মহররম যুগ যুগান্তরের অনেক ঘটনার ভার বহন করে কালচক্রের পাখায় চরে বারবার আমাদের কাছে ফিরে আসে। আরবি বর্ষ-পরিক্রমার এটি প্রথম মাস। এটি ‘আশহারুল হুরুম’ বা হারামকৃত মাস চারটির একটি। মহররম মানে সম্মানিত। নামের মাধ্যমেই সম্মানিত ও মর্যাদা পরিস্ফুট হয়েছে। ইসলামী ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ ও বহুল আলোচিত ঘটনাগুলো এ মাসেই সংঘটিত হয়েছে। এ মাসেরই একটি গুরুত্বপূর্ণ দিন হলো ১০ মহররম, যা আশুরা নামে অধিক পরিচিত। ইতিহাসের নানা ঘটনায় ভরপুর এ দিনটি। হজরত ইবনে আব্বাস রা: থেকে বর্ণিত- তিনি বলেন, নবী সা: মদিনায় আগমন করে দেখতে পেলেন ইহুদিরা আশুরার দিন রোজা পালন করছে। নবীজী সা: বললেন, ‘এটি কী’? তারা বলল, এটি একটি ভালো দিন। এ দিনে আল্লাহ তায়ালা বনি ইসরাইলকে তাদের দুশমনের কবল থেকে বাঁচিয়েছেন। তাই মুসা আ: রোজা পালন করেছেন। রাসূলুল্লাহ সা: বললেন, ‘মুসাকে অনুসরণের ব্যাপারে আমি তোমাদের চেয়ে অধিক হকদার। অতঃপর তিনি রোজা রেখেছেন এবং রোজা রাখার নির্দেশ দিয়েছেন।’ (বুখারি-১৮৬৫) ইমাম আহমাদ রা: বর্ণনা করেছেন, ‘এটি সেই দিন যাতে নূহ আ:-এর কিশতি জুদি পাহাড়ে স্থির হয়েছিল, তাই নূহ আ: আল্লাহর শুকরিয়া আদায়স্বরূপ রোজা রেখেছিলেন।
এ মাসে এ দিনে প্রেরণার একটি বাতিঘর রয়েছে, যেটিকে পাশ্চাত্য ও দেশীয় ইসলামবিদ্বেষী গোষ্ঠী ভেঙে তথায় একটি রঙিন বাতিঘর স্থাপন করেছে; যাতে মুসলমানরা কোনো দিন সে প্রেরণায় উজ্জীবিত হতে না পারে। মুসলমান ষড়যন্ত্রমূলক রঙিন সেই বাতিঘরের ধাঁধায় পড়ে ইমামের প্রতি সস্তা ভালোবাসা প্রকাশে মাতম করে করে শুধু বুকই পাঠিয়েছে। কিন্তু সঠিক প্রেরণার ইতিহাস তারা জানতে পারেনি এবং নিজেদের উজ্জীবিত করতে পারেনি। মহররমের মূল চেতনার সেই ইতিহাসের পাতা থেকে বিশ্বমুসলিমকে ছিটকে ফেলে দেয়া বা বিস্মৃত করার পাশ্চাত্য টার্র্গেট সফল হয়েছে। এ সফলতার কারণেই এ দিনের অসংখ্য ঘটনার মধ্যে একটিমাত্র চেতনা, যা মুসলমানদের জানা ও উপলব্ধি করা একান্তই প্রয়োজন ছিল সেটিকে বাদ দিয়ে আমাদের সম্মানিত ইমাম সাহেবরা তা চেপে যান। তারা সঠিক চেতনার ইতিহাসটি বলার সাহস করেন না বা কালের বিস্মৃত ইতিহাসের কবলে তারাও নিমজ্জিত। ফলে শুধু মুখরোচক ও উত্তেজিত ঘটনাগুলো বর্ণনা করে একান্তই কিসসা-কাহিনীর মতো সাময়িকভাবে মজাদান করা হয়। তাদের নিমিত্তে অনুরোধ, মহররমের বিস্মৃত স্মৃতিকে মন্থর করুন।
আশুরায় দিনে সংঘটিত অসংখ্য ঘটনার মধ্যে সবচেয়ে বড় ট্র্যাজিডি হলো কারবালার মরু প্রান্তরে তৎকালীন রাষ্ট্র কর্তৃক ইমাম হোসাইন রা: ও তার পরিবারের হত্যাকাণ্ড। পৃথিবী তার বিশাল বুকে যতগুলো দুঃখ আর বেদনাকে ধারণ করে এখনো টিকে আছে এবং যতগুলো মর্মান্তিক ঘটনা বা দুর্ঘটনা ইতিহাসকে বারবার কাঁদায়, তন্মধ্যে শাহাদতে কারবালা সর্বোচ্চ আসনকে সিক্ত করেছে। প্রতিটি মুসলমান পুরুষ ও নারী হজরত ইমাম হোসাইন রা:-এর শাহাদতের ঘটনায় আন্তরিক দুঃখ ও বেদনা প্রকাশ করে থাকে। নিঃসন্দেহে এটি আল্লাহ ও তার রাসূল সা:-এর প্রতি ঈমানের স্বাভাবিক প্রতিফলন এবং মানবতার প্রতি ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ। এটি নিছক একটি হত্যাকাণ্ডই ছিল না, বরং এ হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে ইসলামের ইতিহাস তার সঠিক পথ থেকে বিচ্যুত হয়ে অন্য দিকে মোড় নিয়েছিল। এ হত্যাকাণ্ড যতটুকু বেদনাদায়ক তার চেয়েও বেদনাদায়ক হলো ইসলাম ও ইসলামী জীবনব্যবস্থা রাসূল সা:-এর প্রদর্শিত যেই রাস্তা বেয়ে পথ চলছিল, সেটি ইমামের হত্যার মাধ্যমে বাঁকা পথে মোড় নেয়। ইমাম আগে থেকেই বুঝতে পেরেছিলেন যে, বাঁকা পথে আরোহণকারী ইসলাম নামক ট্রেনটির ড্রাইভার ট্রেনটিকে বাঁকা পথে নিয়ে যাচ্ছে। খুব শিগগিরই এর যাত্রীদের গোমরাহিতে নিমজ্জিত করবে। তাই তিনি পথভ্রষ্ট ড্রাইভারটিকে নামিয়ে ট্রেনটিকে সঠিক পথে তথা রাসূল সা:-এর প্রদর্শিত পথে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু বাতিল রাষ্ট্রদণ্ডের ক্ষমতাবলে তাঁকে এগোতে দেয়া হয়নি। বরং রাস্তার এ বিশাল বাধাটিকে চিরতরে শেষ করে দেয়ার জন্য তাঁকে সপরিবারে শহীদ করে দেয়া হয়। ইমামের হত্যার মাধ্যমে ইসলামী রাষ্ট্রকে অন্ধকার পথে নিয়ে যাওয়ার আর কোনো বাধাবিপত্তি রইল না।
হৃদয় আরো দুঃখ-ভারাক্রান্ত হয়ে উঠে যখন এমনটি হতে দেখা যায়, বিশ্ব মুসলিম ইমাম হোসাইন রা:-এর শাহাদতের মূল উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যকে ভুলে গিয়ে বেহুদা সব কাজে লিপ্ত হয়। মনে রাখতে হবে, আমরা যদি ইমাম হোসাইন রা:-এর মূল চেতনাকে উপলব্ধি না করি, তবে ভালোবাসার পরিবর্তে তাঁর প্রতি সুস্পষ্ট জুলুম করা হবে। কিয়ামতের দিন ইমাম যদি তাঁর রক্তমাখা জামা আর ছোট্ট শিশু সন্তানদের নিয়ে আল্লাহর দরবারে হাজির হয় এবং আমাদের কাছে প্রশ্ন করে বসে, আমি কি আমার ব্যক্তিগত কোনো উদ্দেশ্যকে চরিতার্থ করার জন্য শহীদ হয়েছিলাম? তখন আমাদের কি কোনো জবাব থাকবে? সুতরাং আমাদেরকে সর্বপ্রথম সঠিক ইতিহাস এবং মহররমের সঠিক শিক্ষা জানতে হবে। তার পর সে অনুযায়ী আমাদের কর্মপন্থা গ্রহণ করতে হবে এবং মানুষের সামনে শাহাদতে কারবালার সঠিক ইতিহাস তুলে ধরতে হবে। ইমাম যেই চেতনার কারণে তৎকালীন রাষ্ট্রশক্তির সামনে দাঁড়িয়েছিলেন, সেই চেতনা মানুষের মধ্যে জাগিয়ে তোলার বাধ্যতামূলক দায়িত্ব নিতে হবে। আমাদের ইতিহাসের নিম্নলিখিত বিষয়গুলো জানতে হবে-
প্রথমত, উপলব্ধি করতে হবে, রাসূল সা: তাঁর অক্লান্ত পরিশ্রমে ইসলামের যে গাছটি পরিপূর্ণ মহিরূপে রেখে গেছেন তার প্রথম থেকে শেষ অবধি চাক্ষুষ সাক্ষী ছিলেন অত্যন্ত প্রিয়ভাজন হজরত হোসাইন রা:। সেই আদর্শিক গাছটির ডালপালা ইতোমধ্যে কেটে দেয়া হলো। কিন্তু যখন তার মূল কর্তন ও নতুন একটি বিষবৃক্ষ রোপণ করতে এগোয়, তখন তিনি এর গতি প্রতিরোধে সর্বশক্তি নিয়োগ করেছিলেন। আর এ জন্যই ইতিহাসের এ মর্মান্তিক অধ্যায়ের সৃষ্টি হয়েছে।
দ্বিতীয়ত, জানতে হবে, ইসলামী সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থার মূল কথা হলো- সমাজ ও রাষ্ট্রের কোনো পর্যায়ে পদ দাবি করার বা চেয়ে নেয়া যাবে না, আবার দায়িত্ব এলে তা শরয়ী ওজর ছাড়া অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই। হজরত আবদুর রহমান ইবনে সামুরাহ রা: থেকে বর্ণিত- তিনি বলেন, রাসূল সা: আমাকে বলেছেন, ‘তুমি নেতৃত্ব চেয়ে নেবে না। কেননা তুমি যদি চেয়ে নেতৃত্ব লাভ করো তাহলে তোমাকে ওই পদের হাওয়ালা হবে। (সে অবস্থায় তুমি আল্লাহর কোনো সাহায্য পাবে না।) আর যদি কোনো রকম প্রার্থনা করা ছাড়া তুমি নেতৃত্ব লাভ করো, তাহলে আল্লাহর তরফ থেকে তোমাকে দায়িত্ব পালনে সাহায্য করা হবে।’ (বুখারি-মুসলিম) এটি কেবল পুরুষানুক্রমিক বা বংশপরম্পরায় গদিনশিন হওয়া বা মনোনীত করারও কোনো বিষয় নয়। রাসূল সা: বলেছেন, ‘মুসলিম জনগণের সাথে পরামর্শ না করে কেউ কাউকে নেতা হিসেবে বায়আত করলে, সে বায়আত গ্রহণযোগ্য হবে না।’ (মুসনাদে আহমাদ) ইসলাম নেতৃত্ব পরিবর্তন বা নেতৃত্ব বাচাই করার যে নিয়ম বা পন্থা বলে দিয়েছে, এটিই অত্যন্ত সুষম পন্থা, এর মাধ্যমে ইসলামী রাষ্ট্র সব ধরনের বিকৃতি থেকে রক্ষা পায়। কিন্তু এ পন্থা বাদ দিলে সেখানে বিভিন্ন ধরনের বিকৃতি ও স্বেচ্ছাচারিতা বাসা বাঁধে। ফলে রাষ্ট্র ব্যবস্থার সব স্তরে অশান্তি আর অস্থিরতা প্রবল আকার ধারণ করে। বিদ্বেষ, পেশিশক্তি, সঙ্কীর্ণ গোত্র বা বংশমর্যাদা এবং কুৎসিত ঘরোয়া প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও সংঘর্ষ দানা বেঁধে ওঠে। নেতৃত্বের পালাবদলের যে নিয়ম ইসলাম অনুমোদন দেয়নি, তৎকালীন নেতৃত্ব সেই নিয়মের দিকে অগ্রসরমান দেখে হজরত হোসাইন রা: শঙ্কিত হয়ে পড়েন। তিনি তৎকালীন শাসকদের ইসলামী রাষ্ট্রের মৌলিক দিক পরিবর্তনের ব্যাপারটি শিগগিরই বুঝতে পারেন এবং নিজের প্রজ্ঞা দিয়ে এর করুণ পরিণতির চিন্তা করেন। তাই তিনি দ্রুতগতিসম্পন্ন দিকবিভ্রান্ত গাড়ি থামিয়ে তার সঠিক লাইনে পরিচালিত করার জন্য নিজের জান কোরবান করে দেন।
তৃতীয়ত, অবৈধভাবে নেতৃত্বের পালাবদলের কারণে তৎকালীন নেতৃত্ব জুলুমতন্ত্র কায়েম করে। ইসলামী রাষ্ট্রের সর্বস্তরে বিভিন্ন ধরনের বিকৃতি, স্বেচ্ছাচারিতা, অশান্তি আর অস্থিরতা প্রবল আকার ধারণ করে। বিদ্বেষ, পেশিশক্তি, সঙ্কীর্ণ গোত্র বা বংশমর্যাদা ও কুৎসিত ঘরোয়া প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও সংঘর্ষ দানা বেঁধে ওঠে। স্বৈরতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় সাধারণ মানুষ চরমভাবে অসহায়, মানবিক অধিকার বঞ্চিত দাসানুদাসে পরিণত হতে থাকে। রাজতান্ত্রিক শাসনের ফলে জনগণের ওপর মর্মস্পর্শী স্বৈরাচারী শাসন পরিচালনা হতে থাকে এবং আল্লাহর বিধিবিধান বিভিন্নভাবে অবহেলিত হতে থাকে। রাষ্ট্রের সহায়তায় মদ ও বারের আসন জমজমাট হতে থাকে। যেসব প্রতিষ্ঠানে আল্লাহর নাম উচ্চারিত হয়, সেগুলো গুরুত্বহীন প্রতিষ্ঠানে পরিণত করার জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালানো হয়। এজিদ একটি স্বৈরশাসকে পরিণত হয়ে চরম অহঙ্কারী ও সীমালঙ্ঘনকারীতে নিমজ্জিত হয়। সে যা চিন্তা করে, তার যৌক্তিকতা সবাই মেনে নিতে থাকে। তার কথাই হবে আইন, জনগণকে তা অকুণ্ঠিত মনে ও নির্বাক চিত্তে মেনে নিতে হবে। কেউ তার স্বাধীন বিমুক্ত চিন্তা-বিবেচনা শক্তিও প্রয়োগ করতে পারছে না। ফলে হজরত হোসাইন রা: শঙ্কিত হয়ে পড়েন এবং নিজের সর্বশক্তি প্রয়োগ করে স্বৈরশাসকের গতিরোধ করতে গিয়ে শহীদ হন।
চতুর্থত, ইমাম হোসাইন রা: শাহাদত আমাদের জন্য প্রেরণার বাতিঘর। আমাদেরকে ইমামের শাহাদতের মূল উদ্দেশ্য ভালো করে উপলব্ধি করতে হবে। ইসলামী রাষ্ট্রের বুনিয়াদি নীতি সংরক্ষণের জন্য ইমামের শাহাদত ছিল এক ঐতিহাসিক নজরানা। আমাদেরকে প্রথমত ইসলামী সমাজ বিনির্মাণের পথে এগিয়ে আসতে হবে। তবেই ইমামের প্রতি ভালোবাসার যথার্থতা প্রকাশ পাবে। মনে রাখতে হবে, এ পথে বাধ সাধবে পৃথিবীর তাবত তাগুতি শক্তি ও কায়েমি স্বার্থবাদী গোষ্ঠী। ইমাম হোসাইন রা:-এর মতো দৃঢ ঈমান নিয়ে আমাদের এসব শক্তির মোকাবেলায় এগিয়ে যেতে হবে।
লেখক : শিক্ষাবিদ ও কলামিস্ট