দু’চোখ যত দূর যায় শুধু ফুল আর ফুল। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলেই চোখ জুড়িয়ে আসতে চায়। ফুলের সুবাস যেন মন ভরিয়ে দেয়। বিমোহিত হয়ে যায় আগন্তুকরা। ফুলের ঘ্রাণে ঘুম কেড়ে নেয়ার মতোই একটি গ্রাম সাবদি। এটি নারায়ণগঞ্জের বন্দর উপজেলার একটি গ্রাম। বছরের এ সময়টা এ গ্রাম থাকে যেন মনমুগ্ধকর। ফুলের জন্য মানুষ আসছে। কেউ ক্রেতা আবার কেউ দর্শক। ফুল বিক্রির লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে ব্যস্ত বন্দরের ফুলচাষি আর ব্যবসায়ীরা। প্রতিদিনই ফুলের সৌন্দর্য উপভোগ করতে রাজধানী ঢাকাসহ আশপাশের বিভিন্ন এলাকা থেকে শত শত নারী-পুরুষ ভিড় জমায় বন্দরের এই সাবদিতে।
কাল পয়লা ফাগুন। একই দিনে বিশ্ব ভালোবাসা দিবস। এ ছাড়া একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। এসব দিবসকে কেন্দ্র করে ব্যস্ত সময় পার করছে তিন শতাধিক ফুলচাষি ও তাদের পরিবার। এ বছর অন্তত ১০ কোটি টাকার ফুল বিক্রির আশা করছেন বাগান মালিকরা। দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রায় প্রতিদিনই এখান থেকে ফুল সরবরাহ হয়ে থাকে।
সাবদি গ্রামসহ আশপাশের গ্রামগুলোতে কেউ পা রাখলেই বিস্মিত হয়ে ওঠেন। গ্রামগুলোকে ঘিরে শুধু ফুলের বাগান আর বাগান। কয়েক বর্গমাইল এলাকাজুড়ে কাঠমালতি, গাঁদা, ডালিয়া ও জিপসি ফুলের গুচ্ছ গুচ্ছ বাগান। বাড়ির আঙিনা থেকে শুরু করে গ্রামগুলোর রাস্তার দু’ধারে হাজারও কাঠমালতির সারি সারি বাগান। সারা গ্রামের সব জমিতে ফুল আর ফুল।
ব্রহ্ম্হ্মপুত্র নদের তীর ঘেঁষে নারায়ণগঞ্জের বন্দর উপজেলার কলাগাছিয়া ইউনিয়নের সাবদি, দীঘলদী ও মাধবপাশাসহ আট-দশটি গ্রামে প্রায় চার শ’ বিঘা জমিতে বাণিজ্যিকভাবে বিভিন্ন ধরনের ফুলের চাষ হচ্ছে গত এক দশক ধরে। ফুল চাষ করে সচ্ছলতার মুখ দেখেছেন এই অঞ্চলের হতদরিদ্র কৃষকরা।
ফুলের আবাদ করা বেশ কয়েকটি বাগান ঘুরে দেখা গেছে, বিভিন্ন রঙের গাঁদা, চেরি, চন্দ্রমল্লিকা, জবা, সূর্যমুখী, গ্যালেরিয়া, ডালিয়া, স্টার, মাম, কাঠমালতি, বেলি, জারবেরা ও জিপসিসহ অন্তত চল্লিশ প্রকারের দেশী-বিদেশী ফুল চাষ হচ্ছে এখানে। দেশের ফুল ব্যবসার প্রধান কেন্দ্র রাজধানীর শাহবাগের চাহিদার বড় একটি অংশ পূরণ করছেন এখানকার ফুল ব্যবসায়ীরা। তাই ফেব্রুয়ারি মাসে বিশেষ তিনটি দিবসে ফুলের চাহিদা মেটাতে গত চার পাঁচ মাস ধরেই ব্যস্ত সময় পার করছেন ফুলচাষিরা।
দীঘলদী গ্রামের প্রায় বিশটি জমিতে ফুল চাষ করা বাগান মালিক অধীর চন্দ্র হালদার বলেন, এই বছর ফুলের আশাতীত ফলন হয়েছে। সাবদি, দীঘলদি ও মাধবপাশার সবগুলো বাগানে যে ফুলের ফলন হয়েছে তা কমপক্ষে ১০ কোটি টাকা বিক্রি হবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।
যশোরের পর নারায়ণগঞ্জেও ফুল চাষের সম্ভাবনা বিশাল, বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের আরেকটি সম্ভাবনাময় খাত হতে পারে সেটিই প্রমাণ করেছে। নারায়ণগঞ্জ জেলায় চলতি বছর ১৫৫ হেক্টরের অধিক জমিতে ২৪ ধরনের ফুল চাষ হয়েছে। ফুলচাষ লাভজনক হওয়ায় চাষিরা তাদের জমিতে অন্যান্য শস্য ফলন না করে ফুলচাষে ঝুঁকে পড়েছেন।
ফুল চাষ করে স্বাবলম্বী নারায়ণগঞ্জের বন্দর উপজেলার কলাগাছিয়া ইউনিয়নের প্রায় ১৫ হাজার নারী-পুরুষ। এই উপজেলায় সবচেয়ে বেশি ফুল চাষ হয় কলাগাছিয়া ইউনিয়নের সাবদি গ্রামে। ফুলের সাম্রাজ্য সাবদি ছাড়াও ফুলের দেখা মেলে দীঘলদী, সেলশারদী, মাধবপাশা ও আইছতলায়।
সাবদি গ্রামের সবচেয়ে বড় ফুলবাগানের মালিক জাকির হোসেন জানান, বছরের বারো মাসই তিনি ফুল চাষ করেন। গোলাপ, গাঁদা, রজনীগন্ধা, গ্লাডিওলাস, জারবেরা, বাগানবিলাস, চন্দ্রমল্লিকা, ডালিয়া, কসমস, দোলনচাঁপা, নয়নতারা, মোরগঝুঁটি, কলাবতী, বেলি, জিপসি, চেরি, কাঠমালতী, আলমন্ডা, জবা, রঙ্গন, টগর, কাঠগোলাপ, রক্তজবা, ক্যালেন্ডুলা ফুলের চাষ করেন তিনি।
ফুলচাষি সানী মিয়া বলেন, ‘নারায়ণগঞ্জ, ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় ফুলের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। পয়লা ফাল্গুন, ভালোবাসা দিবস, পয়লা বৈশাখ, একুশে ফেব্রুয়ারি, ২৬ মার্চ, ১৬ ডিসেম্বরসহ জাতীয় দিবসগুলো ছাড়াও জন্মবার্ষিকী, মৃত্যুবার্ষিকী, গায়ে হলুদ, বিয়ের গাড়ি সাজানো, বিভিন্ন ধরনের পূজা-পার্বণ ও সভা-সমাবেশে ফুলের বেশ চাহিদা রয়েছে। এসব দিবস এলে ফুলের দাম একটু বেশি পাওয়া যায়।’
তিনি জানান, ‘দীঘলদী গ্রামের বেকার যুবক সুধেব চন্দ্র দাস প্রথম এই গ্রামে ফুলের চাষ শুরু করেন। পরে আরও কয়েকজন বেকার যুবক ওই গ্রামে সুধেবের দেখাদেখি ফুলের চাষাবাদ করেন। ওই গ্রামের রহমতউলল্লাহ ১৯৯২ সালে ডেমরার বাওয়া জুটমিলের চাকরি চলে যাওয়ার পর তিনি ঢাকায় ফেরি করে ফুলের ব্যবসা শুরু করেন। পরে ওই গ্রামের অপর ফুল ব্যবসায়ী মোতালেবের উৎসাহে ১৯৯৫ সালে তিনি গ্রামে এসে বার্ষিক ইজারা ভিত্তিতে অন্যের জমিতে ফুল চাষ শুরু করেন। বর্তমানে রহমতউল্লাহ ফুল চাষ করে নিজে ২০ বিঘা জমির মালিক হয়েছেন।’
ফুল তুলে ও মালা গেঁথে ঘরে বসেই পুরুষের পাশাপাশি স্থানীয় নারীরাও বাড়তি আয় করে সংসারে সহায়তা করে স্বাবলম্বী হয়ে উঠছেন। নারী ফুল শ্রমিক সীতা রানী চন্দ্র বলেন, ‘এখানকার নারীরা সাংসারিক সুখ-দুঃখের আলাপচারিতার ফাঁকে ফাঁকে ডালা ভরে ফুলকলি তুলে যার যার বাড়িতে ফিরে আসে’।
কাঠমালতী ফুল দিয়ে ‘গাজরা’ ও ফুলকলির লহর বানাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে পুরো এলাকার মহিলারা। স্কুলের ছাত্রছাত্রীরাও সকাল ৯টা পর্যন্ত কলি তুলে স্কুলে যায়। তারা আবার বিকেলে বাড়ি ফিরে ফুলের লহর বানাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। এ দিকে ফুলচাষিরা বাগান থেকে তুলে আনা ফুল বাড়ির আঙিনায় মালা গেঁথে সেগুলো সন্ধ্যায় সাবদি বাজারে নিয়ে জড়ো করেন। সাবদি বাজার থেকে ট্রাকে করে পাইকাররা প্রতি রাতে এসব ফুল ঢাকা, চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে নিয়ে যান বিক্রির জন্য। উৎসবের আগে সবাই বাগানের তাজা ফুল চায়, ফুলবাগান থেকেও অনেকে ফুল কিনে নিয়ে যায়।
বন্দর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা ফারহানা সুলতানা জানান, ‘বছরের বারো মাসই বন্দরের কয়েকটি গ্রামে ফুল চাষ করা হয়। পয়লা ফাল্গুন, বিশ্ব ভালোবাসা দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে ফুলের বিক্রি নিয়ে ব্যস্ত ফুলচাষি ও ব্যবসায়ীরা।
বন্দর থানা বহুমুখী ফুল ব্যবসায়ী সমবায় সমিতির সাধারণ সম্পাদক তাওলাদ হোসেন বলেন, ‘সারা বছর ফুলের ব্যবসা হলেও বিশেষ বিশেষ সময়ে বেশি ভালো হয়। বিভিন্ন দিবসে ফুল বিক্রির ধুম পড়ে যায়। এ ব্যবসায় আরও সাফল্য পেতে চীন থেকে আসা কৃত্রিম ফুল বন্ধের জন্য সরকারের হস্তক্ষেপ কামনা করি আমরা।
এ ছাড়া ফুল সংরক্ষণ, মান অনুযায়ী বিন্যাস করা ও মোড়কীকরণের ক্ষেত্রে আধুনিক প্রযুক্তি ও কলাকৌশলের অভাব রয়েছে। ফুলচাষে বিদ্যমান সমস্যা নিরসন করে এই খাত সম্প্রসারণে সরকারি উদ্যোগের দাবি সব সময়ই জানান ফুলচাষিরা। তবে এ বছর পোকায় ফুলের ক্ষতি সাধন করছে। এসব সমস্যা সমাধানে সরকার উদ্যোগ নিলে ফুল বিদেশে রফতানি করে বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের অতিরিক্ত উপপরিচালক মোহাম্মদ আবদুল কাদির জানান, নারায়ণগঞ্জের ফুলচাষকে আরও প্রসারিত করতে ইতোমধ্যে নানা প্রক্রিয়া গ্রহণ করা হয়েছে। তিনি বলেন, আমরা ফুলবাগান মালিকদের সাথে কথা বলেছি। তাদের সমস্যার ব্যাপারে আমরা খোঁজখবর নিয়েছি। আমরা বাগান মালিকদেরকে বলে এসেছিÑ যদি আর্থিক সহায়তার প্রয়োজন হয় সে ক্ষেত্রে কৃষি ব্যাংকের মাধ্যমে আমরা ব্যবস্থা করব।