রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ০৯:১৩ পূর্বাহ্ন

তামাক ও অ্যালকোহলের ভয়াল থাবা

ডা: মো: তৌহিদ হোসাইন
  • আপডেট টাইম : শনিবার, ৬ আগস্ট, ২০২২
  • ১১৭ বার

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, বর্তমান বিশ্বে ১৩০ কোটি ধূমপায়ী আছে। ধূমপানের এই প্রবণতা অব্যাহত থাকলে ২০২৫ সালের মধ্যে ধূমপায়ীর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়াবে ১৬০ কোটিতে। ধূমপানের কারণে বিশ্বে প্রতি পাঁচ সেকেন্ডে একজন করে মানুষ মারা যাচ্ছে। অর্থাৎ তামাক প্রতি বছর ৮০ লাখের বেশি মানুষকে হত্যা করে। ৭০ লাখেরও বেশি মানুষের মৃত্যু হয় সরাসরি তামাক সেবনে এবং প্রায় ১২ লাখ লোকের মৃত্যু হয় ধূমপায়ীদের ধোঁয়ার সংস্পর্শে আসায়। বিশ্বের ১৩০ কোটি তামাক সেবনকারীর ৮০ শতাংশই নিম্ন ও মধ্য আয়ের দেশের বাসিন্দা।

গবেষণার তথ্য, ধূমপানের কারণে প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ ধূমপায়ীরা গড়ে ১৩.২ বছর হারায় এবং মহিলা ধূমপায়ীরা ১৪.৫ বছরের জীবন হারায়। গড়ে পৃথিবীর ধূমপায়ীদের মধ্যে ৪৩.৫ শতাংশ দারিদ্র্যসীমার নিচে এবং মাত্র ১৪.৩ শতাংশ দারিদ্র্যসীমার উপরে। একটি সিগারেটে চার হাজার আট শতাধিক রাসায়নিক থাকে, যার মধ্যে ৬৯টি ক্যান্সারের কারণ হিসেবে পরিচিত।

সব ধরনের তামাকজাত দ্রব্যই ঝুঁকিপূর্ণ এবং এর কোনো নিরাপদ ডোজ নেই। অর্থাৎ যত কম বা বেশিই গ্রহণ করুন না কেন পুরোটাই অনিরাপদ। তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহারের কারণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি বছর চার লাখ ৮০ হাজার লোকের মৃত্যু হয়, যার মধ্যে ৪১ হাজার লোকের মৃত্যু ঘটে পরোক্ষ ধূম্র সেবনে। সাধারণত ধূমপায়ীরা, অধূমপায়ীদের চেয়ে ১০ বছর আগে মারা যায়।

পৃথিবীতে এইচআইভি, অবৈধ ওষুধ সেবন, মাদকদ্রব্য সেবন, মোটরবাইক এক্সিডেন্ট এবং অগ্নিকাণ্ড মিলিয়ে যত লোকের মৃত্যু হয় এককভাবে ধূমপানের কারণে তার চেয়েও বেশি লোক মারা যায়। আমেরিকার বিভিন্ন যুদ্ধে যত লোক এ পর্যন্ত মারা গেছে তার চেয়েও ১০ গুণ বেশি লোক অকালেই ঝরে পড়েছে শুধু ধূমপানের কারণে।

প্রতি ১০ জন ফুসফুস ক্যান্সার এবং সিওপিডিতে আক্রান্ত রোগীর মধ্যে যথাক্রমে ৯ জন ও আটজনই আক্রান্ত হয় ধূমপানের কারণে। যত কারণেই মানুষের মৃত্যু হোক না কেন ধূমপান তার মৃত্যুঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়।

গত ৫০ বছরে মার্কিনিদের মধ্যে ধূমপানের কারণে মৃত্যুহার অনেক বেড়েছে। শুধু চীনেই ৩০ কোটি ধূমপায়ী আছে যারা সারা বছরে ১.৭ ট্রিলিয়ন এবং মিনিটে ৩০ লাখ সিগারেট সেবন করে। এক কোটি সিগারেট প্রতিদিন কেনাবেচা হয়। চীনে প্রতি বছর ছয় ট্রিলিয়ন সিগারেট তৈরি হয়।

একই সিগারেট ও সিগারের মধ্যে যথাক্রমে ৮-৯ মিলিগ্রাম এবং ১০০-৪০০ মিলিগ্রাম নিকোটিন থাকে। প্রতিদিন এরকম পাঁচটি সিগারেট সেবনই একজনকে ধীরে ধীরে মৃত্যুমুখে ঠেলে দেয়ার জন্য যথেষ্ট। উন্নত বিশ্বের ধূমপান আইনে পৃথিবীর মাত্র শতকরা ২০ জনকে সুরক্ষা দেয়া যাচ্ছে। প্রতিদিন এক হাজার ৫০০ কোটি সিগারেট সারা পৃথিবীতে ব্যবহার হচ্ছে। কানাডায় সিগারেটের কারণে ৩০ শতাংশ ক্যান্সার রোগী মারা যায়।

অধূমপায়ীদের চেয়ে ধূমপায়ীরা হার্ট ডিজিজ, স্ট্রোক এবং ফুসফুস ক্যান্সারের বেশি ঝুঁকিতে থাকে যথাক্রমে ২-৪ গুণ, ২-৪ গুণ এবং ২৫ গুণ। ধূমপানে রক্তনালী চিকন ও শক্ত হয়ে যায় ফলে রক্তনালীর গায়ে ক্লট জমা হয়ে সহজেই স্ট্রোক বা বার্স্ট হয়ে যেতে পারে। এমনকি পায়ে এবং চামড়ায় রক্ত প্রবাহ কমিয়ে দেয়, ফলে পেরিফেরাল ভাস্কুলার ডিজিজ হয়।

ধূমপায়ী হলে শরীরের যেকোনো জায়গায় ক্যান্সার ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়। মুখে, গলায়, ল্যারিনক্সে, একিউট মায়েলয়েড লিউকেমিয়া, লিভার, কিডনি, স্টোমাক, জরায়ু মুখ, প্যানক্রিয়াস, ইউরিনারি ব্লাডার, কোলন এবং রেক্টাম ইত্যাদিতে ক্যান্সার ঝুঁকি বেড়ে যায়।

যদি কেউ-ই ধূমপান না করত তাহলে সমাজে ক্যান্সারের কারণে মৃত্যুর হার তিন ভাগের এক ভাগ হয়ে যেতো।

ধূমপায়ী মায়েদের গর্ভধারণে নানা ধরণের সমস্যা হতে পারে। তাদের মৃত সন্তান প্রসব, স্বল্প ওজন নিয়ে জন্মানো, হঠাৎ মৃত্যুর লক্ষণ এবং জন্মগত ত্রুটি নিয়ে জন্মাতে পারে। ধূমপায়ীদের ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হাওয়ার ঝুঁকি ৩০-৪০ শতাংশ বেশি। তাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও অধূমপায়ীদের চেয়ে কম। চোখে ছানি পড়া এবং মুখের ভেতরের নানা রোগে আক্রান্ত হবার ঝুঁকি ধূমপায়ীদের ক্ষেত্রে দ্বিগুণ। তাদের ত্বকের সৌন্দর্য ও ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায় বিশেষ করে ঠোঁটের ক্যান্সার। ধূমপান শরীরের নানা অঙ্গে ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়।

কিশোর ধূমপায়ী
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় ৩০ শতাংশ কিশোর ধূমপান করে এবং প্রতিদিন গড়ে তিন হাজার ২০০ জন তরুণ-তরুণী প্রথম সিগারেট ধরেন। ভারতে ধূমপায়ী আছে প্রায় ১২ কোটি।

কিশোর ধূমপায়ীদের প্যানিক অ্যাটাক, উদ্বেগজনিত ব্যাধি এবং হতাশার আশঙ্কা বেশি।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যেসব কিশোর-কিশোরী ধূমপান করে তাদের মধ্যে অ্যালকোহল ব্যবহারের প্রবণতা সাধারণের চেয়ে তিনগুণ, মারিজুয়ানা ব্যবহারের প্রবণতা চারগুণ এবং কোকেন ব্যবহারের প্রবণতা ২২ গুণ বেশি।

ধূমপান ছেড়ে দিলে যে উপকার আপনি পাবেন
২০ মিনিট পর: হার্ট রেট এবং ব্লাডপ্রেসার কমতে শুরু করে।
১২ ঘণ্টা পর: রক্তে কার্বন মনোক্সাইড স্বাভাবিক মাত্রায় নেমে আসে।
সিগারেট ছেড়ে দেয়ার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে রক্তে নিকোটিন লেভেল নরমাল হয়ে যায়।
ছাড়ার দুই দিনের মধ্যে খাবারের স্বাভাবিক ঘ্রাণ এবং স্বাদ ফিরে আসে।
কিন্তু তৃতীয় দিন থেকে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে মাথা ব্যথা এবং অস্বস্তি অনুভব হয়।
ছাড়ার এক মাস পর থেকে কাশি শ্বাসকষ্ট থাকলে কমতে শুরু করে।
তিন মাসের মাথায় ব্লাড সার্কুলেশনের উন্নতি হয়।
৯ মাসের মাথায় ফুসফুসের সিলিয়া এবং মিউকাস মেমব্রেন পুরোপুরি ঠিক হয়ে যায়।
এক বছর পর: হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি অনেক কমে যায়। কাশি এবং উপরের শ্বাসযন্ত্রের সমস্যাগুলো উন্নত হতে শুরু করে।
২-৫ বছর পর: সিডিসির নির্ভরযোগ্য সূত্র অনুসারে, ধূমপান না করা লোকের মতোই স্ট্রোকের ঝুঁকি কমে যায়।
৩-৬ বছর বিরত থাকলে করোনারি আর্টারি ডিজিজের ঝুঁকি অর্ধেক কমে আসে।

অ্যালকোহলের ভয়াল থাবা
বিশ্ব সাস্থ্য সংস্থার মতে, প্রতি বছর ৩০ লাখ লোক মারা যায় শুধু অ্যালকোহল ব্যবহারে যা মোট মৃত্যুর ৫.৩ শতাংশ (পুরুষ-৭.৭ শতাংশ এবং মহিলা-২.৬ শতাংশ)।

অ্যালকোহল ব্যবহারের ফলে পাঁচ কোটি ৩০ লাখ লোক শারীরিক, মানসিক ও সামাজিকভাবে অচল হয়ে পড়ে। মদপানকারীরা যৌন অপরাধ, মারামারি, হানাহানি ও খুনাখুনিতে আনন্দ পায়। ফলে সহজেই সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ে।

অতিরিক্ত অ্যালকোহল ব্যবহারে শরীরে দুই শতাধিক রোগের সৃষ্টি হতে পারে। অ্যালকোহলের অপব্যবহার অকাল মৃত্যুর অন্যতম কারণ। প্রায় ২০-৩৯ বছর বয়সীদের মোট মৃত্যুর ১৩.৫ শতাংশ অতিরিক্ত অ্যালকোহল ব্যবহারে হয়ে থাকে। অ্যালকোহল ব্যবহারের সাথে মানসিক ও আচরণগত পরিবর্তন লক্ষণীয় হওয়ার কারণে সামাজিক অপরাধ বেড়ে যায়। ফলে আত্মহত্যা, যানবাহন দুর্ঘটনা ও ভায়োলেন্সের মাত্রা বহুগুণে বেড়ে যায়।

অ্যালকোহলে আসক্ত গর্ভবতী মায়েদের অনেকেরই ফিটাল অ্যালকোহল সিনড্রোম নামক স্থায়ী সমস্যা নিয়ে সন্তানের জন্ম দেন। অ্যালকোহল ব্যবহারে যক্ষা, এইচআইভি এবং করোনা সংক্রমণের ঝুঁকি বেড়ে যায়। অগ্ন্যাশয়ের ক্যান্সারসহ অনেক রোগের প্রকোপ বেড়ে যায়।

অ্যালকোহলের অপব্যবহার ফলে স্নায়ুবিক জটিলতা, মস্তিষ্কের ডিএনএর ক্ষতি হয়। অ্যালকোহল প্রতিরোধযোগ্য লিভার সিরোসিস ও ক্যান্সারের অন্যতম কারণ। মদ্যপানের কারণে কোলেস্টেরল বেড়ে যাওয়া, স্ট্রোক এবং স্মৃতিভ্রষ্টতার ঝুঁকি বাড়ে।

আমেরিকায় এক গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে যে, সিগারেটের যেমন কোনো নিরাপদ মাত্রা নেই, তেমনি মদেরও কোনো নিরাপদ মাত্রা নেই। মদ পান করলে ক্ষতি হবেই। গবেষকরা এই প্রথমবারের মতো একসুরে এসব কথা স্বীকার করে নিয়েছেন।

গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, বিশ্বে অপরিণত বয়সে মৃত্যু ও প্রতিবন্ধিতার জন্য সপ্তম ঝুঁকিপূর্ণ অভ্যাস মদ্যপান। মদের স্বাস্থ্যঝুঁকি নিয়ে ব্রিটেনভিত্তিক জনস্বাস্থ্য ও চিকিৎসা সাময়িকী দ্য ল্যানসেটর প্রবন্ধেও এসব তথ্য তুলে ধরা হয়েছে।

১৯৯০ থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে ১৯৫টি দেশে মদের ব্যবহার, অসুস্থতা ও মৃত্যুর তথ্য এতে বিশ্লেষণ করে গবেষকরা বলেছেন, মদের কোনো নিরাপদ মাত্রা নেই।

গবেষকরা বলছেন, ১৫-৪৯ বছর বয়সী মানুষের ১০টি মৃত্যুর মধ্যে একটি ঘটে মদের কারণে। নিয়মিত মদ্যপান শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ ও টিস্যুতে বিরূপ প্রভাব ফেলে। স্বাস্থ্যঝুঁকি নির্ণয়ের জন্য আরো ৫৯২টি গবেষণা প্রবন্ধ বিশ্লেষণ করা হয়েছে। এসব পর্যালোচনা শেষে গবেষকরা বলছেন, ৫০ বছরের বেশি বয়সীদের ক্যান্সারে মৃত্যুর পেছনে প্রধান কারণ মদ্যপান।

মদ ও তামাক: কোনটা বেশি ক্ষতিকর
এক কথায় বলতে গেলে, সিগারেটে ফিজিক্যাল স্বাস্থ্যঝুঁকি বেশি আর অ্যালকোহলে মানসিক এবং সামাজিক ক্ষতি বেশি।

যুক্তরাজ্যে চালানো এক জরিপে গবেষকরা বলছেন, আপনি যদি প্রতি সপ্তাহে এক বোতল ওয়াইন খান, তাহলে আপনার ক্যান্সার হওয়ার ঝুঁকি ততটাই বাড়বে- যতটা সপ্তাহে পাঁচ থেকে ১০টি সিগারেট খেলে বাড়ত।

লেখক: সহযোগী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, ডিপার্টমেন্ট অব হিস্টোপ্যাথলজি, ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব কিডনি ডিজিজেস অ্যান্ড ইউরোলজি

নিউজটি শেয়ার করুন..

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো খবর..
© All rights reserved © 2019 bangladeshdailyonline.com
Theme Dwonload From ThemesBazar.Com