বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের জন্ম রাজনৈতিক পরিবারে। পিতা দলের প্রতিষ্ঠাতা ও সফল রাষ্ট্রনায়ক শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান বীর উত্তম। মা হলেন বিএনপি’র চেয়ারপার্সন ও তিনবারের প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া। তাই জন্ম সূত্রেই তিনি বিরলভাগ্যের অধিকারী। যেদিন থেকে বুঝতে শিখেছেন, সেদিন থেকেই প্রতিষ্ঠানিক শিক্ষার পাশাপাশি রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড কিভাবে পরিচালিত হয়েছে, তা তিনি প্রত্যক্ষ করার সুযোগ পেয়েছেন।
বহু প্রতিভার অধিকারী পিতা জিয়াউর রহমান কিভাবে চড়াই-উতরাই মোকাবেলা করে দেশকে সামগ্রিকভাবে বিপর্যস্ত একটি অবস্থা থেকে সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে নিয়ে গেছেন- তাও তিনি প্রত্যক্ষ করেছেন। মা খালেদা জিয়া হলেন তার দ্বিতীয় গুরুপূর্ণ রাজনৈতিক শিক্ষাগুরু। রাষ্ট্রনায়ক জিয়াউর রহমানের শাহাদাত বরণের মাত্র ১০ মাসের মধ্যেই স্বৈরাচারী এরশাদ নির্বাচিত প্রেসিডেন্টকে সরিয়ে দীর্ঘ সময়ের জন্য রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেন। তখন বিএনপির খুব দুঃসময়। হাল ধরলেন বেগম খালেদা জিয়া। তারেক রহমান প্রত্যক্ষ করেছেন, রাজনীতিতে নবাগত তার জন্মদাত্রী মা কিভাবে নানা ষড়যন্ত্রের মোকাবেলা করে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলকে সুসংগঠিত করেছেন। রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন নির্যাতনের বিরুদ্ধে জনগণের পক্ষের শক্তি তথা রাজনৈতিক দল হিসেবে কিভাবে বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করতে হয় এবং অপশক্তির বিরুদ্ধে গঠনমূলক ও আপসহীন লড়াই করে কিভাবে বিজয় ছিনিয়ে আনতে হয়, তাও প্রত্যক্ষ করেছেন। স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে বেগম খালেদা জিয়া বিজয়ী হবার পাশাপাশি আপসহীন নেত্রী হিসাবে নন্দিত হয়ে ছিলেন কী কারণে, তার সেটিও প্রত্যক্ষ করার সৌভাগ্য হয়েছে। প্রত্যক্ষ করেছেন, শহীদ জিয়ার সবুজ বিপ্লবের কর্মমুখী রাষ্ট্রদর্শন কিভাবে বেগম খালেদা জিয়ার হাত ধরে সাফল্যের প্রত্যাশিত লক্ষ্য অর্জনে সক্ষম হয়েছে।
বিরলভাগ্যের অধিকারী তারেক রহমানের ভাগ্য বিড়ম্বনার ইতিহাসও লোমহর্ষক। তার জীবন যেন ‘জন্ম থেকেই জ্বলছে!’ স্বাধীনতার ঘোষক শহীদ প্রসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের সন্তান হিসেবে সীমাহীন অনিশ্চয়তা মধ্যে শৈশব কেটেছে। ঐতিহাসিক স্বাধীনতার ঘোষণার পর মেজর জিয়া তারেক রহমানসহ পরিবারের অন্য সদস্যদের চট্টগ্রামে অরক্ষিত অবস্থায় রেখে স্বাধীনতা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। শুরুতে কিছু দিন মা খালেদা জিয়ার চাচার বাসায় আত্মগোপনে থাকার পর জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ছদ্মবেশে নৌপথে নারায়ণগঞ্জ হয়ে ঢাকায় আসেন এবং এক আত্মীয়ের বাসায় গিয়ে আত্মগোপন করেন। কিন্তু ২ জুলাই পাকিস্তনি সেনাদের হাতে ধরা পড়েন এবং সেদিনই তাদের গ্রেফতার করে চোখ বেঁধে ক্যান্টনমেন্ট আর্মি অফিসার্স মেসে নিয়ে যাওয়া হয়। মা খালেদা জিয়া চরম নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বন্দী অবস্থায় দুই শিশু সন্তান তারেক রহমান ও আরাফাত রহমানকে নিয়ে ছোট্ট একটি কামরায় দেশ স্বাধীন হওয়ার আশায় নির্গুম প্রহর গুণতে থাকেন। শ্বাসরুদ্ধকর এই মৃত্যু আতঙ্কের অবসান ঘটে ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে লাখো মা-বোনের ইজ্জত ও শহীদের রক্তের বিনিময়ে যেদিন বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিল। তারেক রহমান ও আরাফাত রহমান এবং মা খালেদা জিয়ার আত্মগোপন ও বন্দিদশায় যে নিদারুণ মানসিক যন্ত্রণা ও আতঙ্কে দিন অতিবাহিত হয়েছিল, এর মূল্য প্রত্যক্ষ রণাঙ্গনে অংশ নেয়া মুক্তিযোদ্ধার তুলনায় কোনো অংশে কম নয়।
রক্তার্জিত স্বাধীন দেশে জনগন আজ পরাধীন। বর্তমানে যা ঘটছে তা সবার জানা। গুম-খুন, নারী-শিশু নির্যাতন, অপহরণ ও হত্যা ইত্যাদি অনাচার ও আতঙ্ক মানুষের নিত্যসঙ্গী। গণতন্ত্র নেই। আইনের শাসন নেই। জীবনের নিরাপত্তা নেই। এখন জিজ্ঞাসা হলো, তারেক রহমান নেতৃতের পারিবারিক ধারাবাহিকতা বজায় রেখে বর্তমানে যে দুঃশাসন চলছে তা থেকে দেশকে উদ্ধার করে গণতন্ত্রের পথে এগিয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে কতটা প্রস্তুত আছেন? এ প্রশ্নের উত্তর খোঁজার জন্য পেছন ফিরে দেখা দরকার। বাংলাদেশের জনগণ বহু বার নানভাবে দুঃসময় অতিক্রম করেছে। কিন্তু বর্তমান অবস্থা জনভোগান্তির বিবেচনায় অতীতের যেকোনো সময়ের তুলনায় নজিরবিহীন, অধিকতর উদ্বেজনক ও অনিশ্চয়তায় পরিপূর্ণ। গণতন্ত্র উদ্ধারে অন্যতম নির্ভরযোগ্য আপসহীন নেত্রী খালেদা জিয়া ভিত্তিহীন মামলায় অসুস্থ অবস্থায় কারাভোগ করছেন এবং প্রয়োজনীয় চিকিৎসার অভাবে তিলে তিলে নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছেন। সঙ্গত কারণে আপসহীন নেএী খালেদা জিয়ার কারামুক্তি ও গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের সংগ্রাম রচনার নেতৃত্বের দায়িত্ব বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের ওপরই বর্তায়। এই গুরুদায়িত্ব পালনে ইতোমধ্যে তার রাজনীতিক অভিজ্ঞতা ও গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার-আন্দোলনের কর্মপন্থা নির্ধারণে প্রাজ্ঞতা দেশবাসীর দৃষ্টিগোচর হয়েছে। তার একান্তিক চেষ্টায় দলের সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডে গতিশীলতা এসেছে। নেতৃত্বের এই সাফল্যের পেছনে রয়েছে রাজনীতির সাথে তার দীর্ঘ দিনের সম্পৃক্ততা।
আনুষ্ঠানিকভাবে তারেক রহমানের রাজনৈতিক পথচলা শুরু হয় ১৯৮৯ সালে পৈত্রিক নিবাস বগুড়া জেলায় দলের প্রাথমিক সদস্যপদ গ্রহণের মাধমে। তৃণমূল সম্মেলন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে সাধারণ মানুষের চাওয়া পাওয়ার সাথে পরিচিত হন, যা ছিল তার জন্য মাঠ পর্যায়ের অভিজ্ঞতা। এই অভিজ্ঞতা তার পরিবার থেকে পাওয়া অভিজ্ঞতার ঝুলিকে আরো সমৃদ্ধ করেছে। সাংগঠনিকভাবে দলকে শক্তিশালী করার কাজে ওই অভিজ্ঞতাকে তিনি কাজে লাগিয়েছেন। অতঃপর এই অঙ্গণে তার কর্মকাণ্ড ছিল নিরন্তর প্রবাহমান। ১৯৯১ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দেশব্যাপী প্রচারণা-কার্যক্রম পরিচালনার পাঠ গ্রহণ এবং ২০০১ সালের নির্বাচনে আধুনিক ও কার্যকার প্রচারণার কৌশল প্রণয়নে কেন্দ্রিয় ভূমিকা পালনের মাধ্যেমে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেন এবং বিএনপির অমিত সম্ভাবনাময় নেতা হিসেবে তার অভ্যুদয় ঘটে। ২০০১ সালে নির্বাচিত হন দলের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব হিসেবে। ২০০৯ সালে দলের কাউন্সিলের মাধ্যমে সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান হিসেবে নির্বাচিত হন। অল্প সময়ের মধ্যেই তৃণমূল পর্যায়ে ব্যাপক গণসংযোগ ও যুব সমাজকে রাজনীতির প্রশিক্ষণ দিয়ে নেতা-কর্মী ও সমর্থকসহ দেশবাসীর কাছে জনপ্রিয় হয়ে উঠেন। সাংগঠনিক দক্ষতা তাকে দলের ভেতরে ও দেশবাসীর কাছে অধিকতর গ্রহণযোগ্য করে তোলে। পরে রাষ্ট্রীয় জুলুমের শিকার কারাবন্দী দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার স্থলে ফেব্রুয়ারি ২০১৮ সালে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
সমাজ পরিবর্তনের সংগ্রামে রয়েছে অনেক চড়াই-উৎরাই। কখনো সংগ্রাম সফলতার মুখ দেখে,আবার কখনো বা সংগ্রামের নেতৃত্ব দিতে গিয়ে নেতাকে অপশক্তির রোষানলে পড়তে হয়। কৈশোরের অনুরূপ তারেক রহমানের রাজনৈতিক অঙ্গনে পথ চলাও নিয়ত সরল রৈখিক হয়নি। ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি তারিখে দেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আড়ালে যে সেনা সরকার এসেছিল তা জরুরি অবস্থা জারি করে বিরাজনীতিকরণের অপচেষ্টায় লিপ্ত হয়। বিশেষ করে বিএনপিকে নিশ্চিহ্ন করতে সকল পর্যায়ের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে যৌথ বাহিনী এবং টাস্ক ফোর্সের নামে হামলা-মামলা, জুলুম ও নির্যাতন চালায়। দেশনেত্রীকে গ্রেফতার করে কারাগারে নিক্ষেপ করে। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, এই নির্যাতন ও জুলুমের শিকার নেতা-কর্মীদের মধ্যে তারেক রহমানের ওপর নেমে আসা নির্যাতনের মাত্রা ও ধরন ছিল সম্পূর্ণ আলাদা। ৭ মার্চ, ২০০৭ তারিখে গ্রেফতারের পর তার ওপর নেমে আসে পৈশাচিক নির্যাতন। এই আক্রমণ তার প্রাণ কেড়ে নেয়ার জন্যই করা হয়েছিল। তিনি ভাগ্যক্রমে এবং দেশবাসীর দোয়ায় বেঁচে গেছেন। ৭ মার্চ, ২০০৭ থেকে ৩ সেপ্টেম্বর, ২০০৮ পর্যন্ত তিনি কারারুদ্ধ ছিলেন। ২০০৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বর তিনি চিকিৎসার জন্য বিলেতে গমন করেন। এটি তার জন্য একদিক থেকে যেমন নির্বাসনের যন্ত্রণা ভোগের সামিল, অন্যদিক থেকে দুঃসময়ের মুখোমুখি হয়ে তার নিজের রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতিকে আরো দৃঢ় করার একটি পরীক্ষায় অবতীর্ণ হওয়া।
রাজনৈতিক জীবনের এই আঁকা-বাঁকা পথ চলায় তিনি যে জীবন মুখী অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন তা তার বর্তমান পথ চলার ক্ষেত্রে পাথেয় হিসেবে ভূমিকা রাখছে। ভবিষ্যতে দেশের দায়িত্ব পালন করার সময় তার এই অভিজ্ঞতার সুবাদে সূচিত হতে পারে বাংলাদেশে সুস্থ রাজনীতির গতি ধারা। পৃথিবীর স্বনামধন্য রাজনীতিকগণের জীবন ইতিহাস পাঠ করলে দেখা যায়, তাদের অনেকেরই রাষ্ট্র পরিচালনায় সফল হবার পেছনে রয়েছে অনেক সুখ-দুঃখের অভিজ্ঞতার ও চড়াই-উৎরাই পার হবার করুণ কাহিনী। সুখ-দুঃখের এই মিশ্র অভিজ্ঞতাগুলো তাদের রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতিকে আরো জোরালো করেছে। তারেক রহমানের রয়েছে নির্যাতনের দুঃসহ যন্ত্রণা ভোগ করার অভিজ্ঞতা। রয়েছে বাংলাদেশের ইতিহাসে সফলতম রাষ্ট্রনায়ক পিতা জিয়াউর রহমানের শাহাদাৎবরণের করুণ কাহিনী প্রত্যক্ষ করার অভিজ্ঞতা। আরো রয়েছে তার মা খালেদা জিয়ার ৪০ বছর বসবাস বসবাস করা নিজ বাসস্থান থেকে বিতাড়িত হবার করুণ অভিজ্ঞতা। প্রতিনিয়ত নেতা-কর্মীদের উপর ঘটে যাওয়া অসংখ্য নিপীড়ন নির্যাতনের কাহিনী তো রয়েছেই।
এই অভিজ্ঞতাগুলো তারেক রহমানকে করে তুলেছে এক সর্বংসহা রাজনীতিক হিসেবে। তার মধ্যে এমন একবোধ তৈরি হয়েছে যা তাকে বাংলাদেশের রাজনীতির জন্য অপরিহার্য করে তুলেছে । সুতরাং বলা যায়, যে অভিজ্ঞতাগুলো একজন মানুষকে ব্যক্তি, রাজনৈতিক ও সামাজিক জীবনের অন্তর্নিহিত মর্মার্থ উপলব্ধিতে সাহায্য করে, তারেক রহমান ওই অভিজ্ঞতার আলোকে অর্ধশত বছরের বেশি সময় ধরে রাজনীতির পঙ্কিল পথে নিজেকে সামলে নিয়ে এগিয়ে চলেছেন। বাংলাদেশে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার-আন্দলনের কর্মপন্থা নির্ধারণে এর চেয়ে বেশি অভিজ্ঞতার প্রায়োজন আছে কি? বোধ করি নেই। এখন প্রয়োজন হলো, এই অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে সেই বাংলাদেশ বিনির্মাণে সচেষ্ট হওয়া যার স্বপ্ন নিয়ে এ দেশ রক্তক্ষয়ী মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন হয়েছিল, এবং যার সূচনা করেছিলেন তারই পিতা শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চে চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতার কেন্দ্রে থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা ও পরে দেশে বহুদলীয় গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ প্রদানের মাধ্যমে।
অভিজ্ঞতার পাশাপাশি তারেক রহমানের রাজনৈতিক প্রাজ্ঞতাও প্রশংসার দাবিদার। দায়িত্ব গ্রহণের পর জিয়া পরিবারের রাজনৈতিক ভাবাদর্শ চর্চায় তিনি ক্রমাগত সাফলের পরিচয় দিয়ে যাছেন। আজকাল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ ইলেকট্রনিকও প্রিন্ট মিডিয়ার অনেক বক্তব্য আমাদের কানে পৌঁছায়, কিন্তু হৃদয়ে আলোড়ন সৃষ্টি করে না। ৭ নভেম্বর জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস উদযাপন উপলক্ষে সম্প্রতি লন্ডনে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে তারেক রহমান দেশে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের বিষয়ে হৃদয়স্পর্শী যে বক্তব্যটি দিয়েছেন তা দল-মত নির্বিশেষে সবার অন্তঃকরণে হতাশার মাঝে আশার আলো ছড়িয়েছে। তিনি বলেন, ‘আমি দেশে অবস্থিত নতুন প্রজন্মের ভাইবোনদের প্রতি আহ্বান জানাতে চাই- যেভাবে তোমরা নিরাপদ সড়ক আন্দোলন সফল করেছো, একইভাবে ভোটাধিকার নিশ্চিত করার মাধ্যমে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের আন্দোলনকেও সফল করে বাংলাদেশকে নিরাপদ করতে পারো।’ তিনি আরো বলেন, ‘গত ১০-১২ বছর কোনো নির্বাচনে নতুন কিংবা পুরাতন কোনো প্রজন্মই ভোট দিতে পারেনি। তাই বিএনপির প্রতিজ্ঞা হোক- আপনার ভোট আপনি দিবেন, যাকে ইচ্ছা তাকে দেবেন।’ তিনি বক্তব্য শেষ করেন এই বলে যে, ‘আমার হাতকে শক্তিশালী করুন, যাতে আমি আপনাদের ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে পারি- ‘Take Back Bangladesh।’
দেশবাসীর প্রতি তার এই নিবেদন স্মরণ করিয়ে দেয় এভেলিন বিয়াত্রিচে হল-এর ‘ফ্রেন্ড অফ ভলতেয়ার’ গ্রন্থে উল্লেখিত ফরাসি দার্শনিক ভলতেয়ারের স্বাধীনভাবে মত প্রকাশবিষয়ক সেই অমর বাণীর কথা। যাতে বলা হয়েছে, “I disapprove of what you say, but I will defend to the death your right to say it.’ (Hall, Evelyn Beatrice ,1907, The Friends of Voltaire, G. P. Putnam’s Sons)।
জিয়া পরিবারের দ্বিতীয় প্রজন্মের নেতা তারেক রহমানের এই বক্তব্য বাংলাদেশের দুঃসময়ে জিয়া পরিবারের ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালনেরই ধারাবাহিকতা। বর্তমান দূঃশাসন, নিপীড়ন ও গণতন্ত্রহীনতা থেকে দেশকে গণতন্ত্রমুখী করার তার এই উচ্চারিত প্রতিজ্ঞা জিয়াউর রহমানের স্বাধীনতার ঘোষণা, একদলীয় শাসনব্যবস্থা থেকে বহুদলীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় দেশকে ফিরিয়ে আনা এবং এরশাদের স্বৈরশাসন থেকে দেশকে রক্ষা করার জন্য গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তন করার ক্ষেত্রে বেগম খালেদা জিয়ার আপোষহীন সংগ্রামের কথাও স্মরণ করিয়ে দেয়।
২০১৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা যখন আইএসআইএল-এর বিরুদ্ধে ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের’ প্রতিজ্ঞা পুনর্ব্যক্ত করেন, তখন যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ নিয়েছিল মিসর, সৌদি আরব এবং পাকিস্তান। এ ধরনের একটি স্পর্শকাতর বিষয়ে মন্তব্য করতে গিয়ে তারেক রহমান বলেন, “রাজনীতি ‘ধর্ম’ দ্বারা প্রভাবিত হতে পারে কিন্তু রাজনীতির কাঠামো ধর্মভিত্তিক না হওয়াই বাঞ্ছনীয়’ এই বক্তব্যে জাতীয়তাবাদী রাজনীতির উদারনীতিক রাষ্ট্রদর্শন সম্পর্কে তারেক রহমানের বোঝাপড়া ও উপস্থাপনে জিয়াউর রহমানের ভাবাদর্শের সুস্পষ্ট প্রতিফলন লক্ষ্য করা যায়। এতে তার রাজনৈতিক বিচক্ষণতা স্পষ্ট হয়ে উঠে। তারেক রহমানের রাজনৈতিক নেতৃত্বের গুণাবলীর অন্যতম আরেকটি দিক হলো রাজনৈতিক শিষ্টাচার। তিনি সারা দেশব্যাপী তৃণমূল পর্যায়ে সম্মেলনে অংশগ্রহণের এক পর্যায়ে টুঙ্গি পাড়ায় অবস্থিত শেখ মুজিবর রহমানের মাজার জিয়ারত করেন এবং জাতীয়তাবাদী দলের পক্ষ থেকে শ্রদ্ধার্ঘ নিবেদন করেন। এই ধরনের দৃষ্টিভঙ্গী বহুদলীয় গণতন্ত্রের চর্চার ক্ষেত্রে কেবল মাত্র সহায়কই নয় বরং আবশ্যক। তারেক রহমান পরমত সহিষ্ণুতা ও গণতন্ত্রের চর্চায় কতটা আগ্রহী এই শ্রদ্ধার্ঘ নিবেদনের মাধ্যমে তিনি তার প্রমাণ রেখেছেন।
রাজনীতির শত চড়াই-উতরাই পেরিয়ে অর্ধ শতাধিক বছরের মিশ্র অভিজ্ঞতায় পরিপূর্ণ তারেক রহমান বর্তমানে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে সর্বস্তরের মানুষের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ‘জাতীয় সরকারের’ ভাবনা তার রাজনৈতিক প্রাজ্ঞতার অন্যতম একটি দিক। গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে সবাইকে সম্পৃক্ত করার ক্ষেত্রে তার এই অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনৈতিক ভাবনার ইতিবাচক ফলাফল আমাদের সবার সামনে দৃশ্যমান। নিত্যপণ্য ও জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি, পুলিশের গুলিতে দলের নেতাকর্মীদের মৃত্যুর প্রতিবাদসহ বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে দেশের সব বিভাগে গণসমাবেশ করছে বিএনপি। চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ, খুলনা, রংপুর, বরিশাল , ফরিদপুরের পর সিলেটে গণসমাবেশের আয়োজন করেছে বিএনপি। সমাবেশকে ঘিরে ২-৩ দিনের পরিবহন ধর্মঘট ডাকার পরও নেতা-কর্মী ও সমর্থকদের আটকানো যায়নি। বরং একদিনের সমাবেশ রূপ নিয়েছে দুই-তিন দিনের সমাবেশে। দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে কারাগারে নেওয়ার পর ৮ হাজার মাইল দূর থেকে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে তারেক রহমানের নেতৃত্বের অনিবার্য ও গ্রহণযোগ্যতা কতটুকু তার প্রমাণ মেলে শত বাধা বিঘ্ন পার হয়ে দলের নেতা-কর্মী, সমর্থকদের পাশাপাশি গণসমাবেশে সাধারণ মানুষের ঢল।
গণতন্ত্রের পথহারা বাংলাদেশ তারেক রহমানের মিশ্র অভিজ্ঞতা ও রাজনৈতিক প্রাজ্ঞতা ওপর ভর করে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের স্বপ্ন পূরণে সফল হবে, তার জন্মদিনের এই শুভলগ্নে দেশবাসীর পক্ষ থেকে রইল এই প্রত্যাশা ও নিরন্তর শুভকামনা।
লেখক : অধ্যাপক, দর্শন বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়