ঋণের সুদহার ৯ শতাংশ বাস্তবায়নের দুই মাস আগেই বাস্তবায়ন হচ্ছে আমানতের ৬ শতাংশ সুদহার। অর্থাৎ আগামী ১ ফেব্রুয়ারি থেকেই আমানতের সুদহার ৬ শতাংশে নামিয়ে আনা হচ্ছে। আমানতকারীদের বঞ্চিত করে সুদহার কমানো হলে ব্যাংকগুলো দীর্ঘমেয়াদে আমানতের সঙ্কটে পড়ে যাবে দেশের ব্যাংক খাত। আর এ কারণে বিনিয়োগযোগ্য তহবিলের সঙ্কটেও পড়বে প্রতিষ্ঠানগুলো। ছয়-নয় সুদহার বাস্তবায়ন নিয়ে এমনই মন্তব্য করেছেন অর্থনীতিবিদ ও ব্যাংক বিশ্লেষকরা।
বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম এ বিষয়ে গতকাল নয়া দিগন্তকে জানিয়েছেন, প্রথম কথা হলো এ ছয়-নয় বাস্তবায়ন যোগ্য নয়। জোরজবরদস্তি করে বাস্তবায়ন করা হলে ব্যাংকগুলো দীর্ঘমেয়াদে তহবিল সঙ্কটের মুখে পড়ে যাবে।
তিনি এ বিষয়ে ব্যাখ্যা করে বলেন, আমানতের সুদহার ৬ শতাংশ হলে আমানতকারীরা ব্যাংকে আমানত রাখবেন না। শুধু মূল্যস্ফীতির হিসাবে নিলেও আমানতের সুদহার ৬ শতাংশ বাস্তবায়নযোগ্য হবে না। কারণ, সরকারি হিসাবেই মূল্যস্ফীতি সাড়ে ৫ শতাংশ। আর আমানতের সুদহার ৬ শতাংশ হলে বছর শেষে ১০০ টাকা আমানত রাখলে একজন আমানতকারী বছর শেষে পাবেন ১০৬ টাকা; কিন্তু মূল্যস্ফীতি সাড়ে ৫ শতাংশ বাদ দিলে ১০৬ টাকায় থাকে ১০০ টাকা ৫০ পয়সা। এভাবে কেউ ১০ বছরের হিসাবে আমানত রাখলে নির্ধারিত মেয়াদ শেষে মূলধনের বড় একটি অংশই খোয়া যাবে। এটা জোর করে বাস্তবায়ন করা হলে সাধারণ আমানতকারীরা ব্যাংক আমানত রাখবেন না।
তার মতে, এতে দুই ধরনের সমস্যা হবে, আমানত কমে বিনিয়োগযোগ্য তহবিলের সঙ্কটে পড়ে যাবে ব্যাংকগুলো। অপর দিকে, সাধারণ আমানতকারীরা ব্যাংকে আমানত না রেখে ঝুঁকিপূর্ণ খাতে আমানত রাখলে পুরো তহবিলই ঝুঁকির মুখে পড়ে যাবে। তিনি জানান, এমনিতেই দীর্ঘ দিন ধরে ব্যাংকে আমানত প্রবৃদ্ধি কমে যাচ্ছে। এর ওপর আমানতের সুদহার ৬ শতাংশ বাস্তবায়ন হলে আমানতপ্রবাহ আরো কমে যাবে। আর আমানত কমে গেলে এক দিকে ঋণ আমানতের অনুপাতের (এডি রেশিও) কারণে ব্যাংকগুলো নতুন করে ঋণ দিতে পারবে না, অপর দিকে দীর্ঘমেয়াদে তহবিল সঙ্কটে পড়ে যাবে ব্যাংকগুলো। ফলে ঋণ দেয়ার মতোই তহবিল ব্যাংকগুলোর হাতে থাকবে না।
ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, সরকারি ব্যাংক বাদে বেশির ভাগ ব্যাংকই বর্তমানে তহবিল সঙ্কটে ভুগছে। বিশেষ করে নতুন ব্যাংকগুলোতে এ সঙ্কট প্রকট আকার ধারণ করেছে। এ কারণে বেশি সুদে আমানত সংগ্রহে একধরনের প্রতিযোগিতা আছে। এ সময়ে আমানতের সুদহার ৬ শতাংশ নির্ধারণ করা হলে নতুন ব্যাংকসহ অপেক্ষাকৃত দুর্বল ব্যাংকগুলোর জন্য তহবিল সঙ্কট ভয়াবহ রূপ নেবে। কারণ, তখন যারা ব্যাংকে আমানত রাখবেন তারা অর্থনৈতিক ভিত্তি শক্তিশালী এমন ব্যাংকগুলোই বেছে নেবেন। ফলে দেশের ব্যাংকিং খাতে অসম প্রতিযোগিতা শুরু হবে। এমনিতেই এক শ্রেণীর ব্যাংকে তহবিল সঙ্কট ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। তারা প্রতিদিনই বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে রেপো ও বিশেষ তহবিল সুবিধার আওতায় টাকা ধার নিচ্ছে। যেমন গতকাল বুধবারও ১১টি ব্যাংক বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে তিন হাজার ৪১ কোটি টাকা ধার নিয়েছে। এর মধ্যে বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকই ১০টি।
এমনি পরিস্থিতিতে ৬ শতাংশ সুদহার বাস্তবায়ন হলে ব্যাংকগুলোর আমানত সঙ্কট আরো বেড়ে যাবে। বিষয়টি নিয়ে নীতিনির্ধারকদের আমলে নেয়ার অনুরোধ জানিয়েছেন ব্যাংকাররা।
প্রসঙ্গত, আগামী ১ এপ্রিল থেকে ছয়-নয় বাস্তবায়নের নির্দেশনা রয়েছে; কিন্তু দুই মাস আগে থেকেই অর্থাৎ ১ ফেব্রুয়ারি থেকেই আমানতের সুদহার ৬ শতাংশ বাস্তবায়ন করার ঘোষণা দিয়েছে ব্যাংকারদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশ। এ বিষয়ে এবিবি সভাপতি ও ইস্টার্ন ব্যাংকের প্রধান নির্বাহী আলী রেজা ইফতেখার মঙ্গলবার রাতে নয়া দিগন্তকে জানিয়েছিলেন, ৬-৯ তাদের বাস্তবায়ন করতে হবে। এরই প্রস্তুতি হিসেবে বৈঠক করা হয়। বৈঠকে আগামী ১ এপ্রিল থেকে ঋণের সুদহার ৯ শতাংশ বাস্তবায়নের প্রস্তুতি হিসেবেই আমানতের সুদহার ১ ফেব্রুয়ারি থেকে ৬ শতাংশ কার্যকর করা হবে।