বিশ্বে জনসংখ্যা ৮০০ কোটিরও বেশি। এর মধ্যে ইসরাইলে ইহুদির সংখ্যা ৫৪ লাখ, অবশিষ্ট প্রায় এক কোটি ইহুদি সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে আছে। ইহুদিদের এই সংখ্যা পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার মাত্র দুই সহস্রাংশ (০.২ ভাগ); অর্থাৎ পৃথিবীর জনসংখ্যার প্রতি ৫০০ জনে একজন ইহুদি। এই ০.২ ভাগ মানুষ বলতে গেলে সারা বিশ্বের অর্থনীতি, রাজনীতি, সমাজনীতিসহ অনেক কিছুই নিয়ন্ত্রণ করে। এটা কী করে সম্ভব, সেটাই আজকের আলোচনার বিষয়।
প্রথমেই আমরা আলোচনা করব ইহুদি সম্প্রদায়ের কী এমন মেধা এবং যোগ্যতা যার ফলে তারা সংখ্যায় এত কম হয়েও সারা বিশ্বকে নিয়ন্ত্রণ করছে। এ কথা সত্যি যে, প্রায় ৩০০০ বছরের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, ইহুদি সম্প্রদায় থেকে যুগে যুগে বেরিয়ে এসেছে অসংখ্য প্রতিভাবান ব্যক্তি। একেশ্বরবাদী ইব্রাহিমী ধর্মগুলোর মতে হজরত ইব্রাহিম আ:-পরবর্তী একমাত্র হজরত মোহাম্মদ সা: ছাড়া বাকি সব নবীই এসেছেন ইহুদি সম্প্রদায় তথা বনি ইসরাইল থেকে। জ্ঞান, শিক্ষা ও শিল্পের চর্চায় সবসময়ই তারা অগ্রগামী এবং ইহুদিদের ৮৫ ভাগ বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রিধারী। এ কমিউনিটির সদস্যদের হাতে মেডিসিন, ফিজিক্স, কেমিস্ট্রি, ইকোনমিক্স, লিটারেচার ও পিস বিভাগে এখন পর্যন্ত ২০০টিরও বেশি নোবেল পুরস্কার এসেছে যা মোট নোবেল বিজয়ীদের প্রায় ৪০ ভাগ। সারা বিশ্বের পুঁজিবাদী গণতন্ত্রের মূল অভিভাবকও তারা। বর্তমান পৃথিবীর চলমান পুঁজির ৮৫ শতাংশ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে নিয়ন্ত্রণ করেন ইহুদিরা।
বিখ্যাত ইহুদিদের মধ্যে আছেন কমিউনিজমের স্বপ্নদ্রষ্টা সমাজবিজ্ঞানী, চিন্তাবিদ ও দার্শনিক কার্ল মার্কস; রয়েছেন বিশ্বের মানুষকে মুগ্ধ করে রাখা জাদুশিল্পী হুডিনি ও বর্তমানে ডেভিড কপারফিল্ড; একুশ শতকের শ্রেষ্ঠ দুই বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইনস ও স্টিফেন হকিং। আরো রয়েছেন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও দার্শনিক প্রফেসর নোয়াম চমস্কি, যাকে প্রদত্ত ডক্টরেটের সংখ্যা আশিটিরও বেশি। লেখকদের মধ্যে রয়েছেন আর্থার মিলার, ফ্রানজ কাফকা, জন স্টেইনব্যাক। এসেছেন সাইন্স ফিকশন জগতের সবচেয়ে আলোচিত লেখক আইজাক আসিমভ। পৃথিবীর মোট তথ্যপ্রবাহের ৬০ ভাগই কোনো না কোনোভাবে নিয়ন্ত্রণ করা পৃথিবীর সবচেয়ে বড় মিডিয়া গ্রুপের মালিক রুপার্ট মারডক। তার অধীনে সারা বিশ্বের ১৮৫টি পত্রপত্রিকা ও অসংখ্য টিভি চ্যানেল। ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপসহ সবচেয়ে বড় সোশ্যাল মিডিয়া গ্রুপের মালিক ও প্রধান নির্বাহী মার্ক জাকারবার্গ। সঙ্গতকারণেই প্রশ্ন জাগে, ইহুদিরা সংখ্যায় কম হয়েও কিভাবে এতটা এগিয়ে এবং কিভাবে তারা সবার ওপরে যেতে পারে? আরো প্রশ্ন জাগে, সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় তারা দাপট কিভাবে দেখাচ্ছে এবং কেমন করেই বা প্রায় সকল ইহুদিরাই একই মানসিকতা সম্পন্ন হয়?
ইহুদি সম্প্রদায় কিভাবে এত মেধাবী
এ কথা সত্যি যে, ইহুদি সম্প্রদায় মেধার দিক দিয়ে বিশ্বে সবচেয়ে এগিয়ে। প্রশ্ন হলো, এই মেধা কি নিতান্তই কাকতালীয় ব্যাপার নাকি ব্যাপারটা মনুষ্যসৃষ্ট? স্রষ্টাই বা কেন তাদেরকে এই বিশেষ বুদ্ধিমত্তা দিয়ে দুনিয়াতে পাঠিয়েছেন? আসলে স্রষ্টার দেয়া মেধার সাথে মেধার উন্নয়নে রয়েছে ইহুদিদের সাধনা। মেধার সাধনা শুরু হয় মহিলাদের গর্ভাবস্থায় অনাগত সন্তানের জন্য প্রাকপ্রস্তুতি দিয়ে। গর্ভবতী মায়েরা সবসময় গান-বাজনা এবং পিয়ানো বাজান এবং তাদের স্বামীদেরকে নিয়ে গণিতের বই সাথে থাকে এবং তার বিভিন্ন সমস্যার সমাধান করেন। তাদের বিশ্বাস, এটা তাদের শিশু গর্ভাবস্থা থেকেই প্রশিক্ষণ নিতে পারে এবং পরে জন্মের পর আরো বেশি মেধাবী হয়ে বেড়ে উঠতে পারে।
গর্ভবতী মায়েদের খাদ্যাভ্যাসে রয়েছে পুষ্টিকর খাদ্য যেমন, আমন্ড, খেজুর, দুধ, রুটি, মাছ এবং নানান বাদামযুক্ত সালাদ, কড লিভার ইত্যাদি এবং তারা বিশ্বাস করে, এই সব খাদ্য মস্তিষ্কে পুষ্টি সরবরাহ করে। তারা সবসময় মাছ খেতে খুব পছন্দ করে এবং মাংস পরিত্যাগ করে। তাদের বিশ্বাসমতে মাছ এবং গোশত দু’টি একসাথে খেলে তা শরীরের কোনো কাজে লাগে না। অপর দিকে সালাদ ও বাদাম তাদের খাদ্য তালিকায় অবশ্যই থাকবে, বিশেষ করে বাদাম। তারা যেকোনো প্রধান আহারের আগে ফল খাবে। কারণ প্রধান আহারের পরে যদি ফল খাওয়া হয় তবে তা নিদ্রার উদ্রেক করে যা পাঠ গ্রহণের ক্ষেত্রে অন্তরায়।
ইসরাইলে ধূমপান নিষিদ্ধ। কারণ ওই দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীদের মতে, ধূমপান মস্তিষ্কের কোষগুলোকে ধীরে ধীরে ধ্বংস করে দেয় এবং শরীরের জিন এবং ডিএনএকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। ফলে বংশপরম্পরায় ত্রুটিপূর্ণ নিউরনযুক্ত সন্তান জন্মগ্রহণ করবে। উল্লেখ্য, ধূমপানের কারণে বংশপরম্পরায় বোকা এক প্রজন্ম বেড়ে উঠে। সিঙ্গাপুরের সরকারব্যবস্থা অনেকটা ইসরাইলের মতো; ধূমপান সেখানে প্রায় নিষিদ্ধ। সে কারণেই সে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অনেক উচ্চমানের।
প্রত্যেকটি ইহুদি সন্তানেরই সাধারণত হিব্রু, আরবি ও ইংরেজি ভাষার ওপর দখল থাকে। শিশুকাল থেকেই প্রত্যেকটি শিশুকে ভায়োলিন ও পিয়ানো বাজানোর প্রশিক্ষণ দেয়া হয়; কারণ ইহুদি বিজ্ঞানীদের মতে এতে তাদের আইকিউ লেভেলের বৃদ্ধি ঘটে এবং শিশুরা মেধাবী হয়ে বেড়ে ওঠে, কারণ সঙ্গীতের কম্পন মস্তিষ্কের কোষগুলোকে উদ্দীপ্ত করে।
প্রথম থেকে ষষ্ঠ শ্রেণী পর্যন্ত তাদের গণিত ও ব্যবসায়শিক্ষা শেখানো হয়। বিজ্ঞান তাদের এক নম্বর পছন্দের বিষয়। ইহুদি শিশুরা দৌড়, ধনুর্বিদ্যা ও শুটিং ইত্যাদি বিষয়ে পারদর্শী হয়। কারণ তারা মনে করে শুটিং ও ধনুর্বিদ্যা তাদের মস্তিষ্ককে সঠিকভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে সাহায্য করে। উচ্চ মাধ্যমিকে বিজ্ঞান শিক্ষার ওপর বিশেষ জোর প্রদান করা হয়। এ সময় তারা বিভিন্ন জিনিস বানানোর চেষ্টা করে, এর মধ্যে সব ধরনের প্রজেক্ট যেমন যুদ্ধোপকরণ, ওষুধ কিংবা যন্ত্রবিজ্ঞান ইত্যাদি থাকে। যে সব প্রকল্প সফলতা পায় সেগুলো উচ্চ বিদ্যাপীঠগুলোতে পাঠিয়ে দেয় আরো ভালোভাবে গবেষণা করার জন্য।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ বছরে ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়। ব্যবসায় শিক্ষার ছাত্রছাত্রীদের একটি করে প্রজেক্ট দেয়া হয় এবং তারা শুধু পাস করতে পারবে যদি তাদের গ্রুপ সেই প্রজেক্ট থেকে এক মিলিয়ন মার্কিন ডলার লাভ করতে পারে। অবাক হওয়ার কিছুই নেই, এটাই বাস্তবতা। এই কারণে পৃথিবীর অর্ধেকেরও বেশি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ইহুদিদের দখলে।
প্রার্থনা করার সময় সবসময় তারা মাথা ঝাঁকায়। কারণ তারা বিশ্বাস করে এই কার্যকলাপ তাদের মস্তিষ্কে আরো বেশি অক্সিজেন সরবরাহ করে; একই জিনিস ইসলাম ধর্মেও দেখা যায়, তারা নামাজের রাকাতের শেষে সালাম ফিরানোর সময় মাথা ডানে ও বামে ঘুরায়। জাপানিরাও একজন আরেকজনের সাথে দেখা হলে মাথা নামিয়ে সম্মান করে এবং এটা তাদের সংস্কৃতির অংশ। আর জাপানিদের মাঝেও অনেক মেধাবী দেখা যায়। জাপানিরা কাঁচা মাছ খেতে অনেক পছন্দ করে। এই মাথা নাড়ানো ও মাছ খাওয়ার সাথে মেধার সম্পর্ক রয়েছে বলে তারা বিশ্বাস করে।
আমেরিকার নিউ ইয়র্কে ইহুদিদের বাণিজ্যিক কেন্দ্রে তাদের জন্য খাদ্যসামগ্রী সরবরাহ করা হয়। কোনো ইহুদির লাভজনক ব্যবসার আইডিয়া থাকলে সেই বাণিজ্যিক কেন্দ্র থেকে সুদবিহীন মূলধনের ব্যবস্থা করা এবং সেটাকে সফল করতে সব ধরনের সহযোগিতা প্রদান করা হয়। একইভাবে জুইস কোম্পানি স্টারবাক্স, লিভাইস, হলিউড, ওরাকল, কোকাকোলা, ডাংকিন ডোনাটসহ যেসব প্রতিষ্ঠান রয়েছে তাদের ফ্রি স্পন্সরশিপ দেয়া হয়। নিউ ইয়র্কে ডাক্তারি পাস করে যেসব ছাত্রছাত্রী বের হয় তাদেরকে এই বাণিজ্যিক কেন্দ্রের আওতায় নিবন্ধন করে বেসরকারিভাবে প্র্যাকটিস করতে সুদবিহীন লোনের ব্যবস্থা করা হয়।
এ কথা সত্যি যে, মানব সমাজে সংখ্যা দিয়ে ক্ষমতার পরিমাপ করা যায় না। যায় না বলেই একজন নেতা লাখ লাখ লোকদের নেতৃত্ব দেয়। একজন আবিষ্কারক তার আবিষ্কার দিয়ে বিশ্বের বিজ্ঞান, সমাজ, অর্থনীতি নিয়ন্ত্রণ করে। সংখ্যায় কম হলেও কোনো সম্প্রদায় যদি অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, মিডিয়া, সামরিক প্রযুক্তি ইত্যাদিতে শীর্ষে থাকে তাহলে তাদের পক্ষে নিয়ন্ত্রণ দোষের কিছু নয়, যদি নিয়ন্ত্রণ অনৈতিক, অবিচার, অমানবিক, ষড়যন্ত্রমূলক এবং বল প্রয়োগে না হয়। আগেই বলেছি যে, এখনকার ইহুদিরা শিক্ষা-দীক্ষায়, গবেষণায়, প্রযুক্তি আবিষ্কার, অর্থনীতি এবং রাজনৈতিক প্রভাবের দিক দিয়ে অনেক এগিয়ে আছে। এই এগিয়ে থাকার পেছনে মেধার অতিরিক্ত কিছু ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট এবং তার সাথে অনৈতিক প্রচেষ্টা রয়েছে কি না সেটাই আজকের আলোচনার বিষয়বস্তু।
শিক্ষা-দীক্ষায়, অর্থনীতিতে, রাজনৈতিক প্রভাবের ঐতিহাসিক পটভূমি
আগেই বলেছি, বর্তমান বিশ্বের ইহুদিরা শিক্ষা দীক্ষায়, অর্থনীতি, রাজনৈতিক প্রভাবের দিক দিয়ে অনেক এগিয়ে। এর কিছু কারণও রয়েছে। ঐতিহাসিকভাবে বলতে গেলে, রোমান সাম্রাজ্য পতনের সমসাময়িক সময় ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্য, উত্তর আফ্রিকার ইহুদি সম্প্রদায় খ্রিষ্টান ধর্মের অনুসারীদের দ্বারা নির্যাতিত হয়েছে বিভিন্নভাবে। ফলে ষষ্ঠ শতকে আরবে ইসলামী সাম্রাজ্যের আগমনকে তারা স্বাগত জানায়। ওই সময়ে ইসলামের স্বর্ণ যুগের (৭৫০-৯০০ খ্রি:) সূচনালগ্নে বাগদাদ, সমরখন্দ, কর্ডোভা, দামেস্ক, কায়রো প্রভৃতি শহরে যে জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার সংস্কৃতি গড়ে ওঠে তাতে অন্য অমুসলিমদের মতো ইহুদিরাও অংশীদার হয়। অর্থাৎ ইহুদিদের জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার ঐতিহ্য ইসলামের স্বর্ণ যুগ থেকেই শুরু হয়। দ্বাদশ শতকের দিকে মুসলমানরা ক্রুসেডারদের হাতে মধ্যপ্রাচ্যের কিছু কিছু অঞ্চলের ক্ষমতা হারাতে শুরু করে। ঐ সময় মুসলমান ও খ্রিষ্টানদের মধ্যে ব্যবসা বাণিজ্য হতো ইহুদিদের মাধ্যমে। এর মাধ্যমে ইহুদিরা বহু ভাষায় পারদর্শী ও দক্ষ আন্তর্জাতিক ব্যবসায়ী সম্প্রদায় হিসেবে গড়ে ওঠে এবং ফলে ইহুদিরা বিত্তশালী হতে শুরু করে।
মধ্যযুগের পুরো সময়টা জুড়ে (৮০০-১৬৫০ খ্রি: পর্যন্ত) ইউরোপে ইহুদিদের জমির অধিকার দেয়া হতো না। খ্রিষ্টানদের থেকে পৃথক এলাকায় তাদের বসবাস করতে হতো। যেহেতু তাদের জমির অধিকার দেয়া হতো না তাই কৃষিকাজ বা জমি সম্পর্কিত কোনো পেশা গ্রহণ করা তাদের সম্ভব ছিল না। ফলে ইহুদি সম্প্রদায় জীবিকার জন্য আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের পাশাপাশি টারশিয়ারি লেভেলের পেশা-চিকিৎসক, শিক্ষকতা, হিসাবরক্ষণ, মানি চেঞ্জার, আইন ইত্যাদি গ্রহণ করত। এর পাশাপাশি ইহুদিরা ইঞ্জিনিয়ারিং, সঙ্গীত, জ্ঞান-বিজ্ঞানসহ জীবনের প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই অন্যদের থেকে অনেক অনেক এগিয়ে এবং বিশেষ করে ব্যবসার ক্ষেত্রে। প্রসাধনী, খাদ্য, অস্ত্র, ফ্যাশন, ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি ইত্যাদিসহ পৃথিবীর প্রায় ৭০ ভাগ ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান এদের দখলে। ইহুদিদের মধ্যে উচ্চ শিক্ষার হার এ কারণেই বেশি ছিল এবং সে ধারা এখনো বজায় আছে।
যেভাবে বিশ্ব অর্থনীতি ও রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করছে ইহুদি সম্প্রদায়
ইহুদি সমাজে ধনী-গরিব নির্বিশেষে জাতীয়তাবাদী চেতনা অত্যন্ত প্রবল। ফলে ধীরে ধীরে ইহুদি জাতীয়তাবাদের (জায়োনিজম) সৃষ্টি হয় যেখানে আমেরিকার কোটি কোটি ইভাঞ্জেলিক্যাল খ্রিষ্টানেরও সমর্থনও রয়েছে। এই খ্রিষ্টানরা আমেরিকার রাজনীতিতে বড় প্রভাবক এবং এরা শুধু জায়োনিজম আদর্শের কারণেই ইসরাইলকে সমর্থন দেয়।
মধ্যযুগ থেকেই মুসলমান ও ক্যাথলিক সমাজে সুদের ব্যবসা নিষিদ্ধ ছিল। তবে ইহুদি সমাজে তা ছিল না বিধায় ব্যাংক-ব্যবসা ইহুদি সমাজে বিকশিত হয়েছিল। ১৫ শতকে পশ্চিম ইউরোপে ধনতন্ত্র বিকাশের সাথে হাত-ধরাধরি করে ইহুদি ব্যাংক-ব্যবসাও বিকশিত হয় যার ফলে রথসচাইল্ড, ওয়ারবার্গ, জ্যাকব, গোল্ডম্যান ও স্যাকসদের মতো ধনী ইহুদি ব্যাংকিং পরিবার সৃষ্টি হয়েছে। পরে ১৮ শতকে ব্রিটেনে ও আমেরিকায় শিল্প বিপ্লব এদের প্রভাব প্রতিপত্তি আরো বাড়িয়ে দিয়েছিল।
পুঁজিবাদী বিশ্বের বাণিজ্যিকব্যবস্থা অর্থাৎ আমেরিকা-ইউরোপ তথা বিশ্বের অর্থ, অস্ত্র, খনিজ, ড্রাগস, প্রাকৃতিক সম্পদ, খাদ্য, শিল্প-উৎপাদন ও বহুজাতিক বাণিজ্যব্যবস্থার মূল নিয়ন্ত্রক ইহুদিরা। সারা বিশ্বের মোট প্রযুক্তি, উদ্ভাবনী ও গবেষণাধর্মী কর্মকাণ্ডের অর্ধেকের চেয়ে বেশি তাদের নিয়ন্ত্রণাধীন। বলা হয়, আমেরিকা পৃথিবী নিয়ন্ত্রণ করে, আর আমেরিকাকে নিয়ন্ত্রণ করে ইহুদি স¤প্রদায়। আমেরিকার মোট জনসংখ্যার শতকরা ২ ভাগের কম হয়েও ২০ ভাগ বা প্রতি পাঁচজনের একজন আমেরিকান সিনেটর-কংগ্রেসম্যান ইহুদি। তা ছাড়া আমেরিকা প্রশাসনের শুধু প্রেসিডেন্ট পদ ছাড়া অন্য গুরুত্বপূর্ণ বা মূল পদগুলো সবসময়ই তাদেরই দখলে থাকে। সবচেয়ে বড় কথা, আমেরিকার কেন্দ্রীয় ব্যাংক বা সেন্ট্রাল রিজার্ভ সিস্টেমসহ আমেরিকা ও ইউরোপের গুরুত্বপূর্ণ ব্যাংকগুলো, ব্রিটিশ সরকারি ট্রেজারি বন্ডের ৭৫ ভাগের মালিকানা তাদের। তাছাড়া বিশ্বব্যাংক, আইএমএফের অর্থের মূল জোগানদাতা রথসচাইল্ড, রকফেলারসহ অন্য প্রভাবশালী বিত্তবান পরিবারগুলোও ইহুদি সম্প্রদায় থেকে এসেছে।
আমেরিকার রাজনৈতিক ও আর্থসামাজিক ব্যবস্থাপনা নিয়ন্ত্রণ করে মূলত করপোরেট হাউজগুলো। তারা প্রেসিডেন্ট পর্যন্ত বানাতে পারে, সরাতে পারে। এসব করপোরেট হাউজের দিকে তাকালে দেখা যায়, এদের মালিক কিংবা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই কোম্পানিগুলোর মূল দায়িত্বে থাকা প্রধান নির্বাহী হলেন কোনো ইহুদি। এ কমিউনিটি বা সম্প্রদায়কে হাতে রাখতে না পারলে ক্ষমতায় টেকা যাবে না। শুধু এ কারণে তাদের সাথে যোগাযোগ রাখতে ক্ষমতাসীন মার্কিন প্রেসিডেন্টের প্রশাসনের কয়েকজন শীর্ষ কর্মকর্তাকে সার্বক্ষণিক কাজ করে যেতে হয়। ঐক্যবদ্ধ ইহুদি ক্ষমতাধর বিলিয়নিয়াররা মিলিতভাবে যেকোনো সময়, যেকোনো ঘটনা ঘটিয়ে দিতে পারেন। সেটা হতে পারে অর্থে, অস্ত্রে কিংবা মিডিয়ায়। তাদের এ শক্তি সামর্থ্যরে প্রমাণ তারা বহুবার দিয়েছে।
এতসব যোগ্যতার কারণেই ইহুদিরা খুব অহঙ্কারী। সে কারণেই হয়তো সেই ফারাও আমলের মিসর থেকে হিটলারের ইউরোপ আমল পর্যন্ত আড়াই হাজার বছরের বেশি সময়কালে ইহুদিরা তাদের অবিশ্বস্ততা আর ষড়যন্ত্রমূলক কর্মকাণ্ডের জন্য কোথাও স্থিত অবস্থান ধরে রাখতে পারেনি। যাযাবরের মতো একস্থান থেকে অন্যত্র ঘুরে বেড়িয়েছে জীবন বাঁচানোর তাগিদে। কিন্তু আড়াই হাজার বছর ধরে চলা যাযাবর জীবনের মাঝে ইহুদিরা তাদের ঐক্য ধরে রাখার শক্তি ও কৌশল অর্জন করেছে। এমন অনেক ওয়েবসাইট আছে যেগুলো ইহুদি পরিবারগুলোর বংশতালিকা তৈরি করতে সাহায্য করে। কোনো মেধাবী ইহুদি ছাত্র বা ছাত্রীর পড়াশোনার জন্য চিন্তা করতে হয় না। কমিউনিটির কেউ বিপদে পড়লে তারা সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়। তাদের সা¤প্রদায়িক ঐক্য এত অটুট যে, কারো পক্ষে তা আন্দাজও করা সম্ভব নয়।
ক্ষমতা প্রতিষ্ঠিত করতে ইহুদিদের কূটকৌশলের আশ্রয়
ঐক্য ও সমন্বিত পরিকল্পনার মাধ্যমে সংখ্যায় অত্যন্ত কম হওয়ার পরও ক্ষুরধার বুদ্ধি, কৌশল ও মেধার বিকাশ ঘটিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ জায়গাগুলোতে নিজেদের বসিয়েছে, রেখেছে। আর এগিয়ে চলছে তাদের চূড়ান্ত লক্ষ্য, ‘এক বিশ্বব্যবস্থার বাস্তবায়নে। এর জন্য যখন যা করা দরকার তারা করে চলছে। বিশ্বে প্রচলিত সকল ষড়যন্ত্র তত্ত্বের নাটের গুরু হিসেবে তাদেরই নাম ভেসে উঠে। বেশির ভাগ গোপন সঙ্ঘের সাথে জড়িয়ে যায় তাদের নাম। ইলুমিনাতি, ফ্রি-ম্যাসন, স্কাল অ্যান্ড বোনস, বিল্ডার্সবার্গ গ্রুপ ইত্যাদি সব কিছুর সাথেই জড়িয়ে আছে তাদের নাম। ‘অ্যাঞ্জেলস অ্যান্ড ডেমন্স’ ও ‘দ্য ভিঞ্চি কোড’ সিনেমার মাধ্যমে হাল আমলে পুনরায় আলোচনায় আসে এই গুপ্ত সঙ্ঘগুলো। তাছাড়া ‘দ্য প্রটোকলস অব দা এল্ডারলি যায়ন’ নামক পৃথিবীর ক্ষমতা দখলের কুখ্যাত দলিল ইহুদিদের নীলনকশার কথা প্রকাশ করে যা মধ্যপ্রাচ্যসহ সারা বিশ্বে ব্যাপকভাবে পঠিত ও প্রচারিত।
অনেক ষড়যন্ত্র তত্ত্ব মতে, শক্তিমান সিক্রেট সোসাইটি ইলুমিনাতি মূলত এ বিশ্বের সকল প্রধান ঘটনা নিয়ন্ত্রণ করে। যেমন ফ্রেঞ্চ বিপ্লবের সূচনা, নেপোলিয়নের ওয়াটারলু যুদ্ধের ফলাফল নির্ধারণ, আমেরিকান প্রেসিডেন্ট কেনেডির গুপ্তহত্যা, মার্কিন প্রেসিডেন্ট নিক্সনকে পদত্যাগ করতে বাধ্যকরণ, কারো কারো মতে টুইন টাওয়ার হামলা, সম্প্রতি সিরিয়া যুদ্ধ প্রভৃতিতেও তাদের হাত রয়েছে। প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ইন্ধন জোগাতে মূল ভূমিকা পালন করে ইহুদি অস্ত্র ও অর্থলগ্নী ব্যবসায়ীরা।
বলা হয়ে থাকে, হলিউডের ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির মাধ্যমে ইলুমিনাতি আপনার অবচেতন মনে তাদের বিশ্বাসগুলো ঢুকিয়ে দিচ্ছে, কিংবা আপনাকে ব্রেইনওয়াশ করছে, ডিজনি কার্টুনের মাধ্যমে ইলুমিনাতি শিশুমনে ইলুমিনাতির বিশ্বাস ঢুকিয়ে দিচ্ছে। সারা বিশ্বে বিভিন্ন গ্লোবাল অভিজাত ক্লাবের মাধ্যমে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে তাদের এজেন্সি। তথাকথিত গ্লোবালাইজেশনের নামে সারা বিশ্বে প্রতিষ্ঠা করেছে তাদের সাম্রাজ্যবাদী প্রভাববলয়। এ ছাড়াও সারা পৃথিবী নিয়ন্ত্রণকারী বিল্ডার্সবার্গ গ্রুপের ওপর ইলুমিনাতির নিয়ন্ত্রণ প্রশ্নাতীত।
সর্বোপরি ইহুদি সম্প্রদায়ের লক্ষ্য ‘নিউ ওয়ার্ল্ড অর্ডার’; মতান্তরে ‘এক বিশ্ব ব্যবস্থা’ ত্বরান্বিত করার মাধ্যমে সারা বিশ্ব থাকবে ইলুমিনাতির হাতের মুঠোয় যা ১৯৯১ সালে নিউওয়ার্ল্ড অর্ডারের কথা প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ সিনিয়র তার ভাষণে উল্লেখ করলে এ তত্ত্ব তুমুল আলোচনা সৃষ্টি করে। খ্রিষ্টান ও মুসলিম ষড়যন্ত্র তত্ত্বমতে, ইলুমিনাতির প্রতীক এক চোখ প্রমাণ করে যে, ইলুমিনাতি হলো সেই সঙ্ঘ যারা একচোখা দাজ্জালের আগমনের পথ সুগম করছে, যে দাজ্জাল একহাতে পৃথিবী শাসন করবে।
উপসংহারে বলতে হয়, মাত্র দুই সহস্রাংশ (০.২ ভাগ) জনসংখ্যার বিশ্বের ৯ বিলিয়ন লোকদের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করা খুবই অসম্ভব কাজ, যা ইহুদি সম্প্রদায় করে যাচ্ছে কেবল তাদের মেধা, যোগ্যতা বা দক্ষতা দিয়েই নয়; বরং এই সব যোগ্যতার পাশাপাশি তাদের কূটকৌশল, ষড়যন্ত্র ও অনৈতিক কার্যক্রমের মাধ্যমে যুগে যুগে তারা বিশ্বকে নিয়ন্ত্রণ করে যাচ্ছে। মূলত তারা এক বিশ্বব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টার লক্ষ্যে আগাচ্ছে এবং এর জন্য যা কিছু করার করে যাচ্ছে; এর জন্য নীতি-নৈতিকতার কোনো বালাই তাদের নাই। এর সাথে তারাই ‘সর্বশ্রেষ্ঠ সম্প্রদায়’ স্টাইলে আত্মঅহঙ্কার তাদেরকে এই প্রচেষ্টায় উদ্বুদ্ধ করছে। তাদের এই মেধায় আমরা অনুপ্রাণিত, ক্ষমতায় তাজ্জব; তবে তাদের ষড়যন্ত্র, কূটকৌশল এবং অনৈতিক কার্যক্রমে উদ্বুদ্ধ নই।
লেখক : অর্থনীতিবিদ ও গবেষক