গর্ভপাত-গর্ভ নষ্টকরণকে ইংরেজিতে এবোরশন বলা হয়। এটি নিয়ে নানাজনের নানাবিধ প্রশ্ন, তাই এখানে উক্ত বিষয়ে আলোকপাত করার চেষ্টা করছি। গর্ভের ভ্রূণ কখনো নষ্ট হয়ে নিজে নিজেই বেরিয়ে আসে আবার কখনো চিকিৎসার মাধ্যমে গর্ভ নষ্ট করে ফেলে দেয়া হয়, আর এটাকেই গর্ভপাত বলা হয়। ভ্রূণ নিজে নিজে পড়ে গেলে সে ক্ষেত্রে শরঈ দৃষ্টিকোণে কোনো কথা নেই। তবে ইচ্ছাকৃতভাবে যদি কেউ গর্ভের ভ্রূণ ফেলে দিয়ে গর্ভ নষ্ট করতে চায় তাহলে তার জন্য তা বৈধ হবে কি না? মূলত প্রশ্ন এ বিষয়ে।
অবস্থার ভিন্নতার কারণে উক্ত ক্ষেত্রে হুকুমেরও ভিন্নতা রয়েছে। তাই সর্বপ্রথম দেখতে হবে গর্ভের মধ্যে থাকা ভ্রূণের বয়স কত? তাতে রূহ এসেছে কি না? অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ প্রকাশিত হয়েছে কি না?
এসব বিষয়ের ওপর ভিত্তি করেই এবোরশন তথা গর্ভপাতের বিধিবিধান পরিলক্ষিত হবে। তাই এ ক্ষেত্রে নিম্নের সুরত এবং সংশ্লিষ্ট হুকুমগুলো লক্ষণীয় :
১. যদি ভ্রূণের বয়স ১২০ দিনের কম হয় এবং অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ যেমন : হাত, পা, নখ, চুল, অঙ্গ ইত্যাদি প্রকাশিত হওয়া শুরু হয়ে যায় (যা সাধারণত ৪২-৪৩ দিনের মধ্যে প্রকাশ পাওয়া শুরু হয়) তাহলে এ অবস্থায় গর্ভপাত করা অবৈধ এবং মাকরুহে তাহরিমী। তবে যদি শরিয়ত সমর্থিত কোনো ওজর থাকে তাহলে বৈধ। যেমন : আগের বাচ্চার জন্য বুকের দুধ শুকিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা এবং মহিলার স্বামীরও অন্যভাবে বাচ্চার দুধের ব্যবস্থা করার সামর্থ্য না থাকা, গর্ভধারণের ফলে মহিলা মারা যাওয়ার আশঙ্কা না থাকা ইত্যাদি ইত্যাদি (সহিহ মুসলিম, হা. নং : ৪২৯৫, রদ্দুল মুহতার : ৬/৫৯১, কাজিখান (ফতোওয়ায়ে আলমগিরীসহ) : ৩/৪১০)।
২. ভ্রূণের বয়স চার মাসের ঊর্ধ্বে এবং ছয় মাসের কম হলে তখন গর্ভপাত ঘটানো হারাম। কেননা এ অবস্থায় গর্ভপাত ঘটানো হত্যাতুল্য। চার মাস পরেই সাধারণত ভ্রূণে রূহ এসে যায়। আর রূহ আসার পর ভ্রূণকে হত্যা করা কেমন যেন একজন মানুষকে হত্যা করা। তাই তা হারাম ও নিষিদ্ধ (ফাতহুল আলিয়্যিল মালিক : ১/৩৯৯)।
৩. ভ্রূণের বয়স যদি চার মাসের কম হয় এবং কোনো অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সৃষ্টি না হয় সে ক্ষেত্রে গর্ভপাত ঘটানো মাকরুহে তানজিহী। তবে শরিয়ত সমর্থিত কোনো ওজর থাকলে মাকরুহ হবে না। যেমন : মহিলা অনেক দুর্বল হওয়া, গর্ভধারণে সক্ষম না হওয়া ইত্যাদি (আলবাহরুর রায়েক ৮/৩৭৯, রদ্দুল মুহতার ৬/৪২৯)।
বর্তমান সময়ে অনেকে ভ্রূণ নষ্ট করে এ কারণে যে, যদি সন্তান বেশি হয় তাহলে খাওয়াবে কিভাবে। এ ধরনের ধারণা রেখে ভ্রূণ নষ্ট করা চরম অন্যায় ও হারাম। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এটি কুফুরি পর্যায়ে চলে যায়।
তাই এ ধরনের ধারণায় কখনো নিপতিত না হওয়া চাই। কেননা তা কুরআনের স্পষ্ট আয়াত বিরোধী কাজ। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আর তোমরা তোমাদের সন্তানদের দরিদ্রতার ভয়ে হত্যা করো না। তাদের এবং তোমাদের আমিই জীবনোপকরণ দিয়ে থাকি। নিশ্চয় তাদের হত্যা করা মারাত্মক অপরাধ (সূরা বনি ইসরাইল : ৩১)।
আবার কেউ কেউ নবদম্পতি ইনজয় করার লক্ষ্যে এ কাজটি করে থাকে, শরিয়ত এ ক্ষেত্রেও তাকে এবোরশন তথা গর্ভপাতের অনুমতি দেয়নি।
আবার অনেকে মনে করেন যে, আগত শিশুকে সে লালন-পালন করতে সক্ষম হবে না। এই ভয়ে সে গর্ভপাত করে। এটিও চরম বোকামি এবং শরিয়ত গর্হিত কাজ।
তাই আমাদের উচিত হবে গর্ভধারণের পর যথাসম্ভব গর্ভকে নষ্ট না করার সর্বোচ্চ চেষ্টা করা। কেননা এটি করা বিনা ওজরে যেমনি শরিয়ত বিরোধী তেমনি এটি মহিলার সুস্বাস্থ্যের জন্য অনেক ক্ষতিকর একটি কাজ।
তবে মনে রাখতে হবে গর্ভস্থ ভ্রূণের বয়স যদি ছয় মাস বা তার বেশি হয় তাহলে কোনো অবস্থাতেই ওই ভ্রূণ নষ্ট করা বৈধ হবে না, কেননা ওই বাচ্চাকে হত্যা করার অধিকার শরিয়ত কাউকে দেয়নি, এটি করা স্পষ্ট হারাম।
আল্লাহ তায়ালা স্পষ্টভাবেই তার কালামে মাজিদে বলেছেন, আল্লাহ যার হত্যা হারাম করেছেন, যথার্থ কারণ ছাড়া তোমরা তাকে হত্যা করো না (সূরা বনি ইসরাইল : ৩২)।
গর্ভের সন্তানের কারণে মহিলার কোনো সমস্যা হওয়ার সম্ভাবনা থাকলে গর্ভের সন্তানকে সিজারের মাধ্যমে বের করে এনে মা ও সন্তান উভয়কেই সুস্থ রেখে বাঁচানো সম্ভব। তাই গর্ভের সন্তানের কারণে মহিলা মারা যাওয়ার বিষয়টির বিবেচনা এখানে রুদ্ধ হয়ে গেল।