রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ১১:২০ অপরাহ্ন

ইসলামে অমুসলিমদের ধর্মীয় স্বাধীনতা

বাংলাদেশ ডেস্ক :
  • আপডেট টাইম : বুধবার, ৫ অক্টোবর, ২০২২
  • ১২৭ বার

ধর্মীয় স্বাধীনতা বলতে আমরা বুঝি, মানুষ স্বীয় ইচ্ছানুযায়ী যেকোনো ধর্ম গ্রহণ করতে পারবে অথবা যেকোনো আকিদাভুক্ত হতে পারবে। অনুরূপভাবে সে কোনো ধর্ম বা আকিদা গ্রহণ না করেও থাকতে পারবে। অর্থাৎ যেকোনো ধর্ম বা আকিদা অবলম্বন করার বা না করার তার পূর্ণ স্বাধীনতা রয়েছে। এতে তাকে কেউ জোর-জবরদস্তি করতে পারবে না। তবে তাকে জান্নাতের আশা ও জাহান্নামের ভয় দেখিয়ে এবং যুক্তিতর্ক দিয়ে ইসলামের সুমহান আদর্শের দিকে আহ্বান করা যাবে।

ইসলাম এক দিকে যেমন মানুষকে কোনো ধর্ম গ্রহণ করা বা না করার স্বাধীনতা দিয়েছে, অন্যদিকে যেকোনো মানুষকে ইসলামের দিকে আহ্বান করারও অধিকার দিয়েছে। কিন্তু জোর-জবরদস্তি করে কাউকে ধর্মে প্রবেশ করানো অবৈধ ঘোষণা করেছে। মদিনার আনসারদের মধ্যে এক ব্যক্তির দুই পুত্র রাসূলুল্লাহ সা:-এর আবির্ভাবের আগে খ্রিষ্টধর্ম গ্রহণ করে। এরপর পুত্রদ্বয় যখন মদিনায় আগমন করে তখন তাদের পিতা তাদেরকে বল প্রয়োগ করে ইসলামে প্রবেশ করাতে চাইলে তারা রাসূলুল্লাহ সা:-এর কাছে অভিযোগ করে। তখন আল্লøাহ তায়ালার পক্ষ থেকে আয়াত নাজিল হয়, ‘দ্বীনের ব্যাপারে কোনো জোর-জবরদস্তি নেই। কেননা ভ্রান্ত মত ও পথ থেকে সঠিক মত ও পথ দিবালোকের মতো উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে।’ (সূরা আল-বাকারাহ-২৫৬)

কেউ কেউ বলেন, ওই আয়াতে কারিমার বিধান পরবর্তীতে নাজিলকৃত কিতালের আয়াতে কারিমা দিয়ে মানসুখ বা রহিত হয়ে গেছে। মূলত কিতাল সংক্রান্ত আয়াতে কারিমা ওই সব লোকের জন্য প্রযোজ্য যারা ইসলামের ক্ষতি সাধন করে। মূল কথা হলো, ইসলামে দীক্ষিত হওয়ার জন্য কোনো প্রকার বাধ্যবাধকতা নেই। তবে ইসলামে দীক্ষিত হওয়ার পর ধর্মকে নিয়ে তালবাহানা করারও কোনো সুযোগ নেই।

আরব পৌত্তলিকদের মহানবী সা:-এর প্রতি চরম নির্যাতন সত্ত্বেও তিনি তাদের সাথে শক্তি প্রদর্শনের কোনো পন্থাই অবলম্বন করেননি। কেননা, তিনি নিজের ও অন্যদের জন্য ধর্মীয় স্বাধীনতাই চেয়েছিলেন। যেমন আল্লাহ রাব্বুল আলামিন নবী করিম সা:-কে নির্দেশ দিয়ে বলেন, ‘হে নবী! আপনি মুশরিকদের বলে দিন, তোমাদের জন্য তোমাদের ধর্ম ও আমাদের জন্য আমাদের ধর্ম।’ (সূরা আল-কাফিরুন-৭) অন্য আয়াতে বলা হয়েছে, ‘হে নবী! আপনি পরিষ্কার বলে দিন, এ হচ্ছে সত্য তোমাদের রবের পক্ষ থেকে, এখন যে চায় সে তা গ্রহণ করুক এবং যে চায় অস্বীকার করুক। আমি (অস্বীকারকারী) জালিমদের জন্য জাহান্নাম অবধারিত রেখেছি।’ (সূরা আল-কাহফ-২৯) এ সব আয়াত থেকে পরিষ্কার বুঝা যায়, ঈমান গ্রহণ বা কুফরি করা মানুষের ইচ্ছার ওপর ছেড়ে দেয়া হয়েছে। অবশ্য মানুষের এ ইচ্ছা মহান আল্লাহর রহমতের ওপর নির্ভরশীল। কেননা, আল্লাহ তায়ালা সব বিষয় ও বস্তুর সৃষ্টিকর্তা। মানুষ তার কৃতকর্মের কারণেই পাপ-পুণ্যের অধিকারী হবে। এ ক্ষেত্রে বল প্রয়োগ করে ইসলাম গ্রহণে বাধ্য করার কোনো সুযোগ নেই। কারণ যে ধর্ম সত্য, তাতে দলভুক্ত করতে জোর-জবরদস্তি করতে হয় না। ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশের মাধ্যমেই অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের মন জয় করতে পারে।

মুসলমানদের ধর্ম ও জীবন ব্যবস্থার সাথে অন্যদের জীবন ব্যবস্থার কোনোই সামঞ্জস্য নেই। যেহেতু এতদুভয়ের মধ্যে বিস্তর প্রভেদ রয়েছে, তাই এদের সমঝোতা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। তাই ধর্মের প্রচার ও প্রসারতার জন্য জবরদস্তিও কোনো প্রয়োজন নেই। ধর্ম গ্রহণ ও বর্জনের ব্যাপারে ইসলামে পূর্ণ স্বাধীনতা দেয়া হয়েছে। এ মর্মে রাসূলে করিম সা:-কে উদ্দেশ্য করে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন ইরশাদ করেন, ‘হে নবী! আপনি উপদেশ দিন, আপনি তো কেবল একজন উপদেশদাতা, আপনি তাদের শাসক নন।’ (সূরা আল-গাশিয়াহ : ২১-২২)

বাকস্বাধীনতা ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা যেমন মানুষের মর্যাদার জন্য অপরিহার্য, তেমনি তা কোনো আদর্শ প্রচারের জন্যও অপরিহার্য। ইসলামের মতো একটি জীবনাদর্শের পক্ষে বাকস্বাধীনতা ও মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে অস্বীকার করা সম্ভব নয়। বস্তুত ইসলাম এই নীতিকে এমন দৃঢ়ভাবে সমর্থন করে, যা পৃথিবীতে অন্য কোনো মতাদর্শে বা ধর্মে দেখা যায় না। ইসলাম ধর্মের প্রচার ও প্রসারের জন্য শক্তি প্রয়োগের কোনো অনুমতি দেয়া হয়নি। ইসলাম এ ধরনের কার্যক্রমকে আদৌ সমর্থন করে না; বরং পবিত্র কুরআনুল কারিমে ইরশাদ হয়েছে, ‘আপনি পালনকর্তার পথের প্রতি আহ্বান করুন জ্ঞানের কথা বুঝিয়ে ও উত্তম উপদেশ শুনিয়ে এবং তাদের সাথে বিতর্ক করুন পছন্দনীয় পন্থায়।’ (সূরা আন-নাহল-১২৫) আবার অন্য আয়াতে বলা হয়েছে, ‘মন্দের জবাবে তাই বলুন, যা উত্তম।’ (সূরা আল-মুমিনুন-৯৬)

ইসলাম অমুসলিমদের ধর্মীয় উৎসব ও পর্বগুলো পালনের সম্পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়েছে। অবশ্য এটি রাষ্ট্রীয় আইন-কানুনের সীমার মধ্যে হতে হবে। এ ছাড়া মুসলিম রাষ্ট্রে বসবাসরত অমুসলিমদের সব প্রকার লেনদেন ও কাজ-কারবারের স্বাধীনতা দেয়া হয়েছে। সুতরাং অমুসলিমদের কোনো ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানে বাধা দেয়া যাবে না।

অমুসলিমদের ওপর ইসলামের বদান্যতার উদাহরণের মাধ্যমে সহজেই বুঝা যায়, যদি কোনো মুসলমানের স্ত্রী খ্রিষ্টান বা ইহুদি হয়, তবে মুসলমান স্বামী ওই স্ত্রীকে তাদের গির্জায় যেতে নিষেধ করতে পারবে না; বরং বিনা দ্বিধায় তাকে তার ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদি পালনে স্বাধীনতা দিতে হবে।

এ ছাড়া মুসলমানদের খ্রিষ্টান ও ইহুদিদের শূকর বধ নিষিদ্ধ করা হয়েছে এবং তাদের মদের পাত্রও ভেঙে ফেলতে নিষেধ করা হয়েছে। কেননা, তারা শূকরের মাংস ভক্ষণ ও মদ্যপানে অভ্যস্ত। অনুরূপভাবে ইসলাম অমুসলিমদের তাদের ব্যক্তিগত ক্রিয়া-কর্ম পালনে সম্পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়েছে। যেমন তাদের বৈবাহিক বন্ধন, তালাক, উত্তরাধিকার আইন ইত্যাদি।

ইসলামে অমুসলিমদের ধর্মীয় স্বাধীনতার ব্যাপারে নিম্নোক্ত ঘটনাটি অতি চমকপ্রদ- একদা নজরান গোত্রীয় খ্রিষ্টানদের একদল দূত রাসূলে করিম সা:-এর কাছে আগমন করে। তারা আসরের নামাজের পর মসজিদে নববীতে প্রবেশ করে। তখন তাদের উপাসনার সময় উপস্থিত হয়। তারা উপাসনার জন্য দণ্ডায়মান হলে কিছু মুসলমান তাদের বাধা দেয়ার চেষ্টা করলে রাসূলে করিম সা: তাদের নিষেধ করলেন এবং বললেন, ‘তাদেরকে তাদের উপাসনা করতে দাও’। এরপর তারা পূর্বমুখী হয়ে তাদের উপাসনা সম্পন্ন করল।

ইসলামে মানব জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে স্বাধীনতার প্রতিফলন দেখা যায়। ইসলামী রাষ্ট্রে অমুসলিমরা সুন্দরভাবে তাদের ধর্মীয় স্বাধীনতা ভোগ করে আসছে। মুসলমানরা যখনই কোনো দেশ জয় করতেন, তখন অমুসলিমদের তাদের ধর্ম স্বাধীনভাবে পালন করার সুবন্দোবস্ত করে দিতেন। মুসলমানরা অমুসলিম বিজয়ীদের মতো পরাজিতদের জোরপূর্বক তাদের ধর্মে দীক্ষিত করার চেষ্টা কখনো করেননি। ইতিহাসে এর বহু প্রমাণ পাওয়া যায়। হিন্দুস্তানে সর্বদাই অমুসলিমদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা রয়েছে। তবুও মুসলমানরা আট শ’ বছর হিন্দুস্তান শাসন করেছেন। অন্য দিকে, স্পেনে মুসলমানদের সংখ্যা ছিল প্রায় ৩০ লাখ। কিন্তু অমুসলিমদের হাতে স্পেনের শাসনভার চলে যাওয়ার পর এখন সেখানে মুসলমান নেই বললেই চলে।

মহাবীর সালাহউদ্দিন আইয়ুবির সময় বায়তুল মাকদাস জয়ী হওয়ার পর তিনি খ্রিষ্টানদের সাধারণ ক্ষমা করেছিলেন। এভাবে মুসলমান কর্তৃক বিজিত দেশগুলোর অমুসলিমদের সাথে মুসলমানদের সন্ধির চুক্তিনামা পড়লেই সহজে মুসলমানদের বদান্যতা ও পরমতসহিষ্ণুতার প্রমাণ পাওয়া যায়। তাদের এ বদান্যতা ও সহনশীলতা দিয়েই ইসলামের এত বিস্তৃতি লাভ ঘটেছে।

সুতরাং ইসলামের শিক্ষা অনুযায়ী জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সব ধর্ম ও সম্প্রদায়ের অনুসারীরা নিজ নিজ ধর্ম স্বাধীনভাবে অনুসরণের মাধ্যমে দেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতির জন্য কাজ করলে শান্তি ও সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠিত হবে এ কথা স্পষ্ট করে বলা যায়।

লেখক : আলেম, প্রাবন্ধিক ও কলেজ শিক্ষক

নিউজটি শেয়ার করুন..

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো খবর..
© All rights reserved © 2019 bangladeshdailyonline.com
Theme Dwonload From ThemesBazar.Com