড়বে, এটা আশা করা যায় না, উচিতও নয়। এ জন্য আমাদের অর্থনীতিকে নতুনভাবে সাজাতে হবে, ব্যবস্থাপনার ধরন পাল্টাতে হবে।

পুঁজিবাজারটা শুধু ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের ইস্যু নয়। এটা সামগ্রিক অর্থনীতির ইস্যু। উন্নত দেশে দেখা যায়, মোট পরিবারের ৮০ শতাংশেরই পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ আছে। আমাদের এখানে পরিবারগুলোর পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ খুব কম। তার ওপর ধনীদের মধ্যেও মাত্র ৫ শতাংশের বেশি বিনিয়োগ নেই এখানে। এ কারণেই পুিঁজবাজার গুরুত্ব পাচ্ছে না এবং পুঁজির জন্য ব্যাংকনির্ভরতা বাড়ছে। এ কারণেই এখানে ব্যাংকঋণের পাহাড় গড়ে উঠছে, অর্থ পাচার হচ্ছে। এগুলো সবই আন্ত সম্পকির্ত।

আমার আহবান হচ্ছে, শেয়ারবাজার থেকে গত ১৫ বছরে কী কী সুবিধা উঠিয়ে নেওয়া হয়েছে, আর কী কী নতুন দেওয়া হয়েছে তার একটি তালিকা তৈরি করা হোক। এ ছাড়া গত তিন বছরে নতুন করে কী কী সুবিধা দেওয়া হলো এবং আর এর আগে কী কী সুবিধা ছিল, সে সম্পর্কেও একটি পরিষ্কার ধারণা দেওয়া হোক। তাহলে শেয়ারবাজার সম্পর্কে ধারণা অর্জনে সরকার ও স্টেকহোল্ডারদের জন্য সুবিধা হবে।

লেখক : অর্থনীতিবিদ, পুঁজিবাজার বিশেষজ্ঞ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক

নিউজটি শেয়ার করুন..

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো খবর..
© All rights reserved © 2019 bangladeshdailyonline.com
Theme Dwonload From ThemesBazar.Com