কাবাঘর নির্মাণের সূচনা থেকে চলছে নিয়মিত তাওয়াফ। প্রতি বছর বিশ্বের নানা প্রান্তের মুসলমানগণ হজ ও ওমরাহ উপলক্ষে এসে কাবা শরিফ তাওয়াফ করেন। আমরা সবাই জানি, তাওয়াফ করতে সাতবার ডান থেকে বামে অর্থাৎ ঘড়ির কাঁটার বিপরীতে কাবা ঘরের চার দিকে প্রদক্ষিণ করতে হয়। এখন প্রশ্ন হলো, তাওয়াফ কেন কাবা ঘরকে ঘিরে? এর দু’টো প্রধান কারণ। একটি হলো আল্লাহর বিধানের ঐতিহ্য এবং নির্দেশগত কারণ। অন্যটি প্রাকৃতিক কারণ।
ঐতিহ্য ও নির্দেশগত কারণ
প্রথমত. কাবার নিচের মাটিই পৃথিবীর স্থলভাগের প্রথম মাটি। একটা সময় ‘আল্লাহর আরশ ছিল পানির ওপর’ (সুরা হুদ-৭)।
মাটিতে রূপান্তর হওয়ার আগে কাবা সাদা ফেনা আকারে ছিল। হাদিসের ভাষ্য মতে, কাবার নিচের অংশটুকু পৃথিবীর প্রথম জমিন। বিশাল সাগরের মাঝে এর সৃষ্টি। ধীরে ধীরে এর চার পাশ ভরাট হতে থাকে।
উম্মুল কুরা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণাকেন্দ্রের পরিচালক ড. খালিদ বাবতিনের গবেষণায় দেখা গেছে, সৌদি আরবে অবস্থিত পবিত্র কাবাই পৃথিবীর কেন্দ্রবিন্দু। (আল আরাবিয়া : ২৩ জুলাই, ২০১২)
দ্বিতীয়ত. কাবাকে ঘিরে বিশ্ব কেন্দ্র ও হজের ঘোষণা প্রথম মানুষ হজরত আদম আ: থেকেই : হজরত আদম আ: ও হজরত হাওয়া আ: পৃথিবীতে আগমনের পর আল্লাহ তায়ালা হজরত জিবরাঈল আ:-এর মাধ্যমে তাদের পবিত্র কাবাঘর নির্মাণের আদেশ দেন। এই ঘর নির্মাণ হয়ে গেলে তাদের তা তাওয়াফ করার আদেশ দেয়া হয় এবং বলা হয়, আপনি সর্বপ্রথম মানব এবং এই গৃহ সর্বপ্রথম গৃহ, যা মানবমণ্ডলীর জন্য নির্দিষ্ট করা হয়েছে’- (ইবনে কাসির, বায়হাকি)।
ইমাম বাগাবি বলেন, কাবাঘর নির্মাণ করার পর আল্লাহ তায়ালা হজরত আদম আ:কে নির্দেশ দেন, মানুষের মধ্যে ঘোষণা করে দাও যে, বায়তুল্লাহর হজ তোমাদের ওপর ফরজ করা হয়েছে। হজরত ইবনে আবি হাতেম ও হজরত ইবনে আব্বাস রা: থেকে বর্ণনা করেন, যখন হজরত ইব্রাহিম আ:-কে হজ ফরজ হওয়ার কথা ঘোষণা করার নির্দেশ দেয়া হয়, তখন তিনি আল্লাহর কাছে আরজ করলেন, এখানে তো জনমানবশূন্য মরু প্রান্তর। ঘোষণা শোনার মতো কেউ নেই; যেখানে জনবসতি আছে সেখানে আমার আওয়াজ কিভাবে পৌঁছবে? আল্লাহ তায়ালা বলেন, তোমার দায়িত্ব শুধু ঘোষণা করা। মানুষের কানে পৌঁছানোর দায়িত্ব আমার।’ অতঃপর হজরত ইব্রাহিম আ: আবু কুবায়স পাহাড়ে আরোহণ করে দুই কানে অঙ্গুলি রেখে ডানে-বাঁয়ে এবং পূর্ব-পশ্চিমে মুখ করে চিৎকার করে ঘোষণা করেন, ‘হে মানুষেরা! আল্লাহ তোমাদের এই ঘরে হজ করার নির্দেশ করেছেন, যাতে তোমাদেরকে জান্নাত দিতে পারেন এবং জাহান্নাম থেকে মুক্তি দিতে পারেন। সুতরাং তোমরা হজ করো।’
হজরত ইব্রাহিম আ:-এর এই আওয়াজ আল্লাহ তায়ালা সব মানুষের কানে পৌঁছে দেন। এমনকি যারা ভবিষ্যতে কিয়ামত পর্যন্ত পৃথিবীতে আসবে, তাদের কান পর্যন্ত এই আওয়াজ পৌঁছে দেয়া হয়। যাদের ভাগ্যে আল্লাহ তায়ালা হজ লিখে দিয়েছেন, তাদের প্রত্যেকেই এই আওয়াজের জবাবে ‘আমি হাজির আমি হাজির’ বলে হাজির হওয়ার স্বীকৃতি প্রদান করেছে। হজরত ইবনে আব্বাস রা: বলেন, হজরত ইব্রাহিম আ: এর ঘোষণার উত্তরই হচ্ছে হজে ‘লাব্বাইক’ বলার আসল ভিত্তি। (কুরতবি : ১২তম খণ্ড, ২৮ পৃষ্ঠা, মাজহারি)। হজরত ইব্রাহিম আ: এর ঘোষণাকে এই মানবমণ্ডলী পর্যন্ত পৌঁছানোর কারণে কিয়ামত পর্যন্ত হজের ধারা কায়েম থাকবে।
তৃতীয়ত. কাবা হলো বায়তুল মামুরের আদলে পৃথিবীতে নির্মিত পবিত্র ইবাদত ঘর। সপ্ত আসমানের ওপরে বায়তুল মামুর নামক একটা মসজিদ আছে যেখানে ফেরেশতারা নিয়মিত তাওয়াফ করে থাকে। হজরত আদম আ: তাঁর জান্নাতে থাকাকালীন ফেরেশতাদের তাওয়াফ করার স্থান বায়তুল মামুরকে লক্ষ করেছিলেন। দুনিয়াতে আসার পর হজরত আদমের ইচ্ছা হয় এই পৃথিবীর মাটিতেও এরকম একটা বায়তুল মামুর থাকবে যেখানে উনার সন্তানরা নিয়মিত তাওয়াফ করবে। মেরাজের রাতে রাসূল সা: বায়তুল মামুরকে দেখেছিলেন। -“এরপর আমাকে বায়তুল মামুরে উঠানো হলো। বললাম, হে জিবরাঈল! এ কী? তিনি বললেন, এ হচ্ছে ‘বায়তুল মামুর’। প্রত্যহ এতে সত্তর হাজার ফেরেশতা তাওয়াফের জন্য প্রবেশ করে। তারা একবার তাওয়াফ সেরে বের হলে কখনো আর ফের তাওয়াফের সুযোগ হয় না তাদের।” (সহিহ মুসলিম, হাদিস নম্বর : ৩১৩)।
আর কাবাঘর হলো, বায়তুল মামুরের ঠিক সোজাসুজি নিচে। কিন্তু দুনিয়ার জীবনে যেহেতু আমরা আল্লাহর আরশকে সামনে পাবো না ও আল্লাহর আরশের সামনে সিজদা দিতে পারব না তাই আমরা মুসলমানরা এই কাবাঘরের চার পাশে একসাথে তাওয়াফ করি। কারণ, কাবাঘর হচ্ছে দুনিয়ায় বায়তুল মামুরের প্রতিনিধি। ফেরেশতাদের মূল ইবাদতের ক্ষেত্র যেমন বায়তুল মামুর ঠিক তেমনি আমাদের জন্য কাবাঘর। ফেরেশতারা যেমন আল্লাহর আরশ ও বায়তুল মামুরকে কেন্দ্র করে তাওয়াফ করে ঠিক তেমনি আমরাও কাবাঘরকে কেন্দ্র করে তাওয়াফ করি। কাবাঘর হচ্ছে দুনিয়াতে আল্লাহর আরশের প্রতিনিধিত্বকারী ঘর। আল্লাহর আরশকে কেন্দ্র করে যেমন এই মহাবিশ্বের সব গ্রহ নক্ষত্র ঘুরছে, ঠিক তেমনি আমরা মুসলমানরা এক সাথে এই কাবাঘরের চার পাশে ঘুরি।
চতুর্থত. উম্মতে মুহাম্মদির জন্য আল্লাহ চান বিশ্ব মুসলিমের জন্য একটি কেন্দ্রীয় নিরাপদ ইবাদত স্থান ও শান্তিময় মিলনকেন্দ্র হোক যেখানে বিশ্ব মুসলিমগণ তাদের পূর্বপুরুষগণের ঐতিহ্য ধরে রাখতে নিয়মিত একত্র হবেন।
আল্লাহ বলেন, আর স্মরণ করো তখনকার কথা যখন আমি এই গৃহকে (কা’বা) লোকদের জন্য কেন্দ্র ও নিরাপত্তাস্থল গণ্য করেছিলাম এবং ইবরাহিম যেখানে ইবাদত করার জন্য দাঁড়ায় সে স্থানটিকে স্থায়ীভাবে নামাজের স্থানে পরিণত করার হুকুম দিয়েছিলাম। আর ইবরাহিম ও ইসমাঈলকে তাকিদ করে বলেছিলাম, আমার এই গৃহকে তাওয়াফকারী, ইতিকাফকারী ও রুকু’-সিজদাকারীদের জন্য পাক-পবিত্র রাখো (সুরা বাকারাহ-১২৫)
আল্লাহ কাবাঘরকে মুসলিমের জন্য বিশ্ব কেন্দ্রীয় মিলনকেন্দ্র, নিরাপদ, পবিত্র এবং সর্বক্ষণ ইবাদতের স্থান হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। ইহুদি, খ্রিষ্টান এবং মুশরিকদের বাদ দিয়ে ইব্রাহিম আ: এর পরবর্তী প্রকৃত মুসলিম অনুসারীদের ওপর বিশ্ব নেতৃত্বের দায়িত্ব হস্তান্তর করেছেন। মুসলমানদের এই কেন্দ্রীয় পবিত্র মিলনমেলাকে বাস্তবে রূপদানে সক্ষম মুসলমানদের জন্য আল্লাহ হজকে ফরজ করেছেন; ওমরাহ্, জিয়ারত, তাওয়াফ ও নামাজ পড়াকে করেছেন অত্যন্ত বরকতময়।
হজের যে সমস্ত আনুষ্ঠানিকতা পালন করা হয় তার মাধ্যমে আল্লাহ মানবজাতির আদি পিতা হজরত আদম আ: এবং বর্তমান মুসলিম জাতির পিতা হজরত ইব্রাহিম আ: এর স্মৃতিবিজড়িত স্থানগুলোর ঐতিহ্যের সাথে আমাদের পরিচয় করিয়ে দিতে চান। এর মাধ্যমে আল্লাহ বিশ্ব মুসলিমকে এক কেন্দ্রমুখী করে ঐক্যবদ্ধ ও ভ্রাতৃত্ব-ভালোবাসায় আবদ্ধ রাখতে চান।
এখানে ‘পবিত্র ও নিরাপদ’ বলতে শুধু ময়লা-আবর্জনা মুক্ত রাখা নয়; বরং পুরোপুরি নিরাপত্তা বিধান করে শিরক ও ভেজালমুক্ত রাখা বুঝায়।
হজ ও ওমরাহে তাওয়াফ করাকে বাধ্যতামূলক করা হয়েছে এবং অন্যান্য সময়ে তাওয়াফকে করেছেন অফুরন্ত বরকতময়।
পঞ্চমত. আল্লাহ জানিয়ে দিয়েছেন, সমগ্র বিশ্ব মানবতার জন্য প্রথম ইবাদতগৃহ কাবাঘর। এই পবিত্র ঘরকেন্দ্রিক জীবন ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমেই মানুষ প্রকৃত হেদায়াত পেতে পারে।
আল্লাহ বলেন, নিঃসন্দেহে মানুষের জন্য সর্বপ্রথম যে ইবাদত গৃহটি নির্মিত হয় সেটি মক্কায় অবস্থিত। তাকে কল্যাণ ও বরকত দান করা হয়েছিল এবং সমগ্র বিশ্ববাসীর জন্য হেদায়াতের কেন্দ্রে পরিণত করা হয়েছিল (সূরা আলে- ইমরান-৯৬)
উপরি-উক্ত আয়াত থেকে পরিষ্কার যে, কাবাঘর মুসলিম জাতির প্রথম ইবাদতগৃহ। তারপর আল্লাহ এটিকে বরকতময় এবং হেদায়াতের কেন্দ্রস্থল বানিয়েছেন।
আল্লাহ আরো বলেন, ‘তার মধ্যে রয়েছে সুস্পষ্ট নিদর্শনগুলো এবং ইব্রাহিমের ইবাদতের স্থান। আর তার অবস্থা হচ্ছে এই যে, যে তার মধ্যে প্রবেশ করেছে, সে নিরাপত্তা লাভ করেছে। মানুষের মধ্য থেকে যারা সেখানে পৌঁছার সামর্থ্য রাখে, তারা যেন এই গৃহের হজ সম্পন্ন করে, এটি তাদের ওপর আল্লাহর অধিকার। আর যে ব্যক্তি এ নির্দেশ মেনে চলতে অস্বীকার করে তার জেনে রাখা উচিত, আল্লাহ বিশ্ববাসীর মুখাপেক্ষী নন’ (সূরা আলে-ইমরান-৯৭)।
এখানে আল্লাহ তার স্বীকৃত প্রথম ইবাদত স্থানেই একত্র হওয়ার জন্যই সামর্থ্যবান মুসলমানদের জন্য হজ ফরজ করেছেন।
ষষ্ঠত. হজে তাওয়াফ তিনটি ফরজের একটি। এই ফরজ হওয়ার প্রাকৃতিক কারণ যেমন আছে তেমনি আছে অন্তর্নিহিত তাৎপর্যও।
আর স্মরণ করো, যখন আমি ইবরাহিমকে সে ঘরের (বায়তুল্লাহ) স্থান নির্ধারণ করে দিয়েছিলাম এবং বলেছিলাম, ‘আমার সাথে কাউকে শরিক করবে না এবং আমার ঘরকে পাক সাফ রাখবে তাওয়াফকারী, রুকু-সিজদা ও দাঁড়িয়ে সালাত আদায়কারীর জন্য’ (সূরা আল হজ-২৬)
‘আর মানুষের নিকট হজের ঘোষণা দাও; তারা তোমার কাছে আসবে পায়ে হেঁটে এবং কৃষ্ণকায় উটে চড়ে দূর পথ পাড়ি দিয়ে-(সূরা আল হাজ-২৭)
সপ্তমত. কাবায় হজ এবং তাওয়াফের ঘোষণা মানবসৃষ্টির সূচনা থেকে। আবার নির্দিষ্ট অক্ষের চার দিকে মহাবিশ্বের প্রতিটি বস্তুর ভেতরে-বাইরে ঘূর্ণনও সৃষ্টির সূচনা থেকে। এর মাধ্যমে আল্লাহ যেমন সৃষ্টির সূচনালগ্নের অবস্থার কথা স্মরণ করিয়ে দিতে চান; পাশাপাশি প্রতীকী তাওয়াফের মাধ্যমে জানিয়ে দিতে চান, মুসলমানেরা যেন সব সময় এই কাবাঘরের প্রভুকে কেন্দ্র করেই তাদের সমস্ত কর্মকাণ্ড পরিচালনা করেন।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান,
ডিপার্টমেন্ট অব হিস্টোপ্যাথলজি,
ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব কিডনি ডিজিজেস্ অ্যান্ড ইউরোলজি, শেরেবাংলা নগর, ঢাকা