রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ১১:২৯ পূর্বাহ্ন

ইতিহাসবিদ আবদুল করিম ও বায়তুশ শরফ

ড. মোহাম্মদ মুহিবউল্যা ছিদ্দিকী
  • আপডেট টাইম : রবিবার, ২৪ জুলাই, ২০২২
  • ১২৯ বার

আজ ২৪ জুলাই ২০২২ সাল। ২০০৭ সালের এই দিনে ইতিহাসবিদ আবদুল করিম পরকালীন জগতে চলে যান। দীর্ঘ ১৫ বছর ধরে তার অসংখ্য ছাত্র ও গুণগ্রাহী তাকে বিভিন্ন আঙ্গিকে স্মরণ করে আসছেন। এ মহান ইতিহাসবিদ বায়তুশ শরফ ইসলামী গবেষণা প্রতিষ্ঠানের প্রথম মহাপরিচালক হিসেবে প্রায় সাড়ে তিন বছর দায়িত্ব পালন করেন। আজ সে স্মৃতিচারণে আমার এ সামান্য প্রয়াস।

এরশাদের সামরিক শাসনামলে অমানবিক আচরণের পরে তিনি কিছুটা হতাশ হয়ে পড়েছিলেন। এতে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে সামান্য কিছু দিনের জন্য হলেও সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যায়। এ সুযোগ কাজে লাগানোর জন্য যিনি এগিয়ে আসেন তিনি হলেন বায়তুশ শরফের মরহুম পীর সাহেব হজরত আবদুল জাব্বার শাহ সাহেব রহ.। তিনি আমার মরহুম চাচাজান মাওলানা শিহাবউদ্দিন আহমদ ছিদ্দিকি রহ.-এর সহপাঠী ছিলেন। উভয়ে গারাংগিয়া মাদরাসার ফারেগ। চাচাজান গারাংগিয়ার বড় হুজুর হজরত আবদুল মজিদ রহ. শাহের খলিফা এবং মরহুম আবদুল জাব্বার সাহেব হজরত মীর আখতার সাহেব হুজুরের খলিফা।

মরহুম আবদুল জাব্বার শাহ সাহেব সম্পর্কে এ সংক্ষিপ্ত পরিসরে লেখা সম্ভব নয়। তার জীবনী প্রকাশিত হয়েছে। সারা দেশে বায়তুশ শরফ মসজিদ, মাদরাসা, এতিমখানা, হাফেজখানাসহ অসংখ্য প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠিত করে তিনি জাতিকে একধাপ এগিয়ে নিয়ে গেছেন। ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেডের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক ও আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় চট্টগ্রামের একজন প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ছিলেন তিনি। এ দেশে ইসলামী শিক্ষা, ইসলামী সমাজ ও ইসলামী অর্থনীতি প্রতিষ্ঠায় মরহুম আবদুল জাব্বার শাহ সাহেবের অবদান চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে; এটা আমার বিশ্বাস।

ড. আবদুল করিম বাংলার মুসলমানদের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাস গবেষণা করতে গিয়ে গভীরভাবে উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়েছেন যে, বাংলাদেশে ইসলাম প্রচারে পীর-দরবেশ, সুফি-সাধক, আলেম-ওলামা ও মাশায়েখদের ভূমিকা চির উজ্জ্বল। তিনি সবসময় এ শ্রেণীর লোকদের গভীরভাবে শ্রদ্ধা করতেন। তাদের সঙ্গ এবং সাহচর্য কামনা করতেন, তাদের উচ্চকিত প্রশংসা করতেন।

পরলোকগত সুফি-সাধকদের মাজার জিয়ারত করতেন। ড. আবদুল করিম যখন সামরিক আইনের নির্যাতনের শিকার হয়ে কিছুটা হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়লেন তখন তার কাছে যিনি রহমতের হাত সম্প্রসারিত করে দিলেন তিনি হলেন বায়তুশ শরফের মরহুম পীর সাহেব হজরত আবদুল জাব্বার শাহ রহ.। তিনি তার গভীর অনুভ‚তি দিয়ে হৃদয়ঙ্গম করতে সক্ষম হয়েছিলেন যে, ইতিহাসবিদ আবদুল করিমকে দিয়ে তিনি বায়তুশ শরফ ইসলামী গবেষণা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হবেন। ড. আবদুল করিমের কাছে এ প্রস্তাব দেয়া হলে প্রথমে তিনি ইতস্তত করেন।

কারণ ইতঃপূর্বে দীর্ঘ ৩৫ বছর ধরে তিনি কেবল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতা, গবেষণা ও প্রশাসনের সাথে জড়িত ছিলেন। এর বাইরে তিনি বুদ্ধিবৃত্তিক প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ইতিহাস সমিতি ও এশিয়াটিক সোসাইটি অব বাংলাদেশের সাথে যুক্ত হয়ে গবেষণাকাজ পরিচালনা করেছেন। প্রস্তাবিত মসজিদ- মাদরাসাভিত্তিক পীর-মাশায়েখের পৃষ্ঠপোষকতায় কোনো কাজ কোনোদিন করেননি। তাই শত ইতস্ততার মাঝেও কঠিন বাস্তবতার মাঝে শায়েখের অনুরোধে তিনি বায়তুশ শরফ ইসলামী গবেষণা কেন্দ্রের মহাপরিচালকের দায়িত্বভার গ্রহণ করেছিলেন। মরহুম শায়েখ আবদুল জাব্বার সাহেব ড. আবদুল করিমকে যথাযথ সম্মান ও সম্মানী দিতে কুণ্ঠিত হননি।

বায়তুশ শরফ ইসলামী গবেষণা কেন্দ্রের মহাপরিচালকের দায়িত্ব গ্রহণ করে তিনি কিছুটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছিলেন। সেখানে জামাতের সাথে সালাত আদায়, তাসবিহ-তাহলিল পাঠ তাকে শান্তিময় জীবনের সন্ধান দেয়। মরহুম শায়েখ আবদুল জাব্বার সাহেব থেকে তিনি বহু শিক্ষা গ্রহণ করেছেন। কিন্তু তিনি তার হাতে বায়াত হয়েছেন; এমন কথা কখনো আমাকে বলেননি। একদিন তিনি আমাকে মরহুম শায়খের শিক্ষা সম্পর্কিত একটি ঘটনা বলেছিলেন।

ঘটনাটা হলো, তিনি শায়েখকে বললেন, ‘হুজুর’ আমি বহু লোকের উপকার করেছি। যাদের উপকার করেছি তারা সবাই আমার কোনো না কোনো অপকার করেছে। যাদের বেশি উপকার করেছি তারা বেশি অপকার করেছেন। তাই সিদ্ধান্ত নিয়েছি ভবিষ্যৎ জীবনে আর মানুষের উপকার করব না। যাতে করে মানুষের অপকারের শিকার হতে না হয়। আপনি কী বলেন? শায়েখ তখন অত্যন্ত স্বাভাবিকভাবে সহজ সরল কণ্ঠে পবিত্র কুরআনের একটি আয়াত তিলাওয়াত করলেন, আয়াতটি হলো, ‘হাল যাযাউল এহসান ইন্নাল এহসান’ (সূরা আর রাহমানের আয়াত) অর্থাৎ, যদি কেউ মানুষের কল্যাণ করে তার বদলা হিসেবে সে কল্যাণ লাভ করবে। ড. আবদুল করিম আরবি-ফার্সি ভালো জানতেন। ফলে শায়েখের তিলাওয়াতকৃত আয়াতের মর্মার্থ বুঝতে তিনি খুবই সক্ষম ছিলেন। তখন সাথে সাথে তিনি তার পূর্ববর্তী সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করেন এবং অবশিষ্ট জীবন মানুষের কল্যাণে ব্যয় করার প্রত্যয় গ্রহণ করেন।

ড. আবুদল করিম ১৯৮৫-৮৯ পর্যন্ত চট্টগ্রামে বায়তুশ শরফ ইসলামী গবেষণা প্রতিষ্ঠানের মহাপরিচালক ছিলেন। ইতোমধ্যে সেখান থেকে তার সম্পাদনায় ‘ইসলামী ঐতিহ্য’ শিরোনামে একটি গবেষণা পত্রিকা প্রকাশিত হয়, যার গবেষণার মান আন্তর্জাতিক স্বীকৃত মানের। এ প্রতিষ্ঠান থেকে তার বিখ্যাত প্রথম পিএইচডি থিসিস Social History of the Muslims in Bengal ( Down to AD . 1538 ) Second Revised Edition ১৯৮৫ সালে প্রকাশিত হয়। তা ছাড়া বায়তুশ শরফ ইসলামী গবেষণা প্রতিষ্ঠান থেকে ১৯৮৭ সালে মোল্লা মিসকিন শাহ ও মক্কা শরিফে বাঙালি মাদরাসা নামে দুটো গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। সর্বোপরি ইসলামী সমাজ, ইসলাম ও সুফিবাদ, মোল্লা মিসকিন শাহ, মহানবী সা:-এর যুদ্ধনীতি, চট্টগ্রামের শাহী জামে মসজিদ, রাসূলুল্লাহর সমাজ সংস্কার, বাংলার জনজীবনে সুফিদের প্রভাব, হজরত সালমান ফারসির ইসলাম গ্রহণ, নিরক্ষরতা রাসূলুল্লাহ সা:-এর একটি শ্রেষ্ঠ মোজেজা, বাংলাদেশে মাদরাসা শিক্ষার গোড়ার কথা প্রভৃতি প্রবন্ধ ড. আবদুল করিম প্রণয়ন করেন এবং যা বায়তুশ শরফের মুখপাত্র মাসিক দ্বীন দুনিয়ায় প্রকাশিত হয়েছে।

মাত্র সাড়ে তিন বছর ড. আবদুল করিম বায়তুশ শরফ ইসলামী গবেষণা প্রতিষ্ঠানের মহাপরিচালক ছিলেন। এ অল্প সময়ে তিনি তিনটি বই, ৮-১০টি প্রবন্ধ প্রণয়ন ও প্রকাশ করেছেন এবং একটি গবেষণা পত্রিকা সম্পাদনা করতে সক্ষম হয়েছেন। তা ছাড়া তখন সেখানে তিনি সম্ভবত দু’টি আন্তর্জাতিক সেমিনার করেছিলেন যেখানে দেশ-বিদেশের বহু বরণ্য ইসলামী চিন্তাবিদ অংশগ্রহণ করেছিলেন। বুদ্ধিবৃত্তিক কর্মে ড. আবদুল করিমের যোগ্যতা সর্বত্রই উজ্জ্বল; এটিই তার প্রমাণ। তারই পৃষ্ঠপোষক ছিলেন বায়তুশ শরফের মহান ওলি মরহুম আবদুল জাব্বার সাহেব রহ.।

লেখক : প্রফেসর, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি
বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

নিউজটি শেয়ার করুন..

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো খবর..
© All rights reserved © 2019 bangladeshdailyonline.com
Theme Dwonload From ThemesBazar.Com