সোমবার, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ১১:১৭ পূর্বাহ্ন

আশা রহমত : হতাশা ধ্বংসকর

রিপোর্টারের নাম
  • আপডেট টাইম : মঙ্গলবার, ২৮ জুন, ২০২২
  • ১৩৯ বার

আশা নবীদের বৈশিষ্ট্য, আশা মুমিনদের বৈশিষ্ট্য। আশাবাদী আল্লাহ নির্ভরশীল। আশাবাদী আল্লাহ রাহিম, আল্লাহ রাহমান, আল্লাহ কারিম, আল্লাহ রাউফুম বিল ইবাদ নামগুলোর প্রতি গভীর বিশ্বাস স্থাপন করে বলেই সে আশাবাদী হয়ে ওঠে। এ জন্য আশাবাদীকে আল্লাহ ভালোবাসেন। পক্ষান্তরে হতাশা শয়তানের বৈশিষ্ট্য। ইবলিশ মানে হতাশ। হতাশা ধ্বংসকে ডেকে আনে। আল-কুরআনে যেখানে কাসিরুন শব্দটি এসেছে সেটিই ক্ষতি বা ধ্বংস এর কথা বলা হয়েছে।

আল্লাহ তায়ালা মানুষ সৃষ্টি করলেন। তাদের আকৃতি দান করলেন। এরপর ফেরেশতাদের বললেন, আদমকে সিজদা করো। সবাই সেই নির্দেশ পালন করলেন কিন্তু ইবলিশ সেই নির্দেশ পালন করেনি। সে উত্তর দিলো আমি আদম থেকে শ্রেষ্ঠ, আমাকে আগুন থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে আর আদম মাটির তৈরি। আল্লাহ বললেন, তুমি এখান থেকে বেরিয়ে যাও, এখানে অহঙ্কার করার অধিকার তোমার নেই।

তার যুক্তি আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য হয়নি। প্রকৃতপক্ষে আল্লাহর এই নির্দেশ অমান্য করে শয়তান কয়েকটি ভুল করেছে। এক. আল্লাহ আলিম, তিনি যে-ই সিদ্ধান্তই দেন জেনে বুঝেই দেন, তিনি হাকিম অর্থাৎ তিনি যেই ফায়সালা দেন বিজ্ঞতার সাথেই দেন। আল্লাহ মুতাকাব্বির, অহঙ্কার এককভাবে আল্লাহর জন্য নির্দিষ্ট। কোনো সৃষ্টির অহঙ্কার করার অধিকার নেই। আল্লাহ ছাড়া যদি কেউ অহঙ্কার করে তাহলে সে আল্লাহর সাথে শিরকে লিপ্ত হয়। শয়তান আল্লাহর এ গুণগুলোকে অবমূল্যায়ন করে বর্ণবাদী অহঙ্কারে লিপ্ত হয়। যার কারণে আল্লাহ তাকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করেন। ফলে সে হতাশায় লিপ্ত হয় এবং ধ্বংসশীলদের অন্তর্ভুক্ত হয়। ইবলিশ মানে হতাশ।

আল্লøাহ তায়ালা বলেন, ‘আমি তোমাদের সৃষ্টির সূচনা করলাম তারপর তোমাদের আকৃতি দান করলাম অতঃপর ফেরেশতাদের বললাম, আদমকে সিজদা করো। এ নির্দেশ অনুযায়ী সবাই সিজদা করল। কিন্তু ইবলিশ সিজদাকারীদের অন্তর্ভুক্ত হলো না। আল্লøাহ জিজ্ঞেস করলেন, আমি যখন তোকে হুকুম দিয়েছিলাম তখন সিজদা করতে তোকে বাধা দিয়েছিল কিসে? সে জবাব দিলো- আমি তার চাইতে শ্রেষ্ঠ। আমাকে আগুন থেকে সৃষ্টি করেছ এবং ওকে সৃষ্টি করেছ মাটি থেকে। তিনি বললেন, ঠিক আছে তুই এখান থেকে নিচে নেমে যা। এখানে অহঙ্কার করার অধিকার তোর নেই। বের হয়ে যা। আসলে তুই এমন লোকদের অন্তর্ভুক্ত যারা নিজেরাই নিজেদেরকে লাঞ্ছিত করতে চায়।’ (সূরা আরাফ : ১১-১৩)

পক্ষান্তরে প্রথম মহামানব হজরত আদম আ: আল্লাহর নির্দেশ ধরে রাখতে না পেরে তিনি নিরাশ বা হতাশ হননি। শয়তান তাঁকে লোভ দেখাল তখন তার লোভ দেখানোর মোকাবেলায় তিনি নিজেকে টিকিয়ে রাখতে পারলেন না। তাঁর পা পিছলে গেল এবং তৎক্ষণাৎ তিনি তা বুঝতে পারলেন। তাঁরা বলে উঠল ‘রাব্বানা জালামনা আনফুসিনা ওয়া ইল্লাম তাগফিরলানা ওয়া তারাহামনা লানা কুনা মিনাজ জালিমিন।’ অর্থাৎ- হে আল্লাহ আমরা তো নিজের ওপর জুলুম করে ফেলেছি, তুমি যদি আমাদেরকে মাফ না করো এবং আমাদের করুণা না করো তাহলে তো আমরা নিঃসন্দেহে ধ্বংস হয়ে যাবো।’ (সূরা আরাফ-২৩) তিনি আল্লাহ গাফুর, আল্লাহ রাহিম, আল্লাহ কারিমের প্রতি এতটাই আশাবাদী ছিলেন যে, মহান রব শুধু তাঁকে মাফই করে দেননি বরং তিনি করুণা করে তাঁকে বিশ্ব জাহানের শ্রেষ্ঠ মানবদের অন্তর্ভুক্ত করেছেন। অর্থাৎ তাকে নবী হিসেবে মনোনীত করেন। আল্লাহ বলেন, ‘তারপর তার রব তাকে নির্বাচিত করলেন, তার তাওবা কবুল করলেন এবং তাকে পথনির্দেশনা দান করলেন।’ (সূরা ত্বা-হা-১২২)
হজরত ইউনুস আ: সমুদ্রের অতলান্তে অন্ধকার মাছের পেট থেকে আল্লাহকে ডেকে উঠলেন। আল্লাহ তাঁর ডাকে সাড়া দিলেন এবং মাছের পেট থেকে উদ্ধার করলেন।

হতাশ ও নিরাশ হলে এমন কঠিন পরিস্থিতি থেকে বেঁচে আসা বড়ই অসম্ভব ব্যাপার ছিল। কতটুকু আশাবাদী ছিলেন যে, আমার প্রভু আমাকে রহম করবেন। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আর মাছওয়ালাকেও আমি অনুগ্রহভাজন করেছিলাম। স্মরণ করো যখন সে রাগান্বিত হয়ে চলে গিয়েছিল এবং মনে করেছিল আমি তাকে পাকড়াও করব না। শেষে সে অন্ধকারের মধ্য থেকে ডেকে উঠল ‘তুমি ছাড়া আর কোনো ইলাহ নেই, পবিত্র তোমার সত্তা, অবশ্যই আমি অপরাধ করেছি।’ তখন আমি তার দোয়া কবুল করেছিলাম এবং দুঃখ থেকে তাকে মুক্তি দিয়েছিলাম, আর এভাবেই আমি মুমিনদের উদ্ধার করে থাকি।’ (সূরা আম্বিয়া : ৮৭-৮৮)

হজরত ইয়াকুব আ: প্রাণাধিক পুত্রদ্বয়- ইউসুফ ও বিন ইয়ামিনকে হারিয়ে বলেছিলেন, আমি ‘সবরে জামিল’ ধারণ করলাম। আমার আল্লাহ এদেরকে আমার সাথে মিলিয়ে দেবেন। আল্লাহ তাঁর এই ধৈর্যের ফলে তাঁর দু’সন্তানকে শুধু মিলিয়েই দিলেন না, সাথে সাথে শান-শওকত ও অত্যধিক সম্মানের সাথে তাঁদের ফিরিয়ে দিলেন। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘ঠিক আছে, এ ব্যাপারেও আমি সবর করব এবং ভালো করেই সবর করব। আল্লাহ এদের সবাইকে এনে আমার সাথে মিলিয়ে দেবেন। তিনি সব কিছু জানেন এবং তিনি জ্ঞানের ভিত্তিতে সমস্ত করেন।’ (সূরা ইউসুফ-৮৩)

ইউসুফ আ: মিসরের রাজপ্রসাদের কঠিন ষড়যন্ত্রের কবলে পড়েন। তখন তিনি প্রভুর আশ্রয় প্রার্থনা করেন। আল্লাহ তাঁকে শুধু দোষমুক্তই করেননি বরং তাঁকে মিসরের রাজক্ষমতা প্রদান করে সম্মানিত করেন। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘ইউসুফ বলল, ‘হে আমার রব! এরা আমাকে দিয়ে যে কাজ করাতে চাচ্ছে তার চাইতে কারাগারই আমার কাছে প্রিয়। আর তুমি এদের চক্রান্ত থেকে আমাকে না বাঁচাও তাহলে আমি এদের ফাঁদে আটকে যাব এবং অজ্ঞদের অন্তর্ভুক্ত হবো। তার রব তার দোয়া কবুল করেন এবং তাদের অপকৌশল থেকে তাকে রক্ষা করলেন। অবশ্যিই তিনি সবার কথা শোনেন এবং সব কিছু জানেন।’ (সূরা ইউসুফ : ৩৩-৩৪)

আশার মধ্যেই মানুষ বেঁচে থাকে। আশার কারণে মানুষ কাজ করে, কথা বলে, পথ চলে। আশা মানুষের শারীরিক ও মানসিক শক্তির চাকাকে সচল রাখে। ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক ও পেশাগত জীবনে আশা না থাকলে মানুষ অসামাজিক এক আজব জীবে পরিণত হয়। আশা সফলতার মূল চাবিকাঠি। মনে রাখা প্রয়োজন, আশা ঈমানের সাথেও সংশ্লিষ্ট। তাওয়াক্কুলের প্রবল বিশ্বাস ছাড়া মানুষ আশা করতে পারে না। অর্থাৎ আশা তাওয়াক্কুল থেকে আর তাওয়াক্কুল মজবুত ঈমান থেকে জাগে।
হতাশা বা নিরাশা এমন এক ক্ষতিকর বদগুণ যা মানুষের সব প্রকার যোগ্যতাকে সমূলে বিনষ্ট করে দেয়। মানুষের শারীরিক, মানসিক ও নৈতিক শক্তিকে এমনভাবে দূর্বল করে দেয় যে, এই সব ক্ষেত্রে সে একজন অযোগ্য ও অকর্মণ্য ব্যক্তিতে পরিণত হয়। হতাশাগ্রস্ত এই ব্যক্তিটি পরিবারের শান্তিপূর্ণ পরিবেশকে যেমনভাবে বিনষ্ট করে, তেমনি সমাজ ও পেশাগত জীবনে একজন অযোগ্য, অকর্মণ্য দায় হিসেবে চিহ্নিত হয়। হতাশা এমনভাবে ঘিরে ধরে যে ঢিলেমি তাকে সামনে চলার সব পথকে রুদ্ধ করে দেয়। হতাশার আরেকটি বড় প্রভাব হলো, হতাশাগ্রস্ত ব্যক্তি সব কাজে নেতিবাচক মনোভাব প্রকাশ করে। নেতিবাচক অভিব্যক্তি তার অভ্যাসে পরিণত হয়। ইতিবাচকতা তার আজন্মের শুত্রুতে পরিণত হয়।

এ ধরনের ব্যক্তি নেতিবাচক মনোভাব প্রচ্ছন্ন ও অপ্রচ্ছন্ন দুভাবে প্রকাশ করে। একটি ভালো কাজের প্রতি সবাই ইতিবাচক সাড়া দিয়েছে, কিন্তু ওই ব্যক্তি যে হতাশা রোগে আক্রান্ত, সে তার মনোভাব এমনভাবে প্রকাশ করবে, প্রাথমিকভাবে বোঝা যাবে না সে নেতিবাচক নাকি ইতিবাচক। কিন্তু একটু ভালোভাবে লক্ষ করলে দেখা যাবে, প্রচ্ছন্নভাবে সে নেতিবাচক মনোভাবই প্রকাশ করেছে। এ ধরনের ব্যক্তিরা নিজেরা তো সফলতার মুখ দেখতে পায়-ই না, অধিকন্তু তারা অন্যের সফলতাকে সহ্য করতে পারে না। সুতরাং কোনো মুমিন কখনো হতাশ হতে পারবে না। হতাশ হওয়ার সাথে সাথে তিনি ইবলিশ হিসেবে চিহ্নিত হবেন এবং খুব দ্রুত তাকে তাওবা করে আল্লাহর রহমতের ছায়াতলে শামিল হতে হবে। পূর্ণ আশা নিয়ে আল্লাহর রাহিম, আল্লাহ রাহমান, আল্লাহ গাফুর, আল্লাহ রাউফুম বিল ইবাদ, আল্লাহ কারিম, আল্লাহ আফুয়ুসহ তাঁর দয়া ও করুণায় পরিপূর্ণ তাঁর গুণাবলির সীমায় প্রবেশ করতে হবে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘(হে নবী!) বলে দাও, হে আমার বান্দারা যারা নিজের আত্মার ওপর জুলুম করেছ আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না। নিশ্চিতভাবেই আল্লাহ সমস্ত গোনাহ মাফ করে দেন। তিনি ক্ষমাশীল ও দয়ালু।’ (সূরা জুমার-৫৩) আশা নবী, রাসূল ও আল্লাহর নিয়ামতপ্রাপ্তদের গুণ আর নিরাশা বা হতাশা, ক্ষতিগ্রস্ত ও ধ্বংসশীলদের বৈশিষ্ট্য।

লেখক : শিক্ষাবিদ ও কলামিস্ট

নিউজটি শেয়ার করুন..

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো খবর..
© All rights reserved © 2019 bangladeshdailyonline.com
Theme Dwonload From ThemesBazar.Com