বাংলাদেশে অর্থনৈতিক উন্নয়নের পাশাপাশি সামাজিক সুরক্ষায় আর্থিক সুবিধা দেয়ার নিশ্চয়তায় বিভিন্ন ক্ষেত্রে ভাতা প্রদান, বৈষম্য বিলোপের প্রচেষ্টার সুফল ভোগ করছে উপকারভোগীরা। চলমান মুদ্রাস্ফীতিতে সরকার খাদ্য ও সংশ্লিষ্ট পণ্য সরবরাহ করা এবং ভর্তুকি দেয়া অব্যাহত রয়েছে। সামাজিক সুরক্ষায় আর্থিক সক্ষমতা বৃদ্ধি, অর্থতুল্য সেবা বাড়ানোসহ আলোচিত বিষয়গুলো বাস্তবায়ন ও প্রতিকারের জন্য উপস্থাপিত হলো।
সরকারি-আধা সরকারি প্রতিষ্ঠানের চাকরিজীবীরা যারা পেনশন সমর্পণ করেছিলেন তারা সরকারের একান্ত অনুগ্রহে অর্থ মন্ত্রণালয়ের প্রজ্ঞাপন মোতাবেক ১ জুলাই ২০১৭ থেকে নীতিমালা অনুযায়ী পেনশন ভোগ করছেন। বর্তমান গড় আয়ু, মূল্যস্ফীতির চাপ বিবেচনায় পেনশনে পুনঃস্থাপনের বয়সসীমা অবসরের পর ১৫ বছরের দীর্ঘতা হ্রাস করে যুক্তিযুক্তভাবে অনধিক ১০ বছর করা হলে অনেকে উপকৃত হবেন ও উন্নয়নের সুফল ভোগ করতে পারবেন, যা জনকল্যাণে প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক বাস্তবায়নের জন্য নির্দেশিত হতে পারে।
কোভিড-১৯ পরবর্তী অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড পুনরুজ্জীবিত করার লক্ষ্যে সরকার ব্যবসায় গতি সঞ্চার করতে সার্বিক অর্থনীতির উন্নয়নে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের প্রণোদনা, সুদহার হ্রাস, সুদ মওকুফ, বারবার পুনঃতফসিল, পুনর্গঠন, পুনর্ভরণ সুবিধা অব্যাহত রেখেছে।
পৃথিবীর ধনী দেশগুলো মুদ্রাস্ফীতির অতি বৃদ্ধি থেকে মুক্ত নয়, এতে ব্যক্তি-পরিবারে খরচ অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে, মুদ্রানীতিতে সুদহারের পরিবর্তন হয়েছে বহুবার, তবুও স্বস্তিতে আসছে না অর্থনীতি। আমাদের দেশেও মুদ্রাস্ফীতির চাপ বাড়ছে, বাজার অর্থনীতির বিপরীতে সুদহার ও ডলার মূল্য নিয়ন্ত্রিত। বর্তমানে লোপাট, সঙ্কট, পাচার শব্দগুলো সংবাদমাধ্যমে প্রায়ই আলোচিত হচ্ছে যা ব্যাংকব্যবস্থায় ঋণের সাথে সংশ্লিষ্ট। ব্যাংকঋণ ছাড়ে নীতি ও নিয়মাচারে, আদায় ও কাম্যতায় বেজায় ফাঁক, যার বোঝা জনগণের করের টাকায় মূলত সরকারই বহন করে ব্যাংকের মূলধন/পুঁজি জোগান দিতে। তাই সবাইকে সঙ্কটে এগিয়ে আসতে হবে। এতে অর্থনীতিতে ও সামাজিক সুরক্ষায় সরকারের সক্ষমতা বাড়বে।
প্রবীণ বয়স্ক ব্যক্তিরা সমাজ ও পরিবারের বোঝা, সরকারই আশ্রয়স্থল। তাদের ভাতার পরিমাণ বাড়িয়ে স্বাস্থ্যসেবা স¤প্রসারণ জরুরি। প্রবীণ নিবাসে প্রবীণদের আবাসিক ও অসুস্থদের স্বাস্থ্যসেবায় বিশেষজ্ঞ চিকিৎসা দরকার হয়। চিকিৎসাব্যয় নির্বাহে ওষুধের মূল্য পর্যালোচনায়, অবসরভোগী প্রবীণদের বার্ধক্যজনিত শারীরিক সমস্যা ও অসুস্থতা বিবেচনায় চিকিৎসাভাতা নিয়মিত চাকরিজীবীদেরসহ বর্তমানে প্রদেয় টাকার চেয়ে দ্বিগুণ করা প্রয়োজন। পেনশনারদের জন্য সমগ্রেডে সমবেতন নিয়ম চালু করে পেনশন নির্ধারণ করলে প্রাপ্যতা বাড়বে ও অর্থনৈতিক বৈষম্য কমবে। এতে পেনশনাররা উপকৃত হবেন। বেতন স্কেলে বার্ষিক বৃদ্ধিহার ৫ শতাংশ স্থির রয়েছে, পেনশনারদের বেলায়ও একইভাবে প্রযোজ্য হয়েছে। বর্তমান অর্থনৈতিক অবস্থা বিবেচনায় ও মূল্যস্ফীতি মোকাবেলায় বার্ষিক বেতন বৃদ্ধির হার ১০ শতাংশ ও এককালীন কিছু ভাতা সাহায্য দেয়ার কথা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বিবেচনা করতে পারে।
সঞ্চয়পত্র সঞ্চয় ব্যুরোর একটি বিনিয়োগ প্রকল্প। রাষ্ট্রের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে, বাজেট ঘাটতিতে, জনকল্যাণসহ প্রয়োজনীয়, বিদেশী ঋণ প্রদানকারী সংস্থা থেকে ঋণ গ্রহণ না করে দেশের অভ্যন্তরে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগ ছাড়াও ক্ষুদ্র্রসঞ্চয়ী, প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্মচারীদের প্রভিডেন্ট ফান্ডের জমা, পেনশনারদের প্রাপ্য গ্র্যাচুইটি, পেনশন সমর্পণকারীদের প্রাপ্য অর্থ মূলত স্কিমের বিনিয়োগ তহবিল থেকে ঋণ গ্রহণ করে। বিদেশী ঋণদানকারী সংস্থাগুলোর সুদের হারের বাইরে চুক্তি অনুযায়ী পরামর্শক ভাতা, উচ্চহারে বেতন, কর্মচারীদের বেতন ও অন্যান্য সুবিধা থাকে যা নিয়মমাফিক বিদেশীদের হিসাবে জমা করতে হয় যা দেশের বাইরে স্থানান্তরিত হয়। এ ক্ষেত্রে ঋণের উৎপাদনশীলতা বিচারে বাহ্যিক সুদের হারের চেয়ে প্রদেয় খরচ অনেক বেশি। তাই সরকার শর্তাধীন ঋণ গ্রহণের চেয়ে দেশের অভ্যন্তরে সঞ্চয়পত্রের মাধ্যমে ঋণ গ্রহণ করে বাণিজ্যিক ব্যাংকের আমানতের চেয়ে, বেশি সুদহারে সামাজিক নিরাপত্তাজনিত প্রিমিয়াম দিয়ে। গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় সরকারের সামাজিক দায়বদ্ধতা রয়েছে অর্থনৈতিক বৈষম্য হ্রাসের ক্ষেত্রে।
সঞ্চয়পত্র সুনির্দিষ্ট সীমায় ক্রয় করা যায়। বেশি টাকা বিনিয়োগে কম সুদ দেয়া হয়। সঞ্চয়পত্রের বিপরীতে ঋণসুবিধা দেয়া হয় না। স্থায়ী আমানতের মেয়াদ ঊর্র্ধ্বে এক বছরের। কিন্তু, সঞ্চয়পত্র তিন থেকে পাঁচ বছর মেয়াদি। বছর বছর সুদহার পরিবর্তন হয় না। করোনা-উত্তর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, জ্বালানি মূল্যবৃদ্ধি, আমদানি মূল্যে অধিক অর্থব্যয়, পণ্য সরবরাহে ধীরগতি, পরিণামে মূল্যস্ফীতির ক্রমাধিক্য থেকে বাংলাদেশও বিশ্বের দেশগুলোর চেয়ে পিছিয়ে নেই। উপরন্তু লেনদেন হিসাবে প্রতিক‚ল ভারসাম্য, বাজেট ঘাটতি, ডলারের অতি মূল্যায়ন রিজার্ভ সংরক্ষণ ও অন্যান্য কারণে আইএমএফ থেকে সরকার ৪৫০ বিলিয়ন ডলার ঋণ প্রাপ্তির আশা করছে, তবে কিছু প্রতিষ্ঠানের সংস্কারসাপেক্ষে। সঞ্চয়পত্রের ক্ষেত্রে বর্তমান সুদহার বাজারদরের কাছাকাছি করার পরামর্শ রয়েছে। অর্থ মন্ত্রণালয় ১১ মাসের মধ্যে কয়েক দফায় সুদহারে সংস্কার করে হ্রাস করা হয়েছে ও সঞ্চয়পত্র সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতায় এবং অনেক উপকারভোগী রয়েছেন মর্মে আইএমএফ কর্তৃপক্ষীয়দের অবহিত করেছে জানা যায়। বর্তমান নিয়ন্ত্রিত বাজারদরে স্থায়ী আমানত সুদের হার (তিন মাস, ছয় মাস, এক বছর) গড়ে ৬.৫ শতাংশ। বিপরীত ঋণ নেয়ার ব্যবস্থা রয়েছে। আমানত-ঋণের সুদহার ৬-৯ শতাংশে স্থিতিশীল। কিছু অর্থনীতির আলোচক/ব্যবসায়ী সঞ্চয়পত্রের সুদহারের হ্রাসের প্রতি ইঙ্গিত করেছেন। তারা ভাবেন না শুধু মুনাফা আয়ে যাদের জীবিকা তারা জীবন বাঁচাবেন কিভাবে? বর্তমান নিয়ন্ত্রিত বাজারের পরিবর্তে মুক্তবাজার/বাজার অর্থনীতিতে আমানত ও সুদহার দুটোই বাড়বে। লক্ষণীয়, বর্তমানে জনকল্যাণে প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রভিডেন্ট ফান্ডের জমায় ১৩ শতাংশ সুদ প্রদান করছে। সরকার জনকল্যাণের লক্ষ্যে সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনীর সুরক্ষায় ও মুদ্রাস্ফীতি বিবেচনায় সঞ্চয়পত্রের বিদ্যমান সুদহার দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ বিধায় আরো বাড়িয়ে এবং সুদ আয় থেকে ১০ শতাংশ হারে উৎসকর কর্তন অব্যাহতি দিয়ে উপকারভোগী স্থির আয়ের জীবিকায় নির্ভরশীলদের বিশেষ সুরক্ষায় ব্যবস্থা গ্রহণ করা জরুরি। অবসরভোগীরা-প্রবীণরা তাদের আকাঙ্ক্ষা পূরণে সরকারের প্রতি একান্ত নির্ভরশীল। সরকারের উপলব্ধিতে ও ইতিবাচক সিদ্ধান্তে তারা আশান্বিত হয়। আলোচ্য ক্ষেত্রে প্রতিকার ও বাস্তবায়নে সরকারের বিভিন্ন বিভাগের সহযোগিতা ও সমন্বয়ের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, অর্থমন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রীর সদয় ও মানবিক দৃষ্টি আকর্ষণ করছেন প্রত্যাশীরা।
লেখক : প্রাক্তন নির্বাহী, রূপালী ব্যাংক লিমিটেড