বিশ্বনবী সা: ছিলেন ইনসানে কামিল বা পরিপূর্ণ একজন মহামনীষী। তিনি ছিলেন উন্নত চরিত্রের অধিকারী ও সব সুকৃতির আধার। সততা, ন্যায়পরায়ণতা, মানবিকতাসহ সব সৎগুণের সমবেশ ছিল তাঁর মহান চরিত্রে। তিনি ছিলেন জীবনের সর্বক্ষেত্রে সফল ও সার্থক। পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবন সবক্ষেত্রে তিনি সফলতার অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। তাঁর চারিত্রিক সৌন্দর্য ও দৈহিক সৌন্দর্যের মধ্যে এক অসাধারণ মিল রয়েছে। সাহাবি হজরত আনাস রা: বলেন, ‘রাসূলুল্লাহ সা: ছিলেন সর্বাধিক সুন্দর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের অধিকারী।’ তাঁর সুমহান চরিত্রের প্রশংসা করে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘হে নবী! নিশ্চয় আপনি মহান চরিত্রের ওপর প্রতিষ্ঠিত’ (আল কুরআন, সূরা কলম-৪)।
তিনি ছিলেন এক দিকে আল্লাহর সবশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ নবী, অপর দিকে ছিলেন একজন রাষ্ট্রনায়ক। তবুও তিনি ছিলেন বিনয়ী ও নিরহঙ্কার। তাঁর লজ্জা ও আত্মসম্মানবোধ ছিল প্রবল। তাঁর মুখে সদা হাসি লেগে থাকত। তিনি সবার সাথে খুব সহজে মিশে যেতেন। জীবনে কখনো মিথ্যা বলেননি। কাউকে কষ্ট দেননি। কখনো কারো বদনাম করেননি। কারো গিবত করেননি। তিনি কারো কাছ থেকে প্রতিশোধ গ্রহণ করতেন না। তিনি মানুষের কল্যাণ কামনা করতেন। সর্বদা অনাথ, অসহায়, অসুস্থ ও নির্যাতিত মানুষের পাশে থাকতেন। তাদের উপকার করতেন। অভুক্ত মানুষের মুখে হাসিমুখে নিজের খাবার তুলে দিতেন।
তিনি অসুস্থ ব্যক্তিদের দেখতে যেতেন। সবার দাওয়াত গ্রহণ করতেন। জানাজায় হাজির হতেন। তিনি মজলিসের মধ্যে বিশেষ আসনে বসতেন না। ভ্রমণের সময়ও তিনি সাদামাটাভাবে সাধারণ মানুষের মতো চলতেন। তাঁর সামনে সম্মান দেখিয়ে কেউ দাঁড়াক, সেটি তিনি চাইতেন না। তিনি মাটিতে বসতেন ও মাটিতে বসে খাবার খেতে পছন্দ করতেন। তাঁর হাসিতে যেন মুক্তা ঝরত। কিন্তু তিনি কেবলই মুচকি হাসতেন। কখনো অট্টহাসিতে মেতে উঠতেন না। অধিকারের ব্যাপারে তাঁর কাছে আত্মীয়, অনাত্মীয়, দুর্বল, সবল সবাই সমান ছিল। তিনি গুরুত্ব দিয়ে বলেছেন, তাকওয়া ছাড়া আল্লাহর কাছে কেউ কারো চেয়ে শ্রেয় নয়। সব মানুষ সমান ও সমকক্ষ। তিনি কখনো কোনো খাবারের দোষ বর্ণনা করেননি। রুচিসম্মত হলে আহার করতেন, তা না হলে সযতেœ ত্যাগ করতেন; কিন্তু কোনো অভিযোগ করতেন না। কোনো কোনো সময় এক মাস-দুই মাস পর্যন্ত তাঁর বাড়িতে আগুন জ্বানানো হয়নি। তিনি ও তাঁর পরিবার শুধু খেজুর ও পানি আহার করেছেন। তবুও তিনি নিরাশ বা হতাশ হননি বা সত্য পথ থেকে এক বিন্দুও বিচ্যুত হননি। নিজ কাজ নিজে করতেন, ঘরের কাজে তাঁর পরিবারবর্গের সহযোগিতা করতেন। তিনি ছিলেন নির্ভীক ও সাহসী। তিনি ছিলেন সর্বাপেক্ষা ধৈর্যশীল। কোনো রাজা বা শাসককে তাঁর রাজত্ব, যশ ও খ্যাতির কারণে ভয় করতেন না।
তাঁর কোনো পাপ না থাকা সত্ত্বেও তিনি রাত জেগে ইবাদত করতেন। আল্লাহর ভয়ে তাঁর হৃদয় বারবার কেঁদে উঠত। নামাজ পড়তে পড়তে তাঁর পদযুগল ফুলে যেত। তাঁকে এ ব্যাপারে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলতেন- ‘আমি কী আল্লাহর কৃতজ্ঞ বান্দা হবো না?’ তিনি আল্লাহর দরবারে বারবার তওবা-ইস্তিগফার করতেন। এমনকি প্রতিদিন তিনি আল্লাহর কাছে ৭০ বারেরও অধিক ক্ষমা প্রার্থনা করতেন। সুগন্ধি ভালোবাসতেন। দুর্গন্ধ অপছন্দ করতেন। আল্লাহপাক তাঁর মধ্যে চারিত্রিক উৎকর্ষ ও সুন্দর কর্মের অনুপম সন্নিবেশ ঘটিয়েছিলেন। প্রথাগত দিক থেকে তিনি ছিলেন নিরক্ষর। লেখাপড়া জানতেন না। মানুষের মধ্যে কেউ তাঁর শিক্ষকও ছিল না। অথচ তিনি ছিলেন বিশ্বমানবতার মহান শিক্ষক। তাঁর ওপর অবতীর্ণ হয়েছে আল্লাহর সর্বশেষ কালাম মহাগ্রন্থ আল কুরআন। যে কুরআন সম্পর্কে স্বয়ং আল্লাহ পাক বলেন, ‘তিবইয়ানান লিকুল্লিø শাই’। অর্থাৎ- সব কিছুর বিবরণ সংবলিত এক মহাগ্রন্থ। আল্লাহ পাক তাঁকে এমন জ্ঞান ও হিকমত দান করেছিলেন, যা পূর্ববর্তী ও পরবর্তী অন্য কাউকে দান করা হয়নি।
মহানবী হজরত মুহাম্মদ সা: ছিলেন মানবতার মহান বন্ধু। তিনি ছিলেন মানবদরদী নবী। মানুষের কল্যাণের চিন্তায় তিনি সর্বদা ব্যাকুল থাকতেন। সমাজের প্রভাবশালীদের হাতে জুলুম-নির্যাতনের শিকার হয়ে যারা অসহায় জীবন যাপন করত, নবীজী তাদের পাশে গিয়ে দাঁড়াতেন।
তিনি বাড়ি বাড়ি গিয়ে মানুষের সুখ-দুঃখের খোঁজখবর নিতেন। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের পর মসজিদে সাহাবিদের দিকে ঘুরে বসে সবার খোঁজখবর নিতেন, কুশলাদি জিজ্ঞেস করতেন, কারো অসুবিধা থাকলে তা দূর করার চেষ্টা করতেন। নবীজী সব সময় রোগীর সেবা করতেন। অসুস্থ রোগী বিধর্মী বা ভীষণ শত্রু হলেও তার সেবা করতে দ্বিধাবোধ করতেন না। সব মুসলমান একটি মানবদেহের মতো। দেহের যেকোনো স্থানে আঘাত লাগলে যেমন পুরো শরীরে ব্যথা অনুভূত হয়, তেমনি একজন মুসলমানের দুঃখে সব মুসলমান দুঃখিত হবে ও তাকে সাহায্য করে দুঃখ মোচন করবে। এ মর্মে রাসূলুল্লাহ সা: ইরশাদ করেছেন, ‘মুমিনগণও একটি মানবদেহের মতো, চক্ষু পীড়িত হলে যেমন পুরো দেহ পীড়িত হয়, মস্তিষ্ক পীড়িত হলে যেমন সারা দেহ পীড়িত হয়, অর্থাৎ একজন মুমিন বিপদে পড়লে সবাই তার বিপদে এগিয়ে আসবে ও তাকে বিপদ থেকে উদ্ধার করবে। যে ব্যক্তি অপর ব্যক্তিকে সাহায্য করে ও জনকল্যাণে এগিয়ে আসে, আল্লাহ তাকে সাহায্য করে থাকেন। আর যে ব্যক্তি এতিম ও অসহায় লোকদের সাহায্য করে না, প্রকৃতপক্ষে সে ঈমানদার নয়।’
হজরত জাবের রা: বলেন, রুগ্ণাবস্থায় আমাকে দেখার জন্য রাসূলুল্লাহ সা: ও হজরত আবু বকর রা: আগমন করেন। আমি তখন বনি সালাময় ছিলাম এবং এত বেশি রুগ্ণ ছিলাম যে, কাউকে চিনতে পর্যন্ত পারতাম না। রাসূলুল্লাহ সা: পানি আনিয়ে অজু করলেন এবং কিছু পানি আমার ওপর ছিটিয়ে দিলেন। আমি সুস্থ বোধ করলাম (বুখারি ও মুসলিম)।
সর্বপ্রথম ইসলাম গ্রহণকারী অসহায় মুসলমানদের পক্ষে দাঁড়ানোর মতো কোনো বন্ধু-স্বজন ছিল না। ফলে অসহায় দুর্বল পেয়ে কোরাইশরা তাদের ওপর চাপিয়ে দিত নির্যাতনের পাহাড়। বিলালের সামাজিক অবস্থানের কারণে তার ওপর অবর্ণনীয় দুঃখ-কষ্ট নেমে আসে। একদিন মুশরিকরা যখন ‘আম্মার ও তাঁর পরিবারবর্গকে শাস্তি দিচ্ছিল তখন সেই পথ দিয়ে রাসূলুল্লাহ সা: যাচ্ছিলেন। তিনি তাঁদের অবস্থা দেখে বলেন, ‘হে ইয়াসিরের পরিবার-পরিজন! তোমাদের জন্য সুসংবাদ। তোমাদের জন্য রয়েছে জান্নাতের প্রতিশ্রুতি। আম্মারের মাকে তারা প্রাণে মেরে ফেলেছিল। শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তিনি ইসলাম ব্যতীত অন্য সব কিছু প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। রাসূলুল্লাহ সা: এমন বিপদের দিনে তাদের পাশে থেকে তাদের সাহায্য-সহযোগিতা করেছেন।
শত্রুর প্রতিও বিশ্বনবীর দয়া ও ভালোবাসা ছিল অসীম। আরেকদিন মহানবী সা: দেখেতে পেলেন, এক বুড়ি তার মালামাল পুঁটলি বেঁধে নিয়ে মক্কা ছেড়ে চলে যাচ্ছে; কিন্তু বয়সের কারণে পুঁটলি বহন করা তার পক্ষে কষ্ট হচ্ছিল। এ অবস্থা দেখে নবীজী তার কাছে এসে তাকে জিজ্ঞেস করেন, মা তুমি কোথায় যাচ্ছ? বুড়ি বলল, অমুক জায়গায় আমার আত্মীয়ের বাড়িতে যাচ্ছি। নবীজী তাকে জিজ্ঞেস করলেন- কেন যাচ্ছ? এ প্রশ্নের জবাবে বৃদ্ধা বলল, শুনেছি মুহাম্মদ নামে এক ব্যক্তি আমাদের বাপ-দাদার ধর্মের বিরুদ্ধে এক নতুন ধর্ম প্রচার করছে। তাই জীবন ও ধর্ম রক্ষার জন্য মক্কা ছেড়ে চলে যাচ্ছি। এ কথা শুনে নবীজী কোনো মন্তব্য করলেন না। তিনি দেরি না করে বৃদ্ধার বোঝাটি নিজের কাঁধে তুলে নিয়ে বললেন, মা তুমি আমার সাথে চলো- তোমাকে বাড়ি পৌঁছে দেবো। বৃদ্ধাকে তার আত্মীয়ের বাড়ি দিয়ে নবীজী সা: বললেন, তুমি এখানে থাকো, আমি যাচ্ছি। বৃদ্ধা বলল, বাবা তুমি কে? আমার জন্য এত কষ্ট করেছ? মানবতার মহান বন্ধু বিশ্বনবী সা: বললেন, আমার নাম মুহাম্মদ। আপনি যার কথা শুনেছেন আমিই সেই মুহাম্মদ। আমিই ইসলামের কথা বলে থাকি এবং এক আল্লাহর ইবাদতের কথা প্রচার করে থাকি। এ কথা শুনে বুড়ি বিস্মিত হলো। এরপর বুড়ি বলল, যদি এটিই হয় ইসলাম, তাহলে আমি সে ধর্ম গ্রহণ করলাম। আমি ঘোষণা দিচ্ছি- আল্লাহ ছাড়া কোনো প্রভু নেই, আপনি তাঁর সত্য রাসূল। এ বলে তিনি রাসূলুল্লাহ সা:-এর কাছে কালেমা পাঠ করে ইসলামের সুশীতল ছায়ার নিচে আশ্রয় গ্রহণ করলেন।
একবার মসজিদে নববীতে নবী সা:-এর উপস্থিতিতে মসজিদে জনৈক অমুসলিম ব্যক্তি প্রস্র্রাব করে দিয়েছিল। উপস্থিত সাহাবিরা যখন এর সমুচিত জবাব দিতে প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন, তখন দয়ার নবী তাদের থামিয়ে দিলেন। লোকটি যখন চলে যাচ্ছিল, তখন নবীজী তাকে বুঝিয়ে বললেন- দেখো ভাই, এটি আমাদের মসজিদ, খুবই পরিচ্ছন্ন ও পবিত্র স্থান। এখানে ময়লা হলে আমাদের কষ্ট লাগে। লোকটি তার ভুল বুঝতে পারে ও লজ্জিত হয়। সে বুঝতে পারে যিনি তাকে ক্ষমা করে দিয়েছেন, তিনি কোনো সাধারণ মানুষ নন, নিশ্চয়ই তিনি আল্লাহর নবী।
মক্কার জীবনে তিনি যখন লোকদের আল্লাহর পথে আহ্বান করলেন, তখন শত্রুর পক্ষ থেকে তাঁর ওপর ইট-পাথরের বৃষ্টি বর্ষিত হয়েছে, আঘাতে আঘাতে শরীর মোবারক রক্তাক্ত হয়েছে, তবুও তিনি আল্লাহর দরবারে এ প্রার্থনা করেছেন, ‘হে আল্লাহ! তুমি আমার কওমকে হেদায়েত দাও। তারা আমাকে বুঝতে পারেনি।’
পরিখার যুদ্ধ ইসলামের ইতিহাসের একটি বিখ্যাত যুদ্ধ। কুরাইশরা মদিনা আক্রমণের উদ্দেশ্যে এ যুদ্ধের সূচনা করেছিল। মহানবী সা: এ যুদ্ধের সংবাদ পেয়ে সাহাবিদের সাথে পরামর্শ করলেন। সাহাবিদের মধ্যে হজরত সালমান ফারসি রা: নামে একজন বুদ্ধিমান সাহাবি ছিলেন। তিনি মদিনার চতুর্দিকে পরিখা বা খাল খননের পরামর্শ দেন। যাতে কুরাইশ বাহিনী পরিখা অতিক্রম করে মদিনা আক্রমণ করতে না পারে। বিশ্বনবী সা: ছিলেন মুসলিম বাহিনীর প্রধান। তিনি প্রধান হিসেবে কাজ না করে বসে থাকতে পারতেন; কিন্তু তিনি বসে না থেকে সবার সাথে পরিখা খননের কাজ করেন। প্রথমে তিনিই নিজ হাতে কোদাল চালিয়ে খননকাজ শুরু করেন এবং শেষ পর্যন্ত কাজ চালিয়ে যান। এ সময় তিনি ছন্দে ছন্দে আল্লাহর প্রশংসা করেন ও তাঁর কৃজ্ঞতা প্রকাশ করেন।