প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্প্রতি আমিরাত সফর করে এসেছেন। সেখানে ‘গালফ নিউজকে এক সাক্ষাৎকার দিতে গিয়ে তিনি বিভিন্ন বিষয়ে তাঁর বক্তব্য তুলে ধরেছেন। তার মধ্যে রয়েছে রোহিঙ্গা সমস্যা, বাংলাদেশে কয়লা-বিদ্যুৎ উৎপাদনের কথা ইত্যাদি। তাঁর এই বক্তব্যে প্রাধান্য পেয়েছে ভারতের বিজেপি সরকারের সাম্প্রতিক নাগরিকত্ব আইন। এ সম্পর্কে তিনি বলেছেন, ‘বাংলাদেশ এটাই বলে আসছে যে নাগরিকত্ব সংশোধন আইন কিংবা নাগরিকপঞ্জি ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়। ভারত সরকারও এটাই দাবি করছে। তবে এই নাগরিকত্ব আইন (সিএএ) পাস করানোর কোনো প্রয়োজন ছিল না।’ শেখ হাসিনা আরো বলেছেন, গত অক্টোবর মাসে তাঁর দিল্লি সফরের সময় নরেন্দ্র মোদি তাঁকে বলেছেন, ‘এই আইন পাস করা তাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়।’
ভারতের প্রধানমন্ত্রীর কথার জবাবে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী কী বলেছেন, তা গালফ নিউজকে বলেননি। আমরাও জানি না। তবে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে নরেন্দ্র মোদিকে বিনয়ের সঙ্গে জানানো দরকার, রোহিঙ্গা সমস্যা যেমন মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার নয়, তেমনি ভারতের নাগরিকত্ব আইন এবং নাগরিকপঞ্জি তাদের অভ্যন্তরীণ বিষয় নয়।
মিয়ানমারও প্রথমে দাবি করেছিল এটা তাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়। গণহত্যার বিষয়টি তো তারা অস্বীকারই করেছিল। পরে বিশ্ব আদালতে আসামির কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে অং সান সু চিকে তাঁর সেনাবাহিনীর বর্বর অত্যাচারের কথা স্বীকার করতে হয়েছিল। আর এই বর্বরতার মাসুল গুনতে হচ্ছে প্রতিবেশী বাংলাদেশকে। আশ্রিত ১১ লাখ রোহিঙ্গার বোঝা এখন দরিদ্র বাংলাদেশের কাঁধে।
ভারত নাগরিকত্ব আইন বহাল হলে একমাত্র হিন্দু ছাড়া মুসলমান, খ্রিস্টান, দলিত সম্প্রদায় এবং উপজাতিসমূহের লোকের নাগরিকত্ব হারানোর ভয় আছে। আসামে আবার বাঙালি বিতাড়ন শুরু হতে পারে। দেখাদেখি মেঘালয় ও নাগাল্যান্ডেও। প্রকাশ্যে গোমাংস খেলে কিংবা গোমাংস বিক্রি করলে বজরং গোষ্ঠীর সদস্যরা ভিন্নধর্মের মানুষকে হত্যা করবে। এরই মধ্যে তা করেছে। রাস্তায় চলতে গিয়ে কোনো মুসলমান নাগরিক জয়রাম জয় সীতারাম ধ্বনি উচ্চারণ না করলে গোঁড়া হিন্দুত্ববাদীরা তাঁকে প্রহারে প্রহারে জর্জরিত করবে। এর মধ্যেই কয়েক স্থানে করেছে। তার কোনো প্রতীকার নেই। কোনো কোনো রাজ্যে মসজিদ অতীতে মন্দির ছিল দাবি করে তা ভেঙে মন্দির করা হয়েছে। গেরুয়াধারী হিন্দুত্ববাদীদের অত্যাচারে সারা ভারত আজ জর্জরিত।
বিজেপি যে আজ সারা ভারতকে হিন্দু রাষ্ট্রে পরিণত করতে চায় তা স্পষ্ট। দেশের বিভিন্ন স্থানে মুসলমান নামে যেসব শহর, বন্দর, রাস্তাঘাট আছে, যেমন উরুঙ্গাবাদ, আহমেদাবাদ, আফজালনগর প্রভৃতির নাম পরিবর্তনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। পাঠ্য ইতিহাস বিকৃত করা হচ্ছে। মুসলমান শাসকদের নাম বাদ দিয়ে কল্পিত হিন্দু বীরদের গালগল্প ইতিহাস বলে সাজানো হচ্ছে। ডাকটিকিটে নেহরু-গান্ধীর ছবি বিলুপ্ত হচ্ছে। উঠে আসছে শিবাজি, সাভারকরের ছবি।
গোটা ভারতকে এভাবে কট্টর হিন্দুত্ববাদী রাষ্ট্রে পরিণত করার বিরুদ্ধে সংখ্যাগরিষ্ঠ সচেতন হিন্দু সমাজ এবং তাদের বুদ্ধিজীবীরাও প্রতিবাদ জানিয়েছেন। গণপ্রতিবাদে সারা দেশ উত্তাল। এক উত্তর প্রদেশেই পুলিশের গুলিতে মারা গেছে ১৩ জন। পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, ঝাড়খণ্ডসহ বহু রাজ্য নাগরিক সংশোধনী আইন এবং নাগরিকপঞ্জি অনুযায়ী বিধি-ব্যবস্থা তাদের রাজ্যে বাস্তবায়নে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। এটা এখন স্পষ্ট, গান্ধী-নেহরুর গণতান্ত্রিক ভারত মধ্যযুগীয় হিন্দু রাষ্ট্রে পরিণত হতে রাজি নয়। তারা জানে, তাতে ভারতের ভবিষ্যৎ অন্ধকার।
পার্লামেন্টে পাস হওয়া নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন কার্যকর করা হলে ‘অবৈধ অনুপ্রবেশকারী’ বলে ঘোষিত ব্যক্তিদের জন্য কনসেনট্রেশন ক্যাম্প তৈরির ব্যবস্থা হয়েছে। একাধিক রাজ্য এই কনসেনট্রেশন ক্যাম্প তৈরিতে অসংগতি জানিয়েছে। এ ধরনের পাগলামি আমেরিকায় ডোনাল্ড ট্রাম্প শুরু করেছিলেন। ছয়টি কি সাতটি মুসলিম রাষ্ট্রের নাগরিকদের আমেরিকায় প্রবেশ নিষিদ্ধ করেছিলেন। মেক্সিকো থেকে বহিরাগমন বন্ধ করার তুঘলকি বুদ্ধি দ্বারা সীমান্তে দেয়াল তৈরির উদ্যোগ নেন। এই দেয়াল নির্মাণের খরচ চান মেক্সিকান গভর্নমেন্টের কাছে। নাৎসিদের কায়দায় সীমান্তে কনসেনট্রেশন ক্যাম্প করে তাতে মায়ের বুক থেকে শিশু কেড়ে নিয়ে আলাদাভাবে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে রাখা হয়েছিল। এর ফলে শুধু আমেরিকায় নয়, সারা বিশ্বে ধিক্কার ধ্বনি উঠেছিল। ফলে ট্রাম্পকে তাঁর নিন্দিত ইমিগ্রেশন নীতি থেকে কিছুটা পিছু হটতে হয়েছিল।
ট্রাম্পের উগ্র জাতীয়তাবাদী ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ নীতি এবং বিজেপির উগ্র হিন্দুত্ববাদী নীতির মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। এ ধরনের নীতি থেকেই ফ্যাসিবাদের জন্ম হয়। ভারতে তাই বাম-ডান গণতান্ত্রিক দলগুলোর মধ্যে তাদের দেশে গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে শঙ্কা দেখা দিযেছে এবং তারা বিজেপির বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হচ্ছে। ভারতের বুদ্ধিজীবীরা বিজেপির নাগরিকত্ব সংশোধন আইন ও নাগরিকপঞ্জির বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছেন। আগের সেই মোদি-হাওয়া এখন আর ভারতে নেই।
ভারতে যদি গণতন্ত্রের পতন ঘটে, দেশটি হিন্দু রাষ্ট্র হয়ে দাঁড়ায়, তার প্রতিক্রিয়া সারা উপমহাদেশে ছড়াবে। পাকিস্তান এমনিতেই একটি সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র, বাংলাদেশেও সাম্প্রদায়িক শক্তি উৎসাহিত হবে। বাংলাদেশে সংখ্যালঘু হিন্দু-বৌদ্ধরা যে সুখে আছে তা নয়। তাদের ওপর ‘নীরব অত্যাচার’ এখনো চলছে। ভারতে মুসলমানদের ওপর অত্যাচার হচ্ছে—এ কথা প্রচারিত হলে বাংলাদেশের নিরীহ হিন্দু ও বৌদ্ধ সম্প্রদায় তাতে পাল্টা উত্পীড়নের শিকার হতে পারে।
ভারতে বাবরি মসজিদ ভাঙা এবং গুজরাট দাঙ্গার পর এরশাদের আমলে বাংলাদেশের চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামে নিরীহ হিন্দু ও বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের ওপর চরম নির্যাতন হয়েছিল। সরকারকে তার ক্ষতিপূরণ করতে হয়েছিল। এবার নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন ও নাগরিক গণনার ফলে আসামে ১৯ লাখ নর-নারী ভারতের নাগরিক তালিকার বাইরে থাকে। এরা ঘরছাড়া হলে বাংলাদেশেই আশ্রয় গ্রহণ করতে চাইবে। ১১ লাখ রোহিঙ্গার বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের পর আরো কয়েক লাখ ভারতীয় মুসলমান বাংলাদেশে ঢুকলে তার সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থা কী দাঁড়াবে? অবিভক্ত আসামে সাদুল্লা বরদৌলাই গভর্নমেন্টের আমলে ‘বঙ্গাল খেদাও’ আন্দোলনের সময় অনেকেই বাংলাদেশে এসে আশ্রয় গ্রহণ করেছিল। বর্তমানে শুধু আসামে নয়, সারা ভারতেই যদি সংখ্যালঘু—বিশেষ করে ‘মুসলমান খেদাও’ নীতি অনুসৃত হয়, তাহলে তারা কি পাকিস্তান ও বাংলাদেশমুখী হবে না? যদি হয়, তাহলে বিজেপি সরকার কী করে দাবি করে নাগরিকত্ব সংশোধন আইন তাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়?
ভারতের সাধারণ মানুষ এবং বিরোধী রাজনৈতিক দল ও বুদ্ধিজীবীদের আন্দোলনের ফলে কোণঠাসা বিজেপি সরকার এখন বলছে, তারা কারো নাগরিকত্ব হরণ করবে না। বিশেষ করে মুসলমান নাগরিকদের ভয় পাওয়ার কিছু নেই। তাই যদি হবে, তাহলে তারা কী করে আইন করে যে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের কোনো হিন্দু ভারতে গিয়ে তাদের নাগরিকত্ব চাইলে সঙ্গে সঙ্গে তা মঞ্জুর করা হবে। এটা একদিক থেকে বর্ণবৈষম্যমূলক আইন। অন্যদিকে সরাসরি পাকিস্তান ও বাংলাদেশের হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষকে দেশ ত্যাগে উসকানি প্রদান। এটা কী করে ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয় হয়?
ভারতের বিজেপি সরকারের এই উগ্র হিন্দুত্ববাদী নীতি অনুসরণের সমালোচনা করা বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে সহজ নয়। তাতে দুই দেশের বর্তমান সরকারের মধ্যে সৌহার্দ ও মৈত্রী ক্ষুণ্ন হতে পারে। বেসরকারি পর্যায়ে এ ব্যাপারে লেখক ও বুদ্ধিজীবীরাও বেশি সরব নন। তার কারণ ভারতে মুসলমানরা সরকারি নীতির দরুন অত্যাচারিত হচ্ছে এ কথা জানলে বাংলাদেশে উগ্র মৌলবাদী ও সাম্প্রদায়িক শক্তি আবার দেশের হিন্দু, বৌদ্ধ ও উপজাতিগুলোর ওপর চড়াও হতে পারে। তাই আন্তর্জাতিক ফোরামে বিজেপির এই মধ্যযুগীয় চণ্ডনীতির প্রতিবাদ হওয়া উচিত। গত শতকে ইউরোপে অতি জাতীয়তাবাদ থেকে ফ্যাসিবাদের জন্ম হয়েছিল। একুশ শতকে উপমহাদেশে তার পুনরাবৃত্তি ঘটুক—এটা কারো কাম্য হতে পারে না।