সুন্দর একটা মিষ্টি স্বরের আবেশ নিয়ে আজ ঘুম ভাঙল। ঝলমলে মন নিয়ে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালাম। সামনের খোলা জায়গাটায় অনেক রকম ফুল ফুটেছে। আজ সব কিছুই অন্য রকম লাগছে….। স্নিগ্ধ মন কেমন-করা সকাল। আজ সকালটা নতুন কোনো সাজে সেজেছে। এক মিষ্টি মেয়ে খোঁপায় হলুদ ফুল জড়িয়ে, হলুদ শাড়ি পরে হেঁটে যাচ্ছে। যেন জগতের সব আলো ওর সাথে শাড়ির আঁচলে, চোখের পাতায় জড়িয়ে আছে।
ভাবছিলাম আজ কি কোনো বিশেষ দিন? হঠাৎ মনে পড়ল আজ পহেলা ফাল্গুন। আমার মন নেচে উঠল আনন্দে। সব ফুলের রেণু যেন ছড়িয়ে পড়ল আমার মনে। দু হাতে পরাগ মেখে চোখে বোলাতে ইচ্ছে করছে। আজ দূরে কোথাও হারিয়ে যাওয়ার দিন। কাজকে দেব ছুটি। এখন আমি শাড়ি খুঁজে বের করব, লাল টিপ পরব আর খোঁপায় হলুদ গাদা ফুল। মনে মনে গল্প করব তোমার সাথে, চিঠি লিখব।
নবীন প্রাণ ও নবীন উদ্দীপনা নিয়ে আসে ঋতুরাজ বসন্ত। বসন্তের পুষ্পময় গন্ধেভরা দখিনা বাতাসে ভাবুকের মনে জাগে ভাব, কবির মনে জাগে ছন্দ, আর গায়কের মনে জাগে গান। বসন্তের অনিন্দ্যসুন্দর হাসির পুষ্পবৃষ্টি আর কোকিল কণ্ঠের কুহুতান সবাইকে জানিয়ে দেয় তার আগমনের কথা।
আহা আজি এ বসন্তে …
‘দখিন সমীরণে শিহরণ’ জাগানোর দিন এল মাতাল হাওয়ায় কুসুম বনের কাঁপনে, মৌমাছিদের ডানায় ডানায়, গাছের কচি কিশলয় জেগে উঠবার আভাসে, পল্লব মর্মরে আর বনতলে। কোকিলের কুহুতাল জানাল ‘আজি বসন্ত’।
শীতের রিক্ততা মুছে দিয়ে প্রকৃতিজুড়ে আজ সাজসাজ রব। প্রকৃতিতে জেগে উঠেছে নবীন জীবনের ঢেউ। নীল আকাশে সোনা ঝরা আলোর মতই হৃদয় আন্দোলিত। হৃদয়ে সুর জাগে : ‘আহা আজি এ বসন্তে, কত ফুল ফোটে কত বাঁশি বাঁজে, কত পাখি গায়….। ’ ঋতুরাজ বসন্তের দিনগুলো মধুরেণ মায়াবী এক আবেশে ঘিরে রাখবে বৃক্ষ, লতা, পাখ-পাখালি আর মানুষকে।
‘ফুলের বনে যার পাশে যাই তারেই লাগে ভালো’ কবিগুরুর এই পুলকিত পঙ্ক্তিমালা বসন্তেই কি সবার বেশি মনে পড়ে? বনে বনে রক্তরাঙা শিমুল-পলাশ, অশোক-কিংশুকে বিমোহিত কবি নজরুল ইসলামের ভাষায় ‘এল খুনমাখা তুণ নিয়ে খুনেরা ফাগুন…’ বসন্ত বাতাসে পুলকিত ভাটিবাংলার কণ্ঠ শাহ আবদুল করিম গেয়ে ওঠেন : ‘সই গো, বসন্ত বাতাসে, বন্ধুর বাড়ির ফুলের গন্ধ আমার বাড়ি আসে।
প্রকৃতির দিকে তাকালে শীত-বর্ষার মতো বসন্তকেও সহজে চেনা যায়। বাঙালির জীবনে বসন্তের উপস্থিতি সেই অনাদিকাল থেকেই। সাহিত্যের প্রাচীন নিদর্শনেও বসন্ত ঠাঁই পেয়েছে নানাভাবে। আমাদের ঋতুরাজ বসন্তের আবহ আর পশ্চিমের ভ্যালেন্টাইন ডে যেন এক বৃত্তের দুটি কুসুম। এ যেন এক সুতোয় গাঁথা দুই সংস্কৃতির এক দোতরা। মানুষের মতই এ সময় পাখিরাও প্রণয়ী খোঁজে, বাসা বাঁধে। রচনা করে নতুন পৃথিবী।
হালে শহরের যান্ত্রিকতার আবেগহীন সময়ে বসন্ত যেন কেবল বৃক্ষেরই, মানুষের আবেগে নাড়া দেয় কমই। তারপরও আজ বসন্তের পয়লা দিনে নানা আয়োজনে আলোকিত হয়েছে রাজধানী ঢাকা। বিশেষত বাসন্তি শাড়ি আর সফেদ-শুভ্র পাঞ্জাবিতে তরুণ-তরুণীরা বইমেলা, বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস, উদ্যানমালা, ফাস্টফুড ক্যাফেতে বসন্ত আবাহন করবে নানা নৈবেদ্যে, নানা অনুষঙ্গ।
আজি বসন্ত জাগ্রত দ্বারে
‘বসন্তের ফুল গাঁথলো ও-আমার জয়ের মালা/বইলো প্রাণ দখিন হাওয়া, আগুন জ্বালা/ যৌবনেরই ঝড় উঠেছে আকাশ পাতালে/নাচের তালে ঝঙ্কার তাই আমায় মাতালে’- শুধু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে নয়, বসন্তের দখিন হাওয়া আজ মানব ও প্রকৃতির সবখানেই বয়ে যাবে। মাতাবে আপন মোহে। ভালোবাসায় ঝঙ্কার আনবে। কারণ আজ বসন্ত, আজ পহেলা ফাগুন। আর বসন্ত মানেই সুন্দরের জাগরণ। নবীনের আগমন। চিরায়ত সুন্দর, ভালোবাসা আর যৌবনের প্রতীক এ বসন্ত।
বসন্তের আগমনে হৃদয় পুলকিত আর আন্দোলিত হয় বলেই কবিরা আকাশে চোখ মেলে তাকাতেই যেন জ্বলে ওঠে আলো। বসন্তের বন্দনা করে একটি ছত্রও লেখেননি, এমন একজন বাঙালি কবিও খুঁজে পাওয়া যাবে না। প্রাচীন চর্যাপদে পাওয়া বসন্তকে আরও ঋদ্ধ করেছেন কবিগুরু। আর সুভাষ মুখোপাধ্যায় তো প্রকৃতিকে চ্যালেঞ্জ করে বলেই ফেলেছিলেন, ফুল ফুটুক আর নাই ফুটুক, আজ বসন্ত।