রাজধানীতে এবং দেশের বিভিন্ন বড় শহরের ৯০ ভাগ বহুতল ভবনে অগ্নিকাণ্ড নিয়ন্ত্রণে পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেই। ফলে যেকোনো ধরনের বড় অগ্নিকাণ্ডে এসব ভবনে অনেক সময় জীবনহানির পাশাপাশি সম্পদের ব্যাপক ক্ষতি হয়। এই অগ্নিকাণ্ডের ভয়াবহতারোধে দেশের সব বড় ভবন অগ্নিবীমার আওতায় আনার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। গত কয়েক বছর দেশের বেশ কয়টি বহুতল ভবনে অগ্নিকাণ্ডের ফলে ব্যাপক জানমালের ক্ষতি হয়েছে। অদূর ভবিষ্যতে এ ধরনের অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতি কমিয়ে আনার পাশাপাশি ভুক্তভোগীরা যাতে সহজে ক্ষতিপূরণ পেতে পারেন সে বিষয়ে গুরুত্ব দিয়ে একটি নীতিমালা প্রণয়নের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
এ বিষয়ে সম্প্রতি অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের একজন যুগ্মসচিবের সভাপতিত্বে একটি আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠক হয়েছে। বৈঠকের কার্যবিবরণীতে এই বীমার বিষয়ে বিভিন্ন মতামত পাওয়া গেছে।
বৈঠকে বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের পরিচালক কামরুল হক জানান, দেশে অনেক বহুতল ভবন রয়েছে, যেগুলো কখনো বীমার আওতায় আনা হয় না। ট্যারিফ বেশি হওয়ায় মূলত অনেকে বীমা করেন না। নতুন উদ্যোগ বাস্তবায়নে আইনগতভাবে তাদের বাধ্য করতে হবে।
বাংলাদেশ ইন্স্যুরেন্স ফোরামের প্রতিনিধি মো: ইমাম শাহীন জানান, দেশের বহুতল ভবনগুলো বীমার আওতায় আনতে হলে আইনগত বাধ্যবাধকতা থাকতে হবে। দেশে বর্তমানে প্রিমিয়ামের হার প্রতি বর্গফুট শূন্য দশমিক ৭৫ টাকা। এটি দেশব্যাপী চালু করতে হলে প্রিমিয়াম রেট কমাতে হবে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ইন্স্যুরেন্স অ্যাসোসিয়েশন ও বাংলাদেশ ইন্স্যুরেন্স ফোরাম মিলে বাস্তবায়নযোগ্য একটি প্রিমিয়াম হার নির্ধারণ করতে পারে। এ ছাড়াও সিটি করপোরেশনের বার্ষিক নিবন্ধন ফি নবায়নের সময় ভবনগুলোর বীমা আছে কি-না, তা সিটি করপোরেশন নিশ্চিত হতে পারে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের প্রতিনিধি জানান, দেশে সাধারণত ষষ্ঠ থেকে ১০ তলা পর্যন্ত অনেক ভবন রয়েছে। ১৮ তলার ওপরে ভবন করতে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের কাছে অতিরিক্ত ফি জমা দিতে হয়। ভবনগুলো বীমার আওতায় আনতে রাজউক ও জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের সাথে কথা বলা যেতে পারে এবং এ ক্ষেত্রে যদি আইন করার প্রয়োজন হয় তাহলে অবশ্যই তা করতে হবে। এ বিষয়ে বিআইডিআরএ-সংশ্লিষ্ট সব স্টেকহোল্ডারকে নিয়ে একটি ওয়ার্কশপ বা সেমিনারের আয়োজন করতে পারে। বৈঠকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগের প্রতিনিধি জানান, শুরুতেই বহুতল ভবনগুলো অগ্নিবীমা পলিসির মধ্যে আনতে হবে। প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে হলে তা কতটা বাস্তবসম্মত, তা বিবেচনায় আনতে হবে। তবে প্রাথমিকভাবে পাইলটিং ব্যবস্থায় ভবনগুলো বীমার আওতায় আনলে ভালো হয়। ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে যে আইনগুলো আছে সেগুলো যাতে বাস্তবায়ন করা যায় সেদিকেও লক্ষ্য রাখতে হবে। এলাকাভিত্তিক আলোচনা করে পাইলটিং কাজ শুরু করা যেতে পারে।
তিনি আরো জানান, রাস্তা প্রশস্ত না হওয়ায় অনেক সময় বহুতল ভবনের আগুন নেভাতে ফায়ার সার্ভিস কর্মীদের বেগ পেতে হয়, গাড়িগুলো ঘটনাস্থলে পৌঁছতে পারে না। ফলে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ বেড়ে যায়। বিষয়টি নিয়ে ব্যাপক পরিসরে আলোচনা হতে পারে। প্রয়োজনে সচিব কমিটিতে আলোচনার উদ্যোগও নেয়া যেতে পারে।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি জানান, বিদ্যমান আইনগুলো পর্যালোচনা করা উচিত। সার্বিকভাবে বিবেচনা করে তা বাস্তবায়ন করা যেতে পারে। তবে প্রাথমিক পর্যায়ে পাইলটিং ভিত্তিতে কাজ শুরু করা যেতে পারে। সরকারি- বেসরকারি সব ভবন বীমার আওতায় আনতে চায় সরকার। কিভাবে এটি বাস্তবায়ন হবে, সে বিষয়েও কাজ শুরু করেছে অর্থ মন্ত্রণালয়। জানা গেছে, এ মাসেই বাংলাদেশ বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (বিআইডিআরএ) সংশ্লিষ্টদের সাথে নিয়ে একটি নীতিমালার খসড়া প্রণয়ন করবে বলে বিডা সূত্রে জানা গেছে। প্রাথমিকভাবে এটি পাইলট প্রকল্প হিসেবে চালু করা যায় কি না সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ।
জানা গেছে, দেশের বহুতল ভবন ও কল-কারখানাসহ বাণিজ্যিক ভবনগুলোর প্রায় ৯০ শতাংশেই অগ্নিনির্বাপণের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেই। বেশির ভাগ ভবন পুরনো, তাই সেগুলোতে প্রয়োজনীয় অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা সংযোজন করাও কঠিন। তা ছাড়া অপরিকল্পিত নগরায়ণ ও শিল্পায়নের ফলেও আগুনের ঘটনা বাড়ছে।
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদফতরের পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, ২০১৯ সালের জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত সারা দেশে ২২ হাজার ২৮৩টি অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে। এসব ঘটনায় মারা গেছেন ২ হাজার ১৩৮ জন। দগ্ধ হন ১৪ হাজার ৯৩২ জন। এ বছর আগুনের ঘটনায় ২০৩ কোটি ৯২ লাখ ৭৪ হাজার ৩১৫ টাকার সম্পদ নষ্ট হয়েছে।
এ ছাড়াও ২০০৯ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত ১০ বছরে সারা দেশে দেড় লাখ আগুন লাগার ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় এক হাজার ৪৯০ জনের মৃত্যু এবং ৬ হাজার ৯৪১ জন দগ্ধ হয়েছেন। এ জন্য সম্পদ ও প্রাণহানি কমিয়ে আনতে সরকারি-বেসরকারি সব ভবনকে বীমার আওতায় আনার পরিকল্পনা নিয়েছে সরকার।