শিক্ষা একটি চলমান পক্রিয়া। প্রয়োজনে শিক্ষার ধারণা, বিষয়বস্তু, কারিকুলাম, শিক্ষাদান প্রক্রিয়া সময়ের আবর্তে ধীরে ধীরে পরিবর্তিত হয়। এ ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থারও অনেক উত্তরণ ঘটেছে।
মানুষ নিজের প্রয়োজনে শিক্ষা গ্রহণ করে। শিক্ষাব্যবস্থার উন্নতি ঘটায়। আর উত্তম শিক্ষা ও শিক্ষাব্যবস্থা মানুষকে এগিয়ে নিয়ে যায়। যুগে যুগে শিক্ষাবিদরা পরিবর্তিত সময়ের চাহিদা অনুযায়ী ব্যক্তিগত প্রয়োজন, সামাজিক কাঠামো, অর্থনৈতিক উন্নয়ন সংক্রান্ত গতিধারা, জাতীয় উন্নয়ন, ধর্মীয় বিশ্বাস ও সাংস্কৃতিক রীতিনীতি ইত্যাদি বিষয়ে বিবেচনা করে শিক্ষাব্যবস্থায় প্রয়োজনীয় বদল ঘটিয়েছেন। এ নিবন্ধে প্রাচীন ভারত থেকে বাংলাদেশের শিক্ষার ঐতিহাসিক বিকাশ সম্পর্কে কিছু আলোচনা করা হয়েছে।
আজকের বাংলাদেশের শিক্ষা সম্পর্কে জানতে আমাদের ইতিহাসের বাধা-বিপত্তি পথ বেয়ে বহু পেছনে ফিরে তাকাতে হবে। শিক্ষার এ ইতিহাস মোটামুটিভাবে জানতে চারটি আমলের নিরিখে উপস্থাপনের চেষ্টা করেছি আমরা। আলোচনার সুবিধার্থে আমলগুলো মোট দাগে চার ভাগে করা হয়েছে।
১. প্রাক-মুসলিম এবং মুসলিম আমলের ভারতীয় উপমহাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা। ২. ব্রিটিশ আমলে ভারতীয় উপমহাদেশে শিক্ষাব্যবস্থা। ৩. পাকিস্তান আমলের শিক্ষাব্যবস্থা। ৪. বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা : বর্তমান ও ভবিষ্যৎ।
১. প্রাক-মুসলিম এবং মুসলিম ভারতে শিক্ষাব্যবস্থা : প্রাক-ইসলামী যুগে মালাবার, চট্টগ্রাম, সিলেটসহ প্রভৃতি স্থানে মুসলিম আরবদের বসতি গড়ে ওঠে। ড. আবদুল করীম তার ‘চট্টগ্রামের ইতিকথা’ গ্রন্থে বলেন, খ্রিষ্টীয় অষ্টম/নবম শতাব্দীতে সিলেট ও চট্টগ্রামের সাথে আরবীয় মুসলমান বণিকদের যোগাযোগ ছিল। আরব বণিকরা চট্টগ্রামে স্বাধীন রাজ্য গঠন না করলেও আরবদের আসা যাওয়ার কারণে সিলেট ও চট্টগ্রামে ইসলাম প্রচার ও মুসলমানদের সংখ্যা বাড়তে থাকে। ফলে মুসলমান সন্তানদের শিক্ষা তাদের বৈঠকখানা, বাংলোয়, খানকার দরগায়, বাড়ির আঙ্গিনায় চালু হয়েছিল। প্রাচীনকালে টোল বা আনুষ্ঠানিক পাঠশালায় হিন্দু শিক্ষার্থীরা অধ্যয়ন করত। শিক্ষকরা বসতেন কাঠের টুল বা চৌকিতে। মুসলিম ভ‚স্বামীরা নিজেদের খরচে প্রতিবেশী দরিদ্র ছাত্রদের সুশিক্ষায় শিক্ষক নিযুক্ত করতেন। তারা কুরআন, হাদিস, ইসলামী শিক্ষাদান পুণ্যের কাজ বলে বিবেচনা করতেন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর যাবতীয় ব্যয়-ভার ব্যক্তি বহন করতেন। মুসলমান ধনাঢ্য ব্যক্তি সরাসরি অথবা দান, ওয়াকফ বা ট্রাস্টের মাধ্যমে ইসলাম শিক্ষা বিস্তারে ভ‚মিকা রাখতেন। তাদের উদ্দেশ্য ছিল শিক্ষার প্রসারের মাধ্যমে মুসলিম জাতির ধর্মীয় ও নৈতিক মানোন্নয়ন করা। যাতে করে শিক্ষার মাধ্যমে ঘরে ঘরে নৈতিক চরিত্রের অধিকারী আদর্শ মানুষ তৈরি হয়।
প্রাক-মুসলিম এবং মুসলিম আমলে উপমহাদেশে শিক্ষা বলতে অবিভক্ত ভারতের প্রাথমিক শিক্ষার ইতিহাসই বুঝিয়ে থাকে। ইতিহাস পাঠে জানা যায়, সভ্যতা ও সংস্কৃতি এবং ধনসম্পদের দিক থেকে উপমহাদেশ ঐশ্বর্যশালী ছিল। ফলে দ্রাবিড়, আর্য, মঙ্গোলিয়া, তুর্কি, পাঠান, মুঘল, ইংরেজ প্রভৃতি জাতি ভারতে আগমন, বসবাস ও শাসন করেছে যুগ যুগ। আনুমানিক ২০০০ বছরেরও আগে প্রাচীন ভারতে আনুষ্ঠানিক শিক্ষাব্যবস্থার সূত্রপাত। প্রাচীন ভারতের এ শিক্ষাব্যবস্থা ছিল ধর্মকেন্দ্রিক। ধর্মের ভিত্তিতে প্রাচীন ভারতের এ শিক্ষাব্যবস্থা তিন শ্রেণীতে ভাগ করা যায়। ১. বৈদিক শিক্ষা; ২. বৌদ্ধ শিক্ষা ও ৩. মুসলিম শিক্ষা। প্রাচীন ভারতের এ তিন শ্রেণীর শিক্ষার বৈশিষ্ট্য, বিষয়বস্তু এবং শিক্ষাব্যবস্থা সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোকপাত করা হলো।
বৈদিক শিক্ষাব্যবস্থা : বেদ হিন্দুদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ। এটি সংস্কৃত ভাষায় রচিত। বেদ শব্দের অর্থ জ্ঞান। বৈদিক চিন্তাধারা ও দার্শনিক মতবাদের ওপর প্রতিষ্ঠিত এ শিক্ষাব্যবস্থা ‘ব্রাহ্মণ্য’ শিক্ষা নামে অভিহিত। ব্রাহ্মণ্য শিক্ষাব্যবস্থায় বর্ণ বৈষম্যছিল প্রকট। ফলে এ শিক্ষা সর্বজনীন না হয়ে ব্যক্তি বা গোষ্ঠীকেন্দ্রিক হয়ে ওঠে। এ ব্যবস্থায় ব্রাহ্মণ শিক্ষার্থীরা উচ্চতর জ্ঞান লাভের সুযোগ পেত। ক্ষত্রীয় শিক্ষার্থীরা রাজগৌরব বা যুদ্ধবিদ্যা লাভ করত। অন্য দিকে বৈশ্য বালকেরা কৃষি ও ব্যবসার বিষয়ে শিক্ষা লাভ করত। শিক্ষার্থীর পাঁচ বছর বয়সে ‘স্বীকরনম’ অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে শিক্ষা শুরু হতো।
বৈদিক শিক্ষার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল ব্রাহ্মণ শিশুদের পুরোহিত করে গড়ে তোলা। শিক্ষকরা সবাই ছিলেন ব্রাহ্মণ। বৈদিক শিক্ষার মাধ্যম ছিল সংস্কৃত। পুরো শিক্ষা ছিল গুরুকেন্দ্রিক, শিক্ষাগুরু শিক্ষাক্রম ও শিক্ষাসূচি নির্ধারণ করতেন। ব্রাহ্মণ্য শিক্ষাব্যবস্থায় তিন ধরনের বিদ্যালয় ছিল। বিদ্যালয়গুলো পরিষদ, টোল ও পাঠশালা নামে পরিচিতি পায়। প্রাচীন ব্রাহ্মণরা পরিষদের, তরুণ ব্রাহ্মণরা টোলে এবং আদিম অধিবাসী ও শূদ্র সম্প্রদায় ছাড়া সবাই পাঠশালায় প্রাথমিক শিক্ষা লাভের সুযোগ পেত।
পাঠশালায় পড়ালেখা, গণনা এবং পৌরাণিক কাহিনী পড়ানো হতো। সেখানকার শিক্ষকরাও ছিলেন ব্রাহ্মণ। তারা কোনো বেতন পেতেন না। পূজা পার্বণে দক্ষিণা এবং ফসল উঠার সময় ফসলের একটি বিশেষ অংশ পেতেন।
প্রাচীন ভারতে এক নজরে বৈদিক শিক্ষার বৈশিষ্ট্য : বৈদিক শিক্ষার ধারক ও বাহক ছিলেন প্রাচীন ভারতের আদি শিক্ষাগুরু জ্ঞানতাপস ঋষিগণ। শিক্ষা শুরু হতো ব্রাহ্মণ বালকের পৈতা পরার মাধ্যমে। একে বলা হতো উপনয়ন। এ শিক্ষাব্যবস্থায় সংযম সাধনা করতে হতো। শিক্ষা নিতে একেকজন শিক্ষার্থীকে কঠোর বিধিনিষেধ মেনে চলতে হতো। শিক্ষাপদ্ধতিটি ছিল গুরু বা শিক্ষককেন্দ্রিক। শিক্ষাদান হতো গুরুর বেদপাঠের মাধ্যমে যা শিক্ষার্থীদের মনোযোগ সহকারে শুনে বুঝতে হতো।
বৌদ্ধ শিক্ষাব্যবস্থা : গৌতম বুদ্ধের অহিংসনীতির ভিত্তিতে বৌদ্ধ শিক্ষার আবির্ভাব ঘটে। নির্বাণ লাভ বৌদ্ধ ধর্মের অভীষ্ট লক্ষ্য। অষ্টমা বা অষ্টপন্থায় নির্বাণ লাভ ছিল বৌদ্ধ শিক্ষার মূল কথা। সৎ চিন্তা, সৎ বাক্য, সৎ বিশ্বাস, সৎ উপার্জন, সৎ ধ্যান, সৎ প্রচেষ্টা ও সৎ স্মৃতি হচ্ছে অষ্টমার উপাদান। শিক্ষার মাধ্যমে অষ্টমা চর্চা এবং ব্যক্তিজীবনে প্রতিষ্ঠিত করে দুঃখময় পৃথিবী থেকে নির্বাণ বৌদ্ধ শিক্ষার লক্ষ্য। শিশুর ছয় বছর থেকে শিক্ষা শুরু হতো এবং চৌদ্দ বছর বয়স পর্যন্ত চলত। গল্পের মাধ্যমে দৃষ্টান্ত দিয়ে সাধারণত মুখে মুখে ধর্ম শিক্ষা দেয়া হতো। মাঝে মধ্যে আলোচনা ও বিতর্ক সভারও আয়োজন করা হতো। গণতন্ত্র ছিল বৌদ্ধশিক্ষার প্রধান বৈশিষ্ট্য। শিক্ষার দ্বার ছিল সবার জন্য খোলা।
এক নজরে বৌদ্ধ শিক্ষার বৈশিষ্ট্য : বৌদ্ধ ধর্ম বিশ্বাসের আলোকে প্রতিষ্ঠিত শিক্ষাব্যবস্থা। প্রাচীন ভারতে তথা উপমহাদেশে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয় বৌদ্ধ শিক্ষাব্যবস্থায়, পাল আমলে। ব্যক্তিকেন্দ্রিক শিক্ষার জায়গায় দলকেন্দ্রিক শিক্ষার প্রচলন। শ্রেণিভিত্তিক শিক্ষা চালু। ধর্মীয় শিক্ষার পাশাপাশি জীবনমুখী শিক্ষার প্রচলন হওয়ায় বৌদ্ধশিক্ষা ব্যাপক বিস্তার লাভ করে।
মুসলিম শিক্ষাব্যবস্থা : ভারতে মুসলিম শাসনামলে প্রাথমিক শিক্ষা ছিল মসজিদকেন্দ্রিক। মসজিদগুলো মক্তব হিসেবে ব্যবহৃত হতো। চার বছর বয়সে শিক্ষার্থীকে আনুষ্ঠানিকভাবে কলেমা পাঠের মাধ্যমে মক্তবে ভর্তি হতে হতো। নামাজপাঠে মক্তবে প্রয়োজনীয় সূরা কেরাত শিক্ষা দেয়া হতো। মূল পাঠ শুরু হতো সাত বছর বয়সে। মুসলিম শিশুরা মক্তবে কুরআন, আরবি ও ইসলাম শিক্ষা অর্জন করত। পাশাপাশি পড়ালেখা ও সাধারণ হিসাব নিকাশও শিক্ষা দেয়া হতো। মসজিদের ইমামরা মক্তবে শিক্ষকতার কাজ করতেন।
বিশেষ করে মুসলিম সুলতানরা নৈতিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধের শিক্ষা বিস্তারে অধিকতর মনোযোগী ছিলেন। শিক্ষার প্রসারে তারা সর্বোচ্চ ব্যবস্থা গ্রহণের চেষ্টা করতেন। মুসলিম শাসকদের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে মুসলিম জমিদার, লাখেরাজদার, মুসলিম ধনাঢ্য ব্যক্তিসহ মুসলিমপ্রধানরা নিজ নিজ এলাকায় মক্তব, মাদরাসা এবং দরগাহ কায়েম করতেন। এসবের ব্যয়ভার বহনে প্রভ‚ত ধনসম্পদ ও জমিদান করতেন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপনের মাধ্যমে মুসলমানরা শিক্ষার্থীদের নৈতিক চরিত্রের অধিকারী ও মানবিক গুণাবলিসম্পন্ন আদর্শ মানুষ রূপে গড়ে তোলার চেষ্টা করতেন।
মুসলিম আমলের শিক্ষার বৈশিষ্ট্য : বৈঠকখানা, বাংলোয়, বাড়ির আঙ্গিনায়, মসজিদ ও মক্তবভিত্তিক শিক্ষা ব্যাপকভাবে চালু ছিল। এ সময় বহু মাদরাসা ও সাধারণ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপন করা হয়। কুরআনিক শিক্ষার আলো সাধারণ মানুষের ঘরে পৌঁছে দেয়া হয়। ধর্মীয় শিক্ষার সাথে সাধারণ শিক্ষার সমন্বয় ছিল। মুসলমান ও হিন্দু ধর্মের মধ্যে সমন্বিত শিক্ষা ধারার প্রবর্তন ছিল তখন। প্রখ্যাত ধর্মীয় আলেম ও বিচক্ষণ পণ্ডিতের মাধ্যমে শিক্ষাদান কার্যক্রম পরিচালনা করা হতো। শিক্ষার পরিমাণগত ও গুণগত উভয় দিকে উন্নতি লাভ করে।
(দ্বিতীয় পর্ব আগামীকাল)
লেখক: সাবেক কলেজশিক্ষক ও সাবেক সিনেট
সদস্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়