পুঁজিবাজারে দুরবস্থায় পড়েছে ব্যাংকিং খাত। ব্যাংকের শেয়ারের প্রতি আগ্রহ কমে যাচ্ছে বিনিয়োগকারীদের। আগে যেখানে মোট বাজার মূলধনের ৪০ ভাগের ওপরে দখলে ছিল এ খাতের, এখন সেটা কমতে কমতে ২০ ভাগের নিচে নেমে গেছে।
শুধু তা-ই নয়, অভিহিত মূল্যের নিচে নেমে গেছে আট ব্যাংকের শেয়ার। ব্যাংকিং খাতের এ দুরবস্থার জন্য এ খাতের ওপর বিনিয়োগকারীদের আস্থার অভাব দেখা দেয়া অন্যতম কারণ বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
তাদের মতে, হলমার্ক, বিসমিল্লাহ, বেসিক ব্যাংক, এনন টেক্স, ক্রিসেন্টের মতো বড় বড় ঋণকেলেঙ্কারির ঘটনা যখন বিনিয়োগকারীরা জানতে পারেন, পরিচালকদের নিজ ব্যাংক থেকে টাকা নেয়ার ঘটনা যখন ঘটে, খেলাপি ঋণ যখন ব্যাপকভাবে বেড়ে যায়, তখন শঙ্কিত হয়ে পড়েন বিনিয়োগকারীরা। বিনিয়োগ করে মূলধন হারানোর আতঙ্ক থেকে এ খাতের ওপর মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন সাধারণ বিনিয়োগকারীরা। এর সরাসরি প্রভাব পড়েছে দেশের ব্যাংকের শেয়ার মূল্যের ওপর।
ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) গত বৃহস্পতিবারের পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, প্রতিটি শেয়ারের অভিহিত মূল্য যখন ১০ টাকা, সেখানে আটটি ব্যাংকের শেয়ার মূল্য ১০ টাকার নিচে নেমে গেছে। ব্যাংকগুলোর মধ্যে এবি ব্যাংক, এক্সিম ব্যাংক, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, আইসিবি ইসলামী ব্যাংক, আইএফআইসি ব্যাংক, ন্যাশনাল ব্যাংক, ওয়ান ব্যাংক, ও স্টান্ডার্ড ব্যাংক রয়েছে। আর ওই দিন ২২টি ব্যাংক বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ৯টিরই অভিহিত মূল্যের নিচে নেমে গেছে।
অর্থনৈতিক বিশ্লেষক আকতার হোসেন সান্নামাত বলেন, কোনো কোম্পানির ওপর যখন বিনিয়োগকারীদের আস্থার সঙ্কট দেখা দেয়, তখন বিনিয়োগকারীরা ওই কোম্পানিতে বিনিয়োগ করা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেন। অর্থাৎ, বিনিয়োগকারী যখন বুঝতে পারেন সংশ্লিষ্ট কোম্পানিতে বিনিয়োগ করে তার বিনিয়োগ তুলতে পারবেন না, তখন ওই কোম্পানিতে আর শেয়ারে বিনিয়োগ করেন না।
এতে ওই কোম্পানির মূল্য কমে যায়। ব্যাংকিং খাতে শেয়ারের মূল্য কমে যাওয়া এটাই অন্যতম কারণ হিসেবে দেখছেন এ অর্থনৈতিক বিশ্লেষক। তিনি জানান, দেশের পুঁজিবাজারের মোট বাজার মূলধনের ৪০ ভাগের ওপরে দখলে ছিল ব্যাংক কোম্পানির শেয়ার। এখন তা কমতে কমতে ২০ শতাংশেরও নিচে নেমে গেছে।
ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, ব্যাংকিং খাতে দুরবস্থার জন্য নানা কারণ রয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম কারণ হলো নিয়ন্ত্রক সংস্থা থেকে ঘন ঘন নীতিমালা শিথিল করা। ২০১৫ সালে ঋণপুনর্গঠনের নামে মাত্র ১ ও ২ শতাংশ ডাউন পেমেন্ট দিয়ে প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকার ঋণ নবায়ন করা হয়। এর বাইরেও ওই সময়ে অনেক ব্যাংকেরই ডাউন পেমেন্ট ছাড়াই ঋণ নবায়নের সুযোগ দেয়া হয়।
এতে রাতারাতি খেলাপি ঋণ কমে গেলেও আবার ঋণখেলাপিরা এ সুযোগ নিয়ে নতুন করে ব্যাংক থেকে ঋণ নেন। কিন্তু নবায়ন করা ঋণের কিস্তি পরিশোধ না করায় আবার তা নতুন করে খেলাপি হয়। এভাবেই গত কয়েক বছর যাবৎ ঋণখেলাপিদের সুযোগ দেয়ায় ঋণ পরিশোধে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন অনেক ভালো ঋণগ্রহীতা। এরই ধারাবাহিকতায় গত বছরের শুরুতেই ২ শতাংশ ডাউন পেমেন্ট দিয়ে ঋণ নবায়নের ঘোষণা দেয়া হয়। এতে সুদের হারেও ছাড় দেয়া হয়।
এ সুবিধার আওতায় ১০ বছর মেয়াদি ঋণ নবায়নের সুযোগ নিতে ঋণ পরিশোধ অনেকাংশেই বন্ধ করে দেন বড় বড় ঋণগ্রহীতারা। এর পরেও গত সেপ্টেম্বর শেষে ঋণ অবলোপনসহ খেলাপি ঋণ বেড়ে দাঁড়ায় প্রায় পৌনে দুই লাখ কোটি টাকায়। যদিও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল আইএমএফের হিসাবে তা প্রায় আড়াই লাখ কোটি টাকা। সবমিলে ব্যাংকের নগদ আদায় কমে যাওয়ায় ব্যাংকের মুনাফার ওপর বড় ধরনের প্রভাব পড়ে। ব্যাংকাররা মনে করেন, সামনে এ আয়ের ওপর আরো নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। এপ্রিল থেকে ঋণের সুদহার ৯ শতাংশ কার্যকর হলে ব্যাংকগুলোর আয় আরো কমে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন ব্যাংকাররা। এর সরাসরি প্রভাব পড়েছে পুঁজিবজারে ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগের ওপর।
ব্যাংক খাতের ওপর থেকে বিনিয়োগকারীদের আস্থা কমে যাওতার কয়েকটি কারণের মধ্যে অন্যতম হলো, বিনিয়োগকারীদের আস্থার সঙ্কট দেখা দেয়া। গত কয়েক বছর যাবৎ ব্যাংকিং খাতে যে দুর্নীতি, ঋণকেলেঙ্কারির ঘটনা ঘটেছে, আর এসব সংবাদ শুনতে শুনতে বিনিয়োগকারীরা ব্যাংক কোম্পানিতে বিনিয়োগ করতে শঙ্কিত হয়ে পড়েছেন। হলমার্ক ঘটনার দাগ মুছতে না মুছতেই বিসমিল্লাহর ঋণ কেলেঙ্কারির ঘটনা ধরা পড়ে। এর কিছু দিন পড়েই বেসিক ব্যাংকের ঋণ কেলেঙ্কারির ঘটনা ধরা পড়ে।
বেসিক ব্যাংকের রেশ কাটতে না কাটতেই এননটেক্স, ক্রিসেন্ট লেদারের ঋণকেলেঙ্কারির ঘটনা প্রকাশ পায়। এর বাইরে প্রতিনিয়তই ব্যাংকের কোনো না কোনো ঘটনা বিনিয়োগকারীরা গণমাধ্যমের মাধ্যমে জানতে পারছেন। বেশ কয়েকটি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান আমানতকারীদের আমানতের অর্থ ফেরত দিতে পারছেন না। আমদানি বিল পরিশোধ করতে পারছে না কিছু কিছু ব্যাংক। এক ব্যাংক থেকে অন্য ব্যাংকের পরিচালকরা ঋণ নিয়ে তা আর ফেরত দিচ্ছেন না।
এসব কারণে গত কয়েক বছর যাবৎ, অস্বাভাবিক হারে বেড়ে যাচ্ছে খেলাপি ঋণ। খেলাপি ঋণের কারণে ব্যাংকগুলোর প্রকৃত আয় কমে যাচ্ছে। এ কারণেই গত কয়েক বছর যাবৎ ব্যাংক কোম্পানিগুলো বিনিয়োগকারীদের প্রত্যাশা অনুযায়ী লভ্যাংশ দিতে পারছে না। বেশির ভাগ ব্যাংকের এমন অবস্থার কারণে বিনিয়োগকারীরা শঙ্কিত হয়ে পড়েছেন ব্যাংক কোম্পানিতে বিনিয়োগ করার। এরই সামগ্রিক প্রভাব পড়েছে ব্যাংকের ওপর।
তিনি মনে করেন, এ থেকে উত্তরণের উপায় বের করতে হবে। অন্যথায় ব্যাংকগুলোর বাজার মূলধন ধরে রাখতে পারবে না বলে তিনি আশঙ্কা করেন। এ দিকে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ব্যাংক কোম্পানিগুলোর সার্বিক আর্থিক অবস্থা বিবেচনা না করেই সব ব্যাংকের জন্যই অভিন্ন পরিশোধিত মূলধন ৪০০ কোটি টাকা করা হয়। আর এ ৪০০ কোটি টাকার মূলধন করতে গিয়ে দুর্বল ব্যাংক কোম্পানিগুলো শেয়ারপ্রতি আয় (ইপিএস) ও ইকুইটি ধরে রাখতে পারছে না।
তিনি মনে করেন, বর্তমান পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য পরিশোধিত মূলধনের পরিবর্তে ব্যাংকগুলোর প্রকৃত মূলধন বাড়ানোর দিকে নজর দিতে হবে। ব্যাংকগুলোতে সুশাসন নিশ্চিত করতে হবে। ব্যাংকিং খাতে সুপারভিশন ও মনিটরিং ব্যবস্থা জোরদার করতে হবে। তাহলে বর্তমান অবস্থা থেকে ঘুরে দাঁড়ানো সম্ভব হবে বলে তিনি মনে করেন।