আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের বিভিন্ন গবেষণা উপস্থাপনা প্রবন্ধ-নিবন্ধ থেকে আমরা বলতে পারি; মানসিক চাপ হলো, মানুষের কাছে অনাকাক্সিক্ষত কোনো ঘটনা বা পরিস্থিতি- যা তার অনুভূতিতে প্রচণ্ড আঘাত করে। এর ফলে তার মধ্যে অস্থিরতা, বিষণœতা, হতাশা-নিরাশা, দুশ্চিন্তার উদ্রেক হয়। একসময় এ পরিস্থিতি এমন প্রকট আকার ধারণ করে যে, ব্যক্তি আগামী জীবনের সব আশা-আকাক্সক্ষা, স্বপ্ন-পরিকল্পনা ভুলে হীনম্মন্যতায় নিজের জীবনকে শেষ করে ফেলে। এমনকি মহান রবের দেয়া অসংখ্য-অগণিত নিয়ামতের প্রতি অকৃতজ্ঞ হয়, যা সুস্পষ্ট কুফরি চিন্তা-মানসিকতা।
আমরা অনেক পাপ সম্পর্কে সচেতন থাকি; কিন্তু মানসিক অস্থিরতায় ভুগে নিরাশ হওয়া, হতাশ হওয়া, দুশ্চিন্তায় নিমজ্জিত থাকা যে একটি কঠিন পাপ; আমরা অনেকেই তা অনুধাবন করি না। শয়তান মানুষের দুনিয়া ও আখিরাতের সফলতাকে ব্যর্থ করার জন্য প্রথম তীর ছোড়ে হতাশা, দুশ্চিন্তা ও ব্যর্থতার। প্রখ্যাত হাদিস বিশারদ ড. আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর রহ: খুব সুন্দর করেই বলতেন, ‘শয়তানের পাঠশালার প্রথম পাঠ হলো, হতাশা-নিরাশা, দুশ্চিন্তা।’ আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘শয়তান তোমাদেরকে দারিদ্র্যের ভয় দেখায়, অভাবের ভয় দেখায় এবং অশ্লীলতার নির্দেশ দেয়’ (সূরা বাকারা-২৬৮)। এ আয়াতের ব্যাখ্যায় তাফসিরে খাজিনে ‘দারিদ্র্যের ভয়, অভারের ভয়’- এর ব্যাখ্যা করা হয়েছে, স্বাভাবিক অবস্থার অবনতি। অর্থাৎ, শয়তান মুমিনকে ভবিষ্যতে বিপদ-মুসিবত, দুরবস্থা, হতাশা-নিরাশার ভয় দেখায়। অপূর্ণতার হাহাকারে বিষণœ করে তোলে, যেন সে তার ওপর দেয়া আল্লাহর অগণিত নিয়ামতের অকৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করে। আর এমন অকৃতজ্ঞ মানসিকতা মানুষকে ক্রমাগত কুফরির দিকে নিয়ে যায়।
ইসলাম একটি শাশ্বত পরিপূর্ণ ধর্ম। এতে মানুষের দুনিয়া-আখিরাতে সফলতার পরিপূর্ণ দিকনির্দেশনা রয়েছে। মানসিক টেনশন উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা দুশ্চিন্তা হতাশা থেকে মুক্তির জন্য ইসলামের মৌলিক দিকনির্দেশনাগুলো হলো-
সর্বাবস্থায় আল্লাহর ওপর আস্থা রাখা : একজন মানুষ যত বেশি আল্লাহর ওপর আস্থা রাখবে, নিজেকে আল্লাহর কাছে সঁপে দেবে মানসিক শক্তি ও স্থিরতা ততই বৃদ্ধি পাবে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আর যে ব্যক্তি আল্লাহর ওপর ভরসা করে আল্লাহই তার জন্য যথেষ্ট’ (সূরা ত্বালাক-৩)। একটু লক্ষ করুন, আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে কী চমৎমকার ঘোষণা! কেউ যদি তাঁর ওপর ভরসা করে তিনি তার জন্য যথেষ্ট হয়ে যাবেন।
জীবনে চলার পথে মহান আল্লাহকে নিজের ভালো-মন্দের ক্ষেত্রে পূর্ণ কল্যাণকামী হিসেবে গ্রহণ করাই হলো আল্লাহর ওপর আস্থা রাখা, নির্ভরশীল হওয়া। আল্লাহ তায়ালার ওপর নির্ভরশীল হওয়ার একটি চমৎকার উপমা রাসূলুল্লাহ সা: পেশ করেছেন। হজরত উমার রা: (২৩ হি.) থেকে বর্ণিত, রাসূল সা: বলেন, ‘তোমরা যদি প্রকৃতভাবেই আল্লাহ তায়ালার ওপর নির্ভরশীল হতে তাহলে পাখিদের যেভাবে রিজিক দেয়া হয় সেভাবে তোমাদেরও রিজিক দেয়া হতো। এরা সকালে খালি পেটে বের হয় আর সন্ধ্যায় ভরা পেটে ফিরে আসে’ (সুনানে তিরমিজি-২৩৪৪)।
তাকদিরের ওপর দৃঢ়বিশ্বাস রাখা : মানসিক চাপ, দুশ্চিন্তা, হতাশা থেকে বাঁচার অন্যতম মাধ্যম হলো নিজের ভালো-মন্দ, আশা-আকাক্সক্ষার বাস্তবায়ন আল্লাহর সিদ্ধান্তের ওপর ছেড়ে দেয়া। ঘটমান সব অবস্থা আল্লাহর পক্ষ থেকে হয়ে থাকে, তা হৃদয় থেকে মেনে নেয়া। পৃথিবীতে যা কিছু হয় সব কিছুই বহু আগে মহান পরিচালক আল্লাহ তায়ালা একটি কিতাবে লিখে রেখেছেন- যাকে তাকদির বলা হয়।
তাকদিরের প্রতি বিশ্বাস রেখে স্বাভাবিক জীবনযাপন করে যাওয়া মুমিন ব্যক্তির জন্য আবশ্যক। এতে আপনার কোনো কর্ম যদি আপনার আশা-আকাক্সক্ষা, চাহিদার বিপরীতও হয় তবুও হতাশ না হওয়া। আপনার তাকদিরে মহান আল্লাহ তায়ালা যা কিছু নির্ধারণ করে রেখেছেন তা কোনো মানুষ ইচ্ছা করলে পরিবর্তন করতে পারবে না। হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা: (৬৮ হি.) বলেন, আমি একদিন রাসূল সা:-এর পেছনে ছিলাম। তিনি বলেন ‘হে বৎস! আমি তোমাকে কিছু কথা শিক্ষা দিচ্ছি; তুমি আল্লাহ তায়ালার হুকুম-আহকাম যথাযথ আদায় করবে, আল্লাহ তায়ালা তোমাকে সব বিপদ-মুসিবত থেকে যথাযথভাবে রক্ষা করবেন। তুমি আল্লাহ তায়ালার হুকুম-আহকাম যথাযথ আদায় করবে; তাহলে তুমি আল্লাহ তায়ালাকে তোমার সামনে পাবে। আর তুমি যখন কিছু চাইবে আল্লাহর কাছেই চাইবে। যখন কোনো সাহায্য চাইবে আল্লাহর কাছেই চাইবে। জেনে রেখো, যদি সব মানুষ তোমার কোনো উপকার করার ইচ্ছা করে তবে তারা শুধু এ পরিমাণ উপকারই করতে পারবে; যা আল্লাহ তায়ালা তোমার জন্য নির্ধারণ করে রেখেছেন। আর সব মানুষ তোমার কোনো ক্ষতি করার ইচ্ছা করে তবে তারা কেবল এ পরিমাণ ক্ষতিই করতে পারবে যা আল্লাহ তায়ালা তোমার জন্য নির্ধারণ করে রেখেছেন’ (সুনান তিরমিজি-২৫১৬)।
আল্লাহর কাছে দোয়া করা : মুমিন ব্যক্তির অন্যতম একটি বৈশিষ্ট্য হলো- নিজ আশা-আকাক্সক্ষা, পরিকল্পনা ও দুঃখ-কষ্টের কথাগুলো আল্লাহর কাছে বলা, এ বৈশিষ্ট্য অর্জন করাই আল্লাহ তায়ালার কাছে দোয়া করার মূল উদ্দেশ্য।
রাসূল সা: হতাশা দুশ্চিন্তা দুঃখ-কষ্ট মানসিক চাপ থেকে রক্ষার জন্য আল্লাহর কাছে কীভাবে দোয়া করব তা বলে দিয়েছেন। হজরত আনাস ইবনে মালেক রা: থেকে বর্ণিত হয়েছে, ‘আল্লাহুম্মা ইন্নি আউজুুবিকা মিনাল হাম্মি ওয়াল হাযানি ওয়াল আজযি ওয়াল-কাসাল ওয়াল-বুখলি ওয়াল জুবনি ওয়া ধলাইদ্দাইনি ওয়া গলাবাতির রিজাল’। হে আল্লাহ! আমি দুশ্চিন্তা ও পেরেশানি থেকে, অক্ষমতা ও অলসতা থেকে, কৃপণতা ও ভীরুতা থেকে, ঋণের ভার ও লোকজনের প্রাধান্য থেকে আপনার কাছে পানাহ চাচ্ছি (সহিহ বুখারি-২৮৯৩)।
বান্দা যত আল্লাহ তায়ালার অভিমুখী হবে, তাঁর ইবাদত-বন্দেগিতে নিজেকে সঁপে দেবে, দুঃখ-কষ্ট বিপদ-মুসিবতে আল্লাহর সিদ্ধান্তকে মেনে নেবে, সে তত বেশি প্রশান্তিময় জীবন লাভ করবে। ঘোর অন্ধকারাচ্ছন্ন আলোহীন পথেও স্বস্তি অনুভব করবে। কঠিন দুর্ভিক্ষে দিনের পর দিন অনাহারে অতিবাহিত হওয়ার পরও হতাশা দুশ্চিন্তা আচ্ছন্ন করবে না। হৃদয়ে বারবার উদ্ভাসিত হবে, আমার মহান অভিভাবক আল্লাহ তায়ালা আমার জন্য কল্যাণকর সিদ্ধান্তই নিয়েছেন। অদূর ভবিষ্যতে উত্তম নিয়ামত রেখেছেন।
লেখক : শিক্ষার্থী, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া