বৃহস্পতিবার, ২৮ নভেম্বর ২০২৪, ০২:৪২ অপরাহ্ন

হিসাব মিলছে না ব্যবসায়ীদের

বাংলাদেশ ডেস্ক :
  • আপডেট টাইম : বুধবার, ২৭ জুলাই, ২০২২
  • ১০৩ বার

রফতানিমুখী পণ্যের কাঁচামাল আমদানির জন্য এলসি খুলছেন। এলসি খোলার সময় ব্যাংকে ডলারের দর যা ছিল, পণ্য দেশে আসার পর আমদানি ব্যয় মেটাতে ডলারের দাম বেড়ে যাচ্ছে। এক সপ্তাহ আগেও যেখানে প্রতি ডলার পেতে ৯৬ টাকা থেকে ৯৭ টাকা ছিল, গতকাল তা ১০৩ টাকা থেকে ১০৪ টাকা ব্যয় করতে হচ্ছে। এভাবে ডলারের বিনিময় হার বেড়ে যাওয়ায় পণ্যের উৎপাদন খরচ বেড়ে যাচ্ছে। এর সাথে যুক্ত হয়েছে বিদ্যুতের লোডশেডিং। আগে লোডশেডিং ছিল না বললেই চলে। কিন্তু এখন শিল্পকারখানায় গড়ে তিন থেকে চার ঘণ্টা লোডশেডিং হচ্ছে। বিদেশী ক্রেতাদের চুক্তি অনুযায়ী পণ্য সরবরাহ করতে ডিজেলচালিত জেনারেটরের মাধ্যমে বিদ্যুৎ উৎপাদন করে পণ্য উৎপাদন ঠিক রাখতে হচ্ছে। এতে গড়ে এক লাখ টাকা থেকে সোয়া লাখ টাকার ডিজেল পোড়াতে হচ্ছে। সামগ্রিকভাবেই লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে পণ্যের উৎপাদন ব্যয় বিক্রয় মূল্যের চেয়েও বেড়ে যাচ্ছে। এভাবে পণ্যের উৎপাদন ব্যয় ও বিক্রয়মূল্যের মধ্যে হিসাব মেলানো যাচ্ছে না। শুধু বিদেশী ক্রেতাদের ধরে রাখতে ও বাজার ঠিক রাখতে তাদেরকে লোকসান গুনতে হচ্ছে। সহসাই পরিস্থিতি উন্নতি না হলে সামনে লোকসানের ধকল কাটানো কোনোভাবেই সম্ভব হবে না।

গতকাল কথাগুলো বলেছিলেন দেশের প্রতিষ্ঠিত একজন শিল্পোদ্যোক্তা ফজলে শামিম এহসান। তিনি গতকাল নয়া দিগন্তকে আরো বলেন, নারায়ণগঞ্জে ফতুল্লায় তার তিনটি কারখানা আছে। এর দু’টিতে ২ মেগাওয়াট ও ১ মেগাওয়াট ক্ষমতার শিল্পে উৎপাদিত নিজস্ব বিদ্যুৎ (ক্যাপটিভ) থাকলেও একটিতে নেই। দিনে গ্যাসের সরবরাহ কম। আড়াই থেকে তিন ঘণ্টা লোডশেডিং হচ্ছে গড়ে। গতকালও তিন ঘণ্টা হয়েছে। তিনটি কারখানা মিলে দেড় হাজার লিটারের বেশি ডিজেল লাগছে দিনে। এতে তার দিনে ব্যয় হচ্ছে এক লাখ টাকা থেকে সোয়া লাখ টাকা। শুধু তা-ই নয়, প্রায় প্রতিদিনই ডলারের দাম বেড়ে যাচ্ছে। ব্যাক টু ব্যাক এলসির ক্ষেত্রে কোনো সমস্যা হচ্ছে না। কিন্তু অন্য এলসির ক্ষেত্রে ডলারের যে মূল্য নির্ধারণ করে এলসি খোলা হচ্ছে, এলসি নিষ্পত্তির সময় দেখা যাচ্ছে ডলারের মূল্য আরো বেড়ে গেছে। এতে ডলার বাড়তি মূল্যে কিনেই এলসি নিষ্পত্তি করতে গিয়ে আমদানি ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে। এতেও লোকসান গুনতে হচ্ছে তাদের। কিন্তু ক্রেতারা পণ্যের দাম বাড়াচ্ছে না। আর এসব করা হচ্ছে বিদেশী ক্রেতাদের ঠিক রাখতে ও বাজার ধরে রাখতে। তিনি আশা করেন পরিস্থিতি শিগগিরই ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু সহনীয় ক্ষমতার বাইরে চলে গেলে তারা বেকায়দায় পড়ে যাবেন। তিনি বলেন, ইউরোপ, আমেরিকায় ব্যবসায় মন্দার কারণে ইতোমধ্যে তৈরী পোশাকের অর্ডার কমে গেছে। শুধু গত মাসের চেয়ে তার ক্রয়াদেশ ২০ শতাংশ কমে গেছে। আগামী মাসে কিছু অর্ডার রয়েছে। সেপ্টেম্বরে কাজ করার মতো অর্ডার এখনো পাননি।

ফজলে শামিম এহসানের মতো বেশির ভাগ ব্যবসায়ীই পণ্য উৎপাদন ব্যয় ও বিক্রয় মূল্য সমন্বয় করতে পারছেন না। ডলারের মূল্য বেড়ে যাওয়ায় ও লোডশেডিংয়ের কারণে পণ্যের উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে। সরকার ইতোমধ্যে ডিজেলচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর উৎপাদন বন্ধ করে দিয়েছে। ডলারের সঙ্কট ও আন্তর্জাতিকবাজারে জ্বালানি তেলের মূল্য বেড়ে যাওয়ায় এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এতে চাহিদার চেয়ে দুই হাজার মেগাওয়াট কম বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হচ্ছে। এতেই সারা দেশে বেড়ে গেছে লোডশেডিং। বলা হয়েছিল শিল্পকারখানায় নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হবে। কিন্তু কী বাসাবাড়ি আর কী শিল্পকারখানা কোনো কিছুই লোডশেডিং থেকে রেহাই মিলছে না। শিল্পকারখানায় বিকল্প বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য ক্যাপটিভ পাওয়ার স্টেশন রয়েছে। কিন্তু বেশির ভাগ ক্যাপটিভ পাওয়ার গ্যাসনির্ভর। কিন্তু এলএনজি আমদানি বিশেষ করে স্পট মার্কেট থেকে আমদানি বন্ধ করে দেয়ায় গ্যাস সঙ্কট দেখা দিয়েছে। এতে গ্যাসনির্ভর বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর চাহিদা অনুযায়ী গ্যাস সরবরাহ করা যাচ্ছে না।

এতে কমে গেছে উৎপাদন। এর প্রভাব পড়েছে ক্যাপটিভের ওপর। গ্যাস সরবরাহ কমে যাওয়ায় ক্যাপটিভ থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে না পেরে ডিজেলচালিত জেনারেটরের মাধ্যমে বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে হচ্ছে। এতে এক দিকে ডিজেলের ব্যবহার, অপর দিকে বেড়ে যাচ্ছে পণ্যের উৎপাদন ব্যয়। অপর দিকে ডলারের সঙ্কটের কারণে ব্যবসায়ীরা প্রয়োজনীয় পণ্য আমদানির জন্য এলসি খুলতে পারছেন না। ইতোমধ্যে অতিপ্রয়োজনীয় পণ্য ছাড়া অন্যসব পণ্য আমদানিতে ব্যাংক থেকে ঋণ বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। শতভাগ মার্জিন দিয়েই পণ্য আমদানি করতে হচ্ছে। এতে ব্যবসায়ীদের সক্ষমতা কমে গেছে।

এ বিষয়ে ঢাকা চেম্বারের সাবেক প্রেসিডেন্ট এ কে খান বলেন, লোডশেডিংয়ের প্রভাব শিল্পকারখানার ওপর পড়বেÑ এটিই স্বাভাবিক। বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে সরকার কৃচ্ছ্রসাধনের জন্য জ্বালানি আমদানি কমিয়ে দিয়েছে। অপর দিকে ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে পণ্যের আমদানি ব্যয়ও বাড়বে। কিন্তু ব্যয় বাড়ার সাথে সাথে পণ্যের বিক্রয়মূল্য না বাড়লেই ব্যবসায়ীদের লোকসান গুণতে হবে, যা শিল্প বিকাশে হবে অন্তরায়।

খোলাবাজারে ডলারের মূল্য ছাড়িয়েছে ১১২ টাকা : এ দিকে চাহিদা অনুযায়ী সরবরাহ কম থাকায় ব্যাংক ও খোলাবাজারে হু হু করে বেড়েছে ডলারের মূল্য। গতকাল খোলাবাজারে প্রতি ডলার পেতে গ্রাহকদের সর্বোচ্চ ব্যয় করতে হয়েছে ১১২ টাকা, যা দেশের বৈদেশিক মুদ্রার ইতিহাসে রেকর্ড। শুধু খোলাবাজারেই ডলারের দাম বাড়ছে না, ব্যাংকেও বাড়ছে সমানতালে। গতকাল ব্যাংকগুলো চাহিদা মেটাতে বিদেশী এক্সচেঞ্জ হাউজগুলোর কাছ থেকে প্রতি ডলারের জন্য ১০৬ টাকা পর্যন্ত ব্যয় করেছে। ফলে আমদানি পর্যায়ে ব্যাংকগুলো গ্রাহকদের কাছে বিক্রি করেছে সর্বোচ্চ ১০৫ টাকা।

এ দিকে রিজার্ভের মজুদ কমে আসায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকও আর আগের মতো ব্যাংকগুলোর চাহিদা অনুযায়ী ডলার সরবরাহ করছে না। কোনো কোনো দিন চাহিদার ১০ ভাগের এক ভাগ ডলার সরবরাহ করা হয় রিজার্ভ থেকে। গতকালও কেন্দ্রীয় ব্যাংক তার রিজার্ভ থেকে ৫০ মিলিয়ন বা ৫ কোটি ডলার বিক্রি করেছে সঙ্কটে থাকা ব্যাংকগুলোর কাছে, যেখানে চাহিদা ছিল তারও অনেক বেশি। সংশ্লিষ্ট এক সূত্র এ তথ্য জানিয়েছে।

ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, এক্সচেঞ্জ হাউজগুলো থেকে আগে যে হারে রেমিট্যান্স সংগ্রহ করা হতো এখন আর তা করা যাচ্ছে না। একদিকে এক্সচেঞ্জ হাউজগুলো ডলারের দাম বাড়িয়ে দিচ্ছে, অপর দিকে ব্যাংকগুলো সঙ্কট মেটাতে প্রতিযোগিতার ভিত্তিতে রেমিট্যান্স সংগ্রহ করছে। এর প্রভাব পড়ছে মূল্যের ওপর। গতকাল এক্সচেঞ্জ হাউজগুলো থেকে প্রতি ডলারের জন্য ব্যাংক ভেদে ১০৬ টাকা পর্যন্ত ব্যয় করেছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে। এ বিষয়ে একজন তহবিল ব্যবস্থাপক জানিয়েছেন, শতভাগ মার্জিনের কারণে অতিপ্রয়োজনীয় পণ্য ছাড়া অন্য পণ্য আমদানির জন্য এলসি খোলার হার অনেক কমানো হয়েছে। এভাবে কমিয়ে আনা হয়েছে আমদানি ব্যয়। কিন্তু আমদানি যেটুকু করা হচ্ছে তার জন্য প্রয়োজনীয় ডলার পাওয়া যাচ্ছে না। এ কারণে গ্রাহক ঠিক রাখতে ব্যাংকগুলো বেশি দামে ডলার সংগ্রহে মরিয়া হয়ে উঠেছে। যার প্রভাব পড়েছে বৈদেশিক মুদ্রাবাজারে। আর এ কারণে আমদানিতে ব্যাংকগুলো ডলারের দাম ১০৫ টাকা পর্যন্ত নিয়েছে। কিন্তু কর্পোরেট ডিলিংয়ের মাধ্যমে এর চেয়েও বেশি দামে ডলার বিক্রি করেছে কোনো কোনো ব্যাংক। ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ায় সামগ্রিক পণ্যের দাম বেড়ে গেছে।

অপর দিকে খোলাবাজারেও ডলারের সঙ্কট দেখা দিয়েছে ব্যাপকভাবে। একটি এক্সচেঞ্জ হাউজের কর্ণধার গতকাল নয়া দিগন্তকে জানিয়েছেন, আগে হজের মৌসুমে ডলারের দাম বেড়ে যেতো। আবার হাজীরা যখন হজ করে বাড়ি ফিরতেন তখন ডলারের দাম কমে যেতো। কিন্তু এখন হচ্ছে উল্টোটা। প্রতি দিনই খোলাবাজার থেকে ডলার কিনতে যে পরিমাণ গ্রাহক আসছেন তাদের কাছে সরবরাহ তার চেয়ে অনেক কম। আর এ কারণে খোলাবাজারে ডলারের দাম বেড়ে গেছে। আগের দিন যেখানে প্রতি ডলারের জন্য ১০৮ টাকা ব্যয় করতে হয়েছিল, গতকাল তা প্রতি ডলারে চার টাকা বেড়ে সর্বোচ্চ ১১২ টাকায় উঠেছে। সরবরাহ পরিস্থিতির উন্নতি না হলে খোলাবাজারে ডলারের মূল্যের তেমন কোনো পরিবর্তন হবে না বলে তিনি মনে করেন।

নিউজটি শেয়ার করুন..

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো খবর..
© All rights reserved © 2019 bangladeshdailyonline.com
Theme Dwonload From ThemesBazar.Com