অর্থ পাচার, দুর্নীতি ও লুটপাটের কারণে মূল্যস্ফীতি বাড়ছে বলে মনে করছেন বিরোধী রাজনীতিকরা। যুগান্তরের সঙ্গে আলাপকালে তারা জানান, রাশিয়া ও ইউক্রেন যুদ্ধের মধ্যে বিশ্ববাজারে তেল ও খাদ্যপণ্যের দাম কমেছে।
অথচ এই যুদ্ধের দোহাই দিয়ে বাংলাদেশে একের পর এক বিভিন্ন জিনিসের দাম বাড়ানো হচ্ছে। সবশেষ জ্বালানি তেলের রেকর্ড দাম বাড়ানো হয়েছে। এতে মানুষের কষ্ট আরও সীমাহীন হয়ে উঠবে। মূল্যস্ফীতি আরও বাড়বে। মূল্যস্ফীতির লাগাম টানতে দুর্নীতি, লুটপাট বন্ধসহ সরকারের বিভিন্ন অপ্রয়োজনীয় খাতের খরচ কমানোর পরামর্শ দেন বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতারা।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, জিনিসপত্রের দাম নিয়ন্ত্রণহীন। মূল্যস্ফীতির চাপে সাধারণ মানুষ দিশেহারা। সবশেষ জ্বালানি তেলের দাম বাড়িয়েছে সরকার। এর প্রভাব পড়েছে সবকিছুর ওপর। আন্তর্জাতিক বাজারে যখন জ্বালানি তেলের দাম কমেছে, তখন বাংলাদেশে দাম বাড়ানো হলো।
তিনি বলেন, দুর্নীতি, লুটপাট ও ব্যর্থতাকে ধামাচাপা দিতে সরকার বিভিন্ন সময় নানা ধরনের কথাবার্তা বলছে। তাদের লুটপাটের অর্থনীতির কারণেই জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে। পৃথিবীর কোথাও বাংলাদেশের মতো এত খারাপ অবস্থা হয়নি। অর্থ পাচার, লুটপাট, ব্যাংক লুট, রিজার্ভ লুট-এসব না হলে দেশ স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে যাবে। মূল্যস্ফীতি কমতে বাধ্য।
জাতীয় পার্টির মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু এমপি বলেন, সরকার উন্নয়ন প্রকল্পের নামে দিনের পর দিন খরচ বাড়িয়ে যাচ্ছে। প্রকল্প নির্ধারিত সময়ে শেষ হচ্ছে না। বরং মেয়াদ বাড়ছে। এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে খরচও। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে-অর্থ পাচার, সীমাহীন দুর্নীতি ও লুটপাট।
অনুন্নয়ন খাতে ব্যয়ের পাশাপাশি দুর্নীতি আমাদের অর্থনীতিকে ধ্বংস করে দিচ্ছে। আর এসব সামাল দিতে সরকার নানা অজুহাতে তেলের দাম বাড়িয়েছে। এর আগে গ্যাস, পানি ও বিদ্যুতের দাম বাড়িয়েছে। তিনি বলেন, মানুষের আয় বাড়ছে না। কিন্তু ব্যয় বাড়ছেই। বাড়ি ভাড়া, দ্রব্যমূল্যের ওপর নিয়ন্ত্রণ নেই। এ কারণে মানুষের জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠছে।
গণঅধিকার পরিষদের আহ্বায়ক ও বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. রেজা কিবরিয়া বলেন, দুর্নীতি এবং অদক্ষতার কারণে সরকার গ্যাস, তেল ও বিদ্যুতের দাম বাড়াচ্ছে। বিদেশে তো তেলের দাম কমতে শুরু করেছে। অথচ এর কোনো প্রভাব বাংলাদেশে নেই। তেলের দাম বাড়ায় সবকিছুর মূল্য বেড়েছে। আর মুদ্রাস্ফীতি নিয়ে সরকার যে পরিসংখ্যান দিয়েছে, তা মিথ্যা। আমার হিসাবে ১০ থেকে ১৫ শতাংশের মধ্যে মুদ্রাস্ফীতি। মনিটরিং পলিসি ঠিক না করলে মুদ্রাস্ফীতির হার কমবে না।
তিনি বলেন, খরচ যতটুকু দেখানো হচ্ছে আসলে হয় তার ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ। সুতরাং চুরিটা কমালে অনেক কম টাকায় অনেক কাজ করা যাবে। ধনীদের ওপর যে ট্যাক্স পড়ে তা কার্যকর না, সেটা কর্যকর করতে হবে। সরকারের আয় বাড়াতে হবে। আমাদের দেশ এখন সব দেশের পেছনে আছে। জিডিপির মাত্র ১০ শতাংশ আমরা ট্যাক্স থেকে সংগ্রহ করি। এটা অনেক বাড়াতে হবে। কোম্পানি ট্যাক্স বাড়াতে হবে। এ ছাড়া কমাতে হবে চুরির পরিমাণও। অতিরিক্ত চাহিদা আর মূল্যের ইমপ্যাক্ট কমানোর জন্য কিছু পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে।
বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের যে মুদ্রানীতি, সেটা কখন সংকোচন ও প্রসারণ করতে হবে তা ঠিকভাবে মনিটর প্রয়োজন। দ্রুত টাকার মান কমে যাচ্ছে। এটা ভয়াবহ একটা পরিস্থিতি। প্রথমত, সরকারের মুদ্রানীতি থেকে শুরু করে সামগ্রিক পর্যালোচনা করে একটি সিদ্ধান্ত নেওয়া দরকার। দ্বিতীয়ত, সরকার যে আমদানি ব্যয়ের কথাগুলো বলছে, তাতে কিছু তথ্য আছে বিভ্রান্তিকর। জ্বালানির ক্ষেত্রে রাশিয়া-ইউক্রেনের যে যুদ্ধের কথা বলছে, এটা একেবারেই হাস্যকর। ইতোমধ্যে কিন্তু নানা কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালনি তেলের দাম কমে আসছে।
তিনি বলেন, বিপিসি গত আট বছরে ৪২ হাজার কোটি টাকা লাভ করেছে। সরকারি কোষাগারে গেছে ১৮ থেকে ২০ হাজার কোটি টাকা। আর তারা গত আট মাসে আট হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দিয়েছে বলে এখন জ্বালানির মূল্যেবৃদ্ধির পক্ষে যুক্তি দিচ্ছে। যে টাকাটা লাভ করল এটা দিয়ে তারা এখন দাম না বাড়িয়ে ভর্তুকি দিয়ে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার সুযোগ ছিল। এখন জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির প্রভাব পড়েছে সব ক্ষেত্রে।
প্রত্যেকটি পরিবার কোনো না কোনোভাবে আক্রান্ত। যেখানে কোনো যৌক্তিক কারণ নেই সেখানে পর্যন্ত মূল্য বাড়ানো হয়েছে। ফলে সরকারের পদক্ষেপ যে অভিঘাত পড়তে পারে এগুলো খুব বেশি গুরুত্ব দিয়ে দেখা হচ্ছে না। যদিও এ ক্ষেত্রে সরকারকে ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করা দরকার। আগামী ছয় মাস বা এক বছরের জন্য বিলাসী দ্রব্যের আমদানি কমাতে হবে। সরকারি খরচ কমাতে হবে। এ ছাড়া এ ধরনের আরও অনেক ক্ষেত্র আছে। এটা করা গেলে অর্থনীতিকে আরও শক্তিশালী রাখা সম্ভব।